দেশজুড়ে

নিজেদের অর্জিত আয়ে ব্যয় করার স্বাধীনতা নেই পাহাড়ি নারীদের

পাহাড়ে উৎপাদনের প্রতিটি সেক্টরে মুখ্য ভূমিকা রয়েছে নারীদের। উৎপাদন থেকে শুরু করে পণ্য বাজারজাতকরণসহ সমাজের বিভিন্ন কাজে পাহাড়ি নারীরা পুরুষদের সঙ্গে সমানতালে কাজ করে যান। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনেকটাই এগিয়ে রয়েছেন নারীরা। মূল জনগোষ্ঠীর নারীরা কাজের ক্ষেত্রে যেখানে এখনও অনেকটা পিছিয়ে সেখানে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর নারীরা এক্ষেত্রে অনেকটাই এগিয়ে।

Advertisement

স্থানীয় অর্থনীতির প্রতিটি ক্ষেত্রে পাহাড়ি নারীরা জড়িত থাকলেও পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতায় নিজেদের শ্রমে উপার্জিত অর্থ ব্যয়ে রয়েছে বৈষম্য। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার তথ্যমতে, রাঙ্গামাটির পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর প্রায় দেড় লাখ নারীর ৮০ ভাগই ঘরের বাইরে কাজ করে পরিবারের অর্থনৈতিক চাকা সচল রাখছেন। তবে অর্থনৈতিক ব্যয়ের ক্ষেত্রে তাদের পুরোপুরি স্বাধীনতা নেই। নিজেদের অর্জিত অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে এখনও তাদের নির্ভর করতে হয় পরিবারের কর্তার ওপর। প্রান্তিক পর্যায়ে নারীদের এ সমস্যা আরও প্রকট।

জুম থেকে পণ্য উৎপাদন করে বাজারে নিয়ে বিক্রি। এরপর সেই অর্থ সংসারের কাজে ব্যয়। তারপরও নিজেদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে পারেনি প্রান্তিক পর্যায়ের নারীরা।

রাঙ্গামাটির অদূরে কাপ্তাই হ্রদের দ্বীপগ্রাম বন্দুকভাঙ্গায় থাকেন জোসনা চাকমা। শহর থেকে নদীপথে ঘণ্টাখানেকের পথ। বন্দুকভাঙ্গায় জুমে শাকসবজি ও ফলমূল উৎপাদন করে সে ফসল প্রতি সপ্তাহে শনি ও বুধবার জেলার সবচেয়ে বড় হাট বনরূপা বাজারে এনে বিক্রি করেন।

Advertisement

প্রতি সপ্তাহে জুমে যেসব ফসল উৎপাদন হয়, সেগুলো নিয়ে হাটে আসেন জোসনা। এসব পণ্য বিক্রি করে যা পান, তার সবই পরিবারের কর্তার হাতে তুলে দিতে হয়।

জোসনা চাকমা জাগো নিউজকে বলেন, ‘বাজারে গিয়ে পণ্য বিক্রি করে যা আয় হয় সেই টাকা দিয়ে নিজের পছন্দমতো কিছুই কেনার সুযোগ থাকে না। টাকা কোন খাতে কত খরচ হবে সেটা পরিবারের কর্তাই ঠিক করেন। সংসার, ছেলেমেয়ের পড়ালেখার খরচ জোগাতেই সব টাকা শেষ হয়ে যায়।’

শুধুই জোসনা চাকমাই নন, জুম চাষে ফসল ফলানো থেকে শুরু করে উত্তোলন, বাজারে নিয়ে বিক্রি—সবক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন পাহাড়ি নারীরা। এ টাকা খরচ করার পূর্ণ এখতিয়ার শুধু পরিবারের কর্তারই রয়েছে।

সরকারি কর্মজীবী নারী কবিতা চাকমা জাগো নিউজকে বলেন, ‘হয়তো আমাদের লেভেলে তেমন একটা সমস্যা হয় না, কিন্তু প্রান্তিক পর্যায়ে সেই মনমানসিকতা এখনও গড়ে ওঠেনি। এটা পরিবর্তন হওয়া অবশ্যই প্রয়োজন।’

Advertisement

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা প্রোগ্রেসিভের নির্বাহী পরিচালক সুস্মিতা চাকমা বলেন, ‘আমি একটি প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালক। এখানে আমার স্বাধীনতা থাকে কোনো সিদ্ধান্ত নেবো কি নেবো না। কিন্তু যখন পরিবারে যাই, তখন সেই স্বাধীনতা থাকে না। কারণ তখন সংসারে খরচের জন্য স্বামীর সঙ্গে পরামর্শ করতে হয়। পরামর্শটা এজন্য জরুরি যে, যেন ভবিষ্যতে কোনো ভুল-ত্রুটি হলে আমার একার ওপর দোষারোপ করতে না পারে। অনেক সময় বড় কোনো খরচের ক্ষেত্রে দেখা যায় স্বামী একমত হচ্ছেন না, তখন নিজের ইচ্ছে থাকলেও সেটা আর ক্রয় করার সুযোগ থাকে না।’

পুরুষতান্ত্রিক মনমানসিকতার পরিবর্তন ঘটলেই পাহাড়ে নারীদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা আসবে বলে মনে করেন সচেতন নাগরিক কমিটির সহ-সভাপতি আইনজীবী সুস্মিতা চাকমা। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘পুরুষের সঙ্গে সমানতালে কাজ করে গেলেও খরচের বেলায় তাদের কোনো স্বাধীনতা থাকে না। এজন্য মনমানসিকতার পরিবর্তন জরুরি।’

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ চাঁদ রায় জাগো নিউজকে বলেন, ‘পাহাড়িদের নারীদের অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা নেই—এটা পুরোপুরি ঠিক নয়। শিক্ষিত সমাজে স্বামী-স্ত্রী দুজনকেই একসঙ্গে সিদ্ধান্ত নিতে দেখা যায়। তবে প্রান্তিক পর্যায়ে হয়তো কিছুটা ব্যতিক্রম এখনও আছে।’

শংকর হোড়/এসআর/জিকেএস