আজ ২৬ নভেম্বর, শুক্রবার ভোর ৫টা ৪৫ মিনিটে মাঝারি ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে সারাদেশ। আসাম, ত্রিপুরা ও পশ্চিমবঙ্গেও এ ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে বলে খবরে জানা যায়। এর মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৮। ভূমিকম্পের মাত্রা ও উৎপত্তিস্থল সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের ইউএসজিএসের ওয়েবসাইটে জানানো হয়, উৎপত্তিস্থল মিয়ানমারে। এর মাত্রা ছিল ৬.১।
Advertisement
বাংলাদেশে মাঝে মাঝেই ভূমিকম্পের খবর শোনা যায়। প্রায়ই রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে তীব্র ভূমিকম্প অনুভূত হয়। ভূমিকম্প একটি প্রাকৃতিক ঘটনা। মূলত ভূমির কম্পনকে বলে ভূমিকম্প। বিজ্ঞানের ভাষায়-পৃথিবী পৃষ্ঠের অংশবিশেষের হঠাৎ অবস্থান পরিবর্তন বা আন্দোলনই ভূমিকম্পন। ভূ-পৃষ্ঠের বহু নিচে শিলা-খন্ডের অবস্থান পরিবর্তনের কারণে ভূমিকম্প হয়ে থাকে।
আরও সহজ করে বলা যায়, ভূ অভ্যন্তরে যখন একটি শিলা অন্য একটি শিলার উপরে উঠে আসে তখন ভূমি কেঁপে উঠে। হঠাৎ ঘরের কোনো জিনিস দুলতে শুরু করে। যেমন- দেয়ালঘড়ি, টাঙানো ছবি বা খাটসহ অন্য যে কোনো আসবাব কেঁপে উঠে। তখন বুঝতে হবে ভূমিকম্প হচ্ছে।
গোটা পৃথিবীতে বছরে গড়ে ছয় হাজার ভূমিকম্প হয়। এগুলোর বেশিরভাগই মৃদু। তাই সেগুলো আমরা টের পাই না। ভূমিকম্প পূর্বাভাস দেওয়ার প্রযুক্তি এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি। সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী হয়েও ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দিতে পারার ক্ষমতা নেই মানুষের। তাই উপায় নেই ভূমিকম্প রোধ করার।
Advertisement
সুনামি, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলোর পূর্বাভাস আগে থেকেই পাওয়া যায়। সে অনুযায়ী আক্রান্ত হতে যাওয়া অঞ্চলগুলোর মানুষদের সামনে কিছু প্রস্তুতি গ্রহণের সুযোগ থাকে বটে। বিজ্ঞান ও গবেষণার উচ্চ শিখরে আরোহণ করেও আমরা প্রকৃতির এ তাণ্ডবলীলা থেকে নিজেদের মুক্ত করতে সক্ষম হইনি। এজন্য হঠাৎ করে আঘাত হানা ভূকম্পনে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও থাকে অনেক বেশি।
এ রকম প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পূর্বাভাস পেতে গত ক’বছর ধরে বিজ্ঞানীরা পরিসংখ্যান, তাত্ত্বিক, ভূ-পদার্থিক ও রাসায়নিক পদ্ধতি ব্যবহার করে আসছেন। তবে এভাবে কিছু কিছু এলাকাকে ভূমিকম্প প্রবণ বলে শনাক্ত করা হয়েছে মাত্র। স্বল্প সময়ের মধ্যে ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেওয়া এবং সময়মতো জনগণকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থার অগ্রগতি না হওয়ায় এখন বিজ্ঞানীরা ভাবছেন, জীবজন্তুর আচরণ কি পূর্বাভাস দেওয়ার একটি পদ্ধতি হিসেবে কাজ করবে?
বিজ্ঞানীরা ভূমিকম্পের পূর্বাভাস পেতে এবার জীবজন্তুর দ্বারস্থ হয়েছেন। জীবজন্তুর আচরণ পর্যালোচনা করে ভূমিকম্পের খবর আগে থেকে সত্যিই জানা যায় কি না, এ নিয়ে বিজ্ঞানীরাও যথেষ্ট উৎসুক।
গবেষকরা জানান, সত্যিই পৃথিবীতে এমন অনেক জীবজন্তু রয়েছে যেগুলো বেশ আগে থেকেই ভূমিকম্পের আগাম খবর পায়। চারপাশে চলাফেরা করা জীবজন্তুর মধ্যে কুকুর অতি সাধারণ একটি প্রাণী। এ প্রাণীর রয়েছে ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দিতে পারার অদ্ভুত ক্ষমতা। ভূমিকম্পের পূর্বে জীবজন্তু যে অস্বাভাবিক আচরণ করে এমন পর্যবেক্ষণ প্রাচীনকালের মানুষেরাও করেছিলেন।
Advertisement
প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন বর্ণনায় ও লোককথায় ভূমিকম্প বা বড় কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের আগে জীবজন্তুর অদ্ভুত আচরণের কথা জানা যায়। প্রাচীনকালে জাপানি জেলেরা বিশ্বাস করতো, সমুদ্রের মাঝে একসঙ্গে অনেকগুলো উড়–ক্কু মাছ দেখা গেলে কয়েকদিনের মধ্যেই কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা দেবে।
গ্রীক সাহিত্যে রয়েছে, তিনশ তিয়াত্তুর খ্রিষ্ট পূর্বাব্দে গ্রিসের হেলিস শহরে ভূমিকম্পের আগে সাপ ও অন্যান্য পোকা-মাকড় গর্ত থেকে বেরিয়ে এসে শহর ত্যাগ করে। বার্লিনের ফ্রি ইউনিভারসিটির ভৌত রসায়নের প্রফেসর হেলমুট ট্রাইবাচ এর মতানুসারে, জীবজন্তু বিশেষ করে মাটির নিচে বসবাসকারী জীবজন্তু বুঝতে পারে যে ভূমিকম্প আসছে। চীন ও জাপানে শত শত বছর ধরে এ রকম পর্যবেক্ষণ ভূমিকম্প সতর্কীকরণ সিস্টেমের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে ব্যবহার করে কৃতকার্য হয়েছে।
১৮৯৬ সালে চীনের তিয়েনসিনে এক বিধ্বংসী ভূমিকম্প হয়। তার মাত্র চারদিন আগে সেখানকার চিড়িয়াখানায় থাকা বড় জীবজন্তুগুলো প্রচন্ড চিৎকার আর দাপাদাপি করতে থাকে। পাখিরাও অস্থির হয়ে ওঠে। ১৯২০ সালে চীনের হাইয়ানে সবচাইতে বড় ভূমিকম্প হয়। যার মাত্রা ছিলো ৮.৫। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, ওই সময় এলাকার কুকুরগুলো অদ্ভূতভাবে জোরে জোরে ডাকাডাকি শুরু করে। এ ভূমিকম্পের পূর্বে নেকড়ে বাঘ দলবেধে দৌঁড়ায় এবং চড়ুইপাখি এলোমেলো ভাবে উড়ে।
১৯৬৬ সালে উত্তর চীনের সিংতাইয়ে ৬.৮ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিলো। ভূমিকম্পের আগে সে এলাকার কুকুরগুলোও দলে দলে ডাকাডাকি ও ছোটাছুটি শুরু করে। ইঁদুর, বিড়াল সব ঘর ছেড়ে রাস্তায় বেরিয়ে আসে। সবচেয়ে বেশি অস্বাভাবিক আচরণ পরিলক্ষিত হয়েছিলো সাপের ক্ষেত্রে। এরা শীতনিদ্রা থেকে বের হয়। হাইচেং শহরের রাস্তায় হঠাৎ অসংখ্য সাপ ও ইঁদুর দেখে চীনারা বেশ গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নেয়। এ ছাড়াও স্থানীয় মানুষের কাছ থেকে জানা যায়, ঘোড়া, গরু, মহিষ, ছাগল সব লাফালাফি করতে থাকে। এর প্রায় ত্রিশ ঘণ্টা পর সেখানে একটি বড় মাত্রার ভূমিকম্প সংঘঠিত হয়।
আমেরিকাতেও এরকম ঘটনা লক্ষ্য করা যায়। ক্যালিফোর্নিয়ার ভূমিকম্প প্রবণ অঞ্চলে বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে প্রাণীদের অনুরূপ আচরণ লক্ষ্য করেন। মাটির মধ্যে গর্ত করে থাকা ইঁদুরও ভূমিকম্পের খবর আগে থেকে টের পায় বলে জানান, যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাঙ্গিলা রাসকিন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ও জীববিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. রাচেল গ্রান্ট।
তিনি বলেন, ‘অবাক করার মতো ব্যাপার হলো, ভূমিকম্পের আগে ইঁদুর সবার আগে পালিয়ে যায়। ভূমিকম্পের আটদিন আগে থেকে কোনো ইঁদুর দেখতে পাওয়া যায় না। অথচ বনজঙ্গলে তাদের প্রায় সব জায়গাতেই দেখতে পাওয়া যায়।’ তিনি আরও বলেন, ‘ভূমিকম্প আঘাত হানার পাঁচ দিন আগেই সেখানকার প্রায় ৯৬ শতাংশ ব্যাঙ তাদের প্রজননক্ষেত্র ছেড়ে অন্যত্র নিরাপদ স্থানে চলে যায়। ভূমিকম্পের পর ব্যাঙগুলো পুনরায় তাদের আবাসস্থলে ফিরে আসে।
২০০৬ সালে সাগরের তলায় ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্ট সুনামির আগে সমুদ্রের গভীর থেকে প্রচুর মাছ ইন্দোনেশিয়া ও ভারতের উপকূলে এসে জেলেদের জালে ধরা পড়ে। উপকূলে কয়েক মিনিট আগে অভাবনীয় দৃশ্য চোখে পড়ে। হরিণ জাতীয় প্রাণীর একটি বড় দল নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য খুব দ্রুত নিকটবর্তী পাহাড়ের চূড়ায় চলে যায়।
শ্রীংলকার দক্ষিণ পূর্ব উপকূলে সমুদ্র থেকে তিন কিলোমিটার ভেতরে অবস্থিত শ্রীলংকার সবচেয়ে বড় বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ এলাকা হিসেবে পরিচিত ইয়ালা ন্যাশনাল পার্কে প্রলয়ঙ্কারি সুনামির ঢেউ বন্যার সৃষ্টি করে। কিন্তু সবগুলো হাতি, লেপার্ড, হরিণ এবং অন্যান্য বন্যপ্রাণী বেঁচে যায়। ভূমিকম্পের এপিসেন্টার থেকে প্রায় একশ’ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত মালয়েশিয়ার তাইপিং চিড়িয়াখানার প্রাণীরা হঠাৎ করে অস্বাভাবিক আচরণ করতে শুরু করে। হিপোটমাসসহ কিছু জীবজন্তু তাদের আশ্রয়ে ঢুকে যায় এবং বের হতে চায় না।
একইভাবে পোহাই সাগরে ১৯১৮ সালের ১৮ জুলাই সংঘটিত ভূমিকম্পের আগে গাংচিল, হাঙ্গর ও মাছের অস্বাভাবিক আচরণ দেখা গেছে। এছাড়াও পান্ডা, হরিণ, মাছ এবং অন্যান্য জীবজন্তুর অস্বাভাবিক আচরণের ওপর ভিত্তি করে ভূমিকম্পের কয়েক ঘন্টা পূর্বে স্থানীয় জনগণের উদ্দেশ্যে সতর্কতা জারী করা হয়। বিজ্ঞানীদের মতে প্রশ্ন উঠে, আসন্ন ভূমিকম্পের আগাম সতর্কতা হিসেবে এদের কি কোনো প্রকার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় কাজ করেছিলো?
ভূমিকম্পের পূর্বাভাস জানাতে জীবজন্তুর ব্যবহার চীনে নতুন নয়। চীনের রাষ্ট্রীয় পত্রিকা- চায়না ডেইলির প্রতিবেদন মতে, নানচ্যাংয়ের একটি শহরে ভূমিকম্পের পূর্বাভাস জানতে কুকুরকে ব্যবহার করা হয়েছিল বলেই জিনজিয়াংয়ে ভয়াবহ ভূমিকম্পে মাত্র তিনজন নিহত হয়। অতীতে এসব ভূমিকম্পেই হাজার হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটতো। ভূমিকম্পের আগাম সংকেত পেতে বিভিন্ন জীবজন্তু নিয়ে গবেষণা করছেন চীনের গবেষকরা। চেষ্টা চলছে মুরগি, মাছ ও ব্যাঙের মতো প্রাণীর মাধ্যমে ভূকম্পনের সংকেত পাওয়ার।
চীনা বিজ্ঞানীরা জীবজন্তুর অস্বাভাবিক আচরণ পদ্ধতিগতভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেছে। যদি মুরগি গাছের ওপর উঠে ওড়াউড়ি করে, জলাশয়ের মাছ লাফালাফি করে এবং ব্যাঙ দলবেঁধে ঘুরতে থাকে। তাহলে বুঝে নিতে হবে যে শিগগিরই ভূমিকম্প ঘটতে যাচ্ছে। এসব জীবজন্তুর অস্বাভাবিক আচরণ থেকে ভূমিকম্পের পূর্বাভাস জানা যাবে বলে গবেষকরা দাবি করেন।
জীবজন্তুর আচরণ দিয়ে কি সত্যিই ভূমিকম্প বা অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের পূর্বাভাস পাওয়া সম্ভব? নাকি এটি শুধু একটা ধারণা মাত্র? এ ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা জানান, ‘ভূমিকম্পের আগে ছোট ছোট কম্পন পশুপাখিরা টের পায়।’ নাসার ভূপদার্থবিদ ফ্রেডম্যান ফ্রেউন্ড জানান, ‘ভূমিকম্পের সময় ভূগর্ভস্থ পাথরগুলোর সংঘর্ষের কারণে মাটি বা জলাশয়ে কিছু রাসায়নিক পরিবর্তন হয়। মাটির নিচে ধনাত্মক আয়নের সৃষ্টি হয়। আয়নগুলো উঠে আসে ভূপৃষ্ঠে। আয়নগুলো ভূপৃষ্ঠের বাতাস ও পানির সঙ্গে বিক্রিয়া করে সেখানকার স্বাভাবিক প্রাকৃতিক ভারসাম্যও নষ্ট করে।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই ধনাত্মক আয়নের সংস্পর্শে মানুষের মাথাব্যথা ও বমি বমি ভাব হয়। বন্য জীবজন্তু এই রাসায়নিক পরিবর্তনগুলো টের পায় এবং এর সংস্পর্শ এড়াতে চায়। সেজন্য তারা চলে যায় অন্য কোনো স্থানে। এমনকি অনেক গভীর পানির মাছকেও ভূমিকম্পের আগে পানি থেকে উঠে আসতে দেখা যায়।
ওয়াং জিয়াত্তকিং নামক এক চীনা গবেষকের মতে- ভূ নিম্নস্থ পানির প্রবাহ, পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র, তাপমাত্রা ও শব্দ তরঙ্গকে ভূমিকম্প প্রভাবিত করে। যেহেতু মানুষের তুলনায় জীবজন্তু বেশি সংবেদনশীল, তাই তারা আলট্রাসাউন্ড প্রক্রিয়ায় মানুষের আগে এই পরিবর্তনগুলো বুঝতে পারে। বড় আকারে ভূমিকম্পের পূর্বে যে ইলেক্ট্রো মেকানিক্যাল অথবা ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক পরিবর্তন হয়। তা জীবজন্তু বুঝতে পারে এবং সেভাবে আচরণ করে।
উদাহরণ স্বরূপ, ক্যাটফিসের সম্পূর্ণ ত্বকে চমৎকার সেনসরি অঙ্গ রয়েছে। যা সাধারণত শিকার ধরার জন্য ব্যবহৃত হয়। ভূমিকম্পের কারণে পানির সামান্য ইলেক্ট্রোকেমিক্যাল পরিবর্তনও এই স্নায়ুগুলো বুঝতে পারে। একইভাবে, কবুতরের পায়ের টিবিয়া ও ফিবুলার মধ্যে অতিরিক্ত সংবেদনশীল স্নায়ু রয়েছে। তাই আসন্ন ভূমিকম্পের সংকেত পৃথক করার ব্যবস্থা ও সংবেদনশীলতা জীবজন্তুর রয়েছে।
আগামীতে ভূমিকম্পের পূর্বাভাসে জীবজন্তুর আচরণ পর্যালোচনা ও ভূতাত্তি¡ক উপাদানগুলো পরিমাপের জন্য জীববিজ্ঞানী ও ভূতাত্ত্বিকরা একসঙ্গে কাজ করবেন। ভূমিকম্পের সময় জীবজন্তু কেমন আচরণ করে তা নিয়ে আরও ব্যাপক গবেষণা হওয়া প্রয়োজন বলে বিজ্ঞানীরা মনে করেন।
কেএসকে/এমএস