মতামত

পুঁথির চরণ, গণপরিবহন ও উন্নত দেশের স্বপ্ন

ড. মতিউর রহমান

Advertisement

আমার অতি কাছের একজন একদিন জানতে চাইল, “ঘোড়ায় চড়িয়া মর্দ হাঁটিয়া চলিল” এর অর্থ কী? আমি বললাম, যতদূর জানি এটা মধ্যযুগের একজন পুঁথি রচয়িতার কোনো পুঁথির একটি চরণ। আমি আরো বললাম এর পরে আরো কয়েকটি চরণ আছে, যেমন, “কিছু দূর যেয়ে মর্দ রওনা হইল; ছয় মাসের পথ মর্দ ছয় দিনে গেল! লাখে লাখে সৈন্য মরে কাতারে কাতার; শুমার করিয়া দেখে পঞ্চাশ হাজার!” সে অবাক হয়ে বলল এগুলোর মানে কী? উত্তরে বললাম কোনো মানে নেই।

কেউ কেউ বলেন, মধ্যযুগের পুঁথি রচয়িতরা পাঠকদের মনোযোগ আকর্ষণ ও আনন্দ দেয়ার জন্য উদ্ভট যুক্তি ও শব্দসহ পুঁথি রচনা করে তা পাঠকদের পড়ে শোনাতেন। সাধারণ মানুষ এগুলোর মানে নিয়ে কখনো মাথা ঘামাত না। কিংবা মানে থাকলেও তারা তা বুঝত না। বোঝার চেষ্টাও করতো না। যদি কোনো মানে বা অর্থ থাকতো তবে তা একমাত্র পুঁথি রচয়িতাই জানত।

আবার অনেক পন্ডিত বা পুঁথি বিশেষজ্ঞের মতে একশ্রেণির লেখক পরবতীর্কালে এসব পুঁথির ভাষা বিকৃত করে পাঠকদের সামনে উপস্থাপন করে। কারণ আসল পুঁথি রচয়িতাদের বেশির ভাগই ছিল ইসলাম ধর্মাবলম্বী। তাদেরকে হেয় করার জন্যই অন্য ধর্মের লেখকরা এই হীন প্রয়াস চালান। তবে উল্লিখিত পুঁথির আসল চরণগুলোও খুঁজে পাওয়া কষ্টকর।

Advertisement

পুঁথি সাহিত্য বাংলা সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য এক স্থান দখল করে আছে। তাই পুঁথির উল্লিখিত চরণগুলো এখনও মানুষ ব্যবহার করে। বিশেষ করে কোনো বিষয়ে অসঙ্গতি দেখা দিলে পুঁথির এধরনের চরণ তুলে ধরা হয়। বন্ধুটি আগ্রহের সাথে জিজ্ঞাসা করল, কী কী বিষয়ে অসঙ্গতি আছে যেখানে এরকম কথা প্রযোজ্য হয়। আমি বললাম এরকম অসঙ্গতি তো অবশ্যই আছে। আমাদের জীবনে, সমাজে, রাষ্ট্রে অসঙ্গতির কী কোনো শেষ আছে। কোনটা রেখে কোনটা বলব। তবে বর্তমানে ব্যাপকভাবে আমাদের জীবনকে প্রভাবিত করছে এরকম দুয়েকটি অসঙ্গতির কথা বলা যেতেই পারে।

আমরা সবাই জানি আমাদের এই প্রিয় দেশটাকে উন্নত দেশে পরিণত করার লক্ষ্যে অনেক উন্নয়ন পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে। যার অনেকগুলোই বাস্তবায়িত হয়েছে। অনেক প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন। জাতির অহংকার পদ্মাসেতুর মতো প্রকল্পও পুরোপুরি বাস্তবায়নের পথে। এছাড়াও বিদ্যুৎ খাত, ব্রিজ, কালভার্ট, রাস্তাাঘাট, হাটবাজারসহ অবকাঠামোগতখাতে গত একযুগের উন্নয়ন চোখে পড়ার মতো। সেইসাথে আর্থ—সামাজিকখাতেও উন্নতি ঘটেছে।

দেশের উন্নয়ন নিয়ে কেউ দ্বিমত পোষণ করেন বলে মনে হয় না। কারণ বাংলাদেশ ইতিমধ্যে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে শামিল হয়েছে এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত করার পরিকল্পনা গৃহীত হয়েছে। করোনা মহামারির কারণে হয়ত এক—দুই বছর এদিক— ওদিক হতে পারে। কিন্তু উন্নত দেশ হওয়ার যে স্বপ্ন সাধারণ মানুষের মন ও মগজে গেঁথে গেছে তা থেকে সরে আসার কোনো সুযোগ ও অবকাশ আছে বলে মনে হয় না। উন্নয়নের এই রাস্তা থেকে সরে গেলে বিপর্যয় অনিবার্য বলে বিশেষজ্ঞরা শাসক সম্প্রদায়ের প্রতি সতর্ক—বার্তাও জানিয়ে দিয়েছেন।

উন্নত দেশ হওয়ার এই লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাতে অন্যান্য সব সেক্টরের মধ্যে যে সেক্টরটিকে বেশি গুরুত্ব দেয়ার জন্য বিশেষজ্ঞরা বার বার গুরুত্ব দিচ্ছেন তাহলো পরিবহন খাত। কারণ ২০৪১ এর মধ্যে উন্নত দেশের উপযোগী পরিবহন ব্যবস্থা বাস্তবায়নের কোনো লক্ষণ তারা দেখতে পাচ্ছেন না। বরং পরিবহন খাতে তৈরি হয়েছে বিশৃংখলা। বিজ্ঞজনদের অনেকেই মনে করেন এই খাত এখন পুরোপুরি মাফিয়াদের দখলে। এরা এতই ক্ষমতাধর যে যখন—তখন যে কোনো উসিলায় সারাদেশের পরিবহন যোগাযোগ বন্ধ করে দেশটাকে অচল করে দিতে পারে।

Advertisement

পরিবহন থেকে ফেলে দিয়ে মানুষ মারা, বাসে বাসে রেষারেষি করে সাধারণ যাত্রীদের হাত—পা বিচ্ছিন্ন করে ফেলা, কোনো মহিলা যাত্রীকে একা পেয়ে পরিবহন কমীর্দের দ্বারা ধর্ষণ ও হত্যা করার মতো ঘটনার কথাও তো আমরা জানি। সুতরাং, পরিবহন খাতের এই যে নৈরাজ্য— তা আমাদের উন্নত দেশে পৌঁছার জন্য বড় একটি প্রতিবন্ধক। উন্নয়নের গতির সাথে পরিবহন ব্যবস্থার এই যে বিশৃংখলা এটাকেও অনেকে “ঘোড়ায় চড়িয়া মর্দ হাঁটিয়া চলিল”এর সাথে তুলনা করেন।

বর্তমান যুগ তথ্য প্রযুক্তির যুগ। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব অনেক আগেই শুরু হয়েছে। আমাদের দেশেও এই খাতে অনেক অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। আমাদের গতি অনেক বেড়ে গেছে। কিন্তু পরিবহন ব্যবস্থায় সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাবে আমাদের গতি কমে যাচ্ছে। ঢাকা শহরের পরিবহন ব্যবস্থার দিকে তাকালে তা চাক্ষুষ প্রমাণ হয়। হরেক রকম যানবাহনের কারণে খোদ রাজধানী শহর যেভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্থবির হয়ে যায় তা সভ্য ও উন্নত কোনো দেশে হয় বলে জানা নেই।

ঢাকা মহানগরীতে গণপরিবহন ব্যবস্থার এই নৈরাজ্যকর পরিস্থিতিতে কী পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি, স্বাস্থ্য ক্ষতি, মানসিক ক্ষতি হয় তার হিসেবে ও প্রতিবেদন প্রতিনিয়ত বিজ্ঞজনেরা তুলে ধরছেন এবং এ অবস্থা থেকে উত্তরণে বিশেষজ্ঞরা অনেক পরামর্শ ও বাস্তবায়ন কৌশল সরকারকে বাতলে দিয়েছেন ও দিচ্ছেন। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয় বলে মনে হয়না। অবস্থা যা ছিল তাই আছে। বরং দিন দিন তা আরো খারাপ হচ্ছে। সুতরাং যে গতিতে আমরা এগোতে চাচ্ছি তা থমকে যাচ্ছে গণপরিবহন খাতে বিশৃংখলার কারণে।

সাম্প্রতিক সময়ে ডিজেলের দাম বাড়ানোর কারণে যেভাবে পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন তা অত্যন্ত বিস্ময়কর। কোনো রকম আলাপ—আলোচনা ছাড়া ধর্মঘট ডেকে বসা ও সাধারণ যাত্রীদের জিম্মি করে ফেলা কোনো উন্নত ও সভ্য দেশে হয় বলে আমাদের জানা নেই। বিভিন্ন পরিসংখ্যানে তুলে ধরা হয়েছে ঢাকা মহানগরের বেশিরভাগ গণপরিবহন চলে কমপ্রেসড ন্যাচার্যাল গ্যাসে। অথচ ডিজেলের দাম বাড়ানোয় এইসব পরিবহনও ভাড়া বাড়িয়েছে দ্বিগুণ বা তিনগুণ।

এসব প্রতিরোধে যখন ভ্রাম্যমান আদালত অভিযান করে তখন তারা সব গণপরিবহন বন্ধ করে দিয়ে সাধারণ মানুষকে আবারো দুভোর্গে ফেলেন—— যা অনাকাঙ্খিত ও অন্যায্য। এ অবস্থার অবশ্যই অবসান হওয়া দরকার। এজন্য প্রয়োজনে সরকারকে কোনো প্রকার ছাড় না দিয়ে আরো কঠোর অবস্থান নিতে হবে। বিশেষজ্ঞরা রাজধানীকে যানজটমুক্ত রাখতে যে সব পরামর্শ দিয়েছেন তা অতি দ্রƒত বাস্তবায়ন করতে হবে।

ঢাকা মহানগরীর মধ্যে যাত্রীবাহীবাস, স্কুল বাস, এ্যাম্বুলেন্স, সরকারি যানবাহন ও পণ্য পরিবহনের কাজে নিয়োজিত যানবাহন ছাড়া সব যানবাহন বন্ধ করে দিতে হবে। একমাত্র সরকারি ব্যবস্থাপনায় বা দক্ষ বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় যাত্রী পরিবহনে উন্নত বাস সার্ভিস চালু করতে হবে। প্রয়োজনে এলাকাভিত্তিক বাস সার্ভিস চালু করা যেতে পারে। একইভাবে বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা শহরেও এব্যবস্থা বাস্তবায়ন করতে হবে।

বাসে চড়ার সংস্কৃতি চালু করতে হবে। যে যত ধনীই হোক না কেনো দেশের প্রতি মায়া থাকলে সে এব্যবস্থা মেনে নিবে। কারণ নিশ্চয় তারা বিদেশে দেখেছেন অনেক বড় বড় ধনীরাও সেদেশে বাসে বা ট্রেনে চড়ে যাতায়াত করে। অনেক মন্ত্রী, এমপি সাইকেল চালিয়ে অফিস করেন। যেহেতু আমাদের দেশটি ছোট, জনসংখ্যা বেশি, রাস্তাঘাট শুরু তাই হরেক রকম যানবাহনের প্রচলন না করে দুই তিন প্রকার যানবাহনের প্রচলন করা গেলে দেশটিকে আরো এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব বলে মনে করি। এক্ষেত্রে দেশ—বিদেশের পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও নগর বিশেষজ্ঞদের সহায়তা নেয়া যেতে পারে। একাজটি দ্রুত শুরু করতে হবে। নাহলে পুঁথির চরণের মতো অবস্থা হবে আমাদের প্রাণাধিকপ্রিয় এদেশটির। হারিয়ে যাবে উন্নত দেশে ওঠে আসার লালিত স্বপ্ন। উন্নয়নের স্বাদ পাওয়া কারো জন্যই যা কাম্য নয়।

লেখক : গবেষণা পরামর্শক, হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ সেন্টার (এইচডিআরসি), ঢাকা।

এইচআর/জিকেএস