মতামত

আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস ও কিছু কথা

আজ ২৫ নভেম্বর। আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য ‘নারী নির্যাতন বন্ধ করি, কমলা রঙের বিশ্ব গড়ি’। মানুষ শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি, মানুষের জন্যই মানুষ। বিপদ-আপদে ছুটে এসে একে অপরকে সাহায্য করবে এটাই স্বাভাবিক আর মানুষের কাছে এই প্রত্যাশা আমরা করতেই পারি। মানুষ মানুষের কল্যাণ না করে অকল্যাণ করবে এটা শ্রেষ্ঠ সৃষ্টির বৈশিষ্ট্য হতে পারে না আর এমনটি হলে মানব-জন্ম অনেকটাই অসম্পূর্ণ থেকে যায়।

Advertisement

আজ আমাদের মধ্য থেকে কেন জানি একে অপরের প্রতি মায়া মমতা উঠে যাচ্ছে আর এতটাই নিষ্ঠুর কার্যকলাপ করছি যা মানুষ হিসেবে আমাদের সাজে না। প্রতিদিন কতই না নিষ্ঠুর সংবাদ আমরা পাই। দিনের পর দিন ভয়াবহ নিষ্ঠুরতা আর নারী নির্যাতনের ঘটনা যেন বেড়েই চলেছে। এইতো বছর খানেক আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ভিডিও ভাইরাইল হয়েছিল, ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে মা ও মেয়েকে কোমরে দড়ি বেঁধে মারতে মারতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আর সেই দৃশ্য অবলকন করছেন শত শত গ্রামবাসী। প্রথমে দেখলে মনে হবে তা যেন কোন ছায়াছবির দৃশ্য। চোখের সামনে এমন নিষ্ঠুর ঘটনা ঘটছে আর তা দেখেও শত শত মানুষের চুপ থাকা এটাই প্রমাণ করে বিবেকের যেন মৃত্যু ঘটেছে।

দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিনিয়ত নারীরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। নারীর গায়ে আগুন জ্বালিয়ে হত্যা করার সংবাদও পাওয়া যায়। ফেনীর সোনাগাজির নুসরাত জাহান রাফির নৃশংস হত্যার মর্মন্তুদ ঘটনা দেশের প্রতিটি মানুষের হৃদয় স্পর্শ করেছে ঠিকই কিন্তু এরপরেও নির্যাতনের মাত্রা কমছে না। সুন্দরভাবে বাঁচার কাম্য কার না রয়েছে। সবাই চায় এ সুন্দর পৃথিবীতে বাঁচতে। সবার মত দিল্লির সেই তরুণীটিও চেয়েছিল বাঁচতে কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেও পারলেন না। হায়! সমাজ কতই না নিষ্ঠুর আর কতই না জঘন্য! বছর কয়েক আগে দিল্লিতে চলন্ত বাসে ৬ নরপশুর গণধর্ষণের কবলে পড়ে মেডিকেল ছাত্রির মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা শুধু ভারতকেই নয়, বরং কাঁপিয়ে দিয়েছিল গোটা উপমহাদেশ ও বিশ্ববাসীকে। দিল্লির সেই মেয়েটির সাথে যে ধরনের নৃশংসতা করা হয়েছিল তা হয়তো কোন জঙ্গলী পশুর দ্বারাও সম্ভব হবে না।

শ্রেষ্ঠ জীব মানুষের আজ হয়েছে কি? ধিক, শত ধিক এসব মানুষ রূপধারী অমানুষদের। তাই আমাদেরকে প্রকৃত মানুষ হওয়া অনেক বেশি প্রয়োজন। এসব ঘটনা শুধু দিল্লির নয় বরং আমাদের দেশেও ঘটছে। বছর কয়েক আগে ঢাকায় এক গারো তরুণীর সাথেও তেমনি বর্বরতার ঘটনা ঘটেছিল, যদিও সে প্রাণে বেঁচে যায় তবে ঘটনা কিন্তু দিল্লির ঘটনারই পুনরাবৃত্তি।

Advertisement

নারীকে ধর্ষণ করে তার দেহ টুকরো টুকরো করে ভিন্ন স্থানে ফেলে দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। বর্তমান নারী নির্যাতন মনে হয় একটা সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রতিবেদন অনুযায়ী চলতি বছরের (২০২০) জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ছয় মাসে দেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৬০১ জন নারী ও শিশু। এর মধ্যে একক ধর্ষণের শিকার ৪৬২ জন এবং দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১৩৪ জন।

ধর্ষণের শিকার হওয়াদের মধ্যে ৪০ জনের বয়স ৬ বছর এবং ১০৩ জনের বয়স ১২ বছরের মধ্যে। এ ছাড়া ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৩৭ নারীকে। আর ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন সাতজন নারী। ধর্ষণের চেষ্টা চালানো হয়েছে ১২৬ জন নারীর ওপর। গত ছয় মাসে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন ১০৩ জন নারী। এর মধ্যে যৌন হয়রানরি কারণে আত্মহত্যা করেছেন নয়জন নারী। এ ছাড়া যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করতে গিয়ে একজন নারী এবং আটজন পুরুষ নিহত হয়েছেন।

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, গত ছয় মাসে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন মোট ২৫৩ জন নারী। এর মধ্যে স্বামী ও তার পরিবারের দ্বার হত্যার শিকার হয়েছে ১৬৩ জন নারী। পারিবারিক নির্যাতনের কারণে আত্মহত্যা করেছেন ৪০ নারী। সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর থেকে এপ্রিল মাসে ৩৪ জন এবং মে মাসে ৫৫ জন নির্যাতনের শিকার হন। জুন মাসে ৭০ জন নারী নির্যাতনের শিকার হন যার মধ্যে ২১ জন স্বামী দ্বারা, ৯ জন পরিবারের সদস্য দ্বারা এবং ১০ জন নিজ পরিবারের সদস্য দ্বারা হত্যার শিকার হয়েছেন।

যৌতুককে কেন্দ্র করে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন মোট ৯৪ জন নারী। এর মধ্যে যৌতুকের কারণে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৪২ জন। যৌতুকের জন্য শারীরিক নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে ৩৩ জনকে, যৌতুকের কারণে নির্যাতনের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছেন ১৫ জন নারী। এ ছাড়া স্বামীর গৃহ থেকে বিতাড়িত হয়েছেন ৪ নারী। এ সময়ের মধ্যে ২২ জন গৃহকর্মী বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এবং নিহত হয়েছেন ৪ জন। ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৪ জন। এসিড সন্ত্রাসের শিকার হয়েছেন ১২ জন নারী।

Advertisement

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) কর্তৃক পরিচালিত ২০১১ সালের জরিপ মতে, শতকরা ৮৭ ভাগ নারী স্বামীর মাধ্যমে কোনো না কোনো ধরনের নির্যাতনের শিকার হন। জাতিসংঘের বিশেষ রিপোর্ট মতে, বাংলাদেশে ৬০ শতাংশ বিবাহিত নারী জীবনে কোনো না কোনো সময়ে স্বামী কিংবা তার পরিবার বা উভয়ের দ্বারা নির্যাতিত হন। এছাড়াও বিশ্বজুড়ে প্রতি ১০০ জনে সাতজন নারী কোনো না কোনোভাবে যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, সাত শতাংশ নারী সরাসরি ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন। উন্নত-অনুন্নত সব দেশে নারীর প্রতি সহিংসতার চিত্র আরও অমানবিক।

নারী নির্যাতনের ঘটনা একের পর এক ঘটেই চলেছে। ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিটে কতই না নারী স্বামী কর্তৃক আগুনে পুড়ে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করে। প্রত্যেহ কতই না এমন খবর প্রকাশিত হয় যে, শিশু ধর্ষিত, ধর্ষণের পর হত্যা, গ্রামের পাটের ক্ষেতে, ভূট্টার ক্ষেতে বা ডোবা-নালায় ধর্ষিতা নারীর লাশ, দুই বছরের শিশুকে পা দিয়ে গলায় টিপে ধরে গৃহ বধূকে ধর্ষণ, এ ধরনের খবর সব সময় পাওয়া যায়।

একের পর এক নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেই যাচ্ছে আর অপরাধীরা অনেক ক্ষেত্রে পারও পেয়ে যায়। প্রশ্ন হল আর কতদিন এভাবে নারীরা নির্যাতিত হতে থাকবে? আমরা মনে করি নারী নির্যাতনকারীদেরকে তাৎক্ষণিকভাবে যত দিন আইনের আওতায় না আনা হবে ততদিন সম্ভব নয় নারী নির্যাতন বন্ধ করা। সেই সাথে সকল নারী নির্যাতনকারী অপরাধিদের দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা।

শেষে এটাও বলতে চাই, সমাজের অপরাধ দূর এবং সমাজকে আলোকিত করার লক্ষ্যে আমাদের প্রত্যেক পরিবারকে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদেরকে হতে হবে অনেক বেশি সচেতন। প্রত্যেক পরিবারের সদস্যরা যদি সচেতন হয় তাহলে শুধু নারী নির্যাতনই না বরং সব ধরনের অপরাধ অনেকটাই কমে যাবে। তাই আসুন, নিজে অপরাধ থেকে দূরে থাকি এবং পরিবারের সদস্যদের প্রতি দৃষ্টি রাখি।

এইচআর/জিকেএস