মতামত

খালেদা জিয়ার চিকিৎসা নিয়ে গুজব ও রাজনীতি

দুদিন ধরে লোকজন ইনবক্সে খালেদা জিয়ার মৃত্যুর খবর দিচ্ছে। শিক্ষিত লোকজনও এতে শরিক হয়েছেন দেখলাম। গুজব যেভাবে ছড়ায় এটা তারই অংশ কিন্তু শিক্ষিত লোকজন যখন এতে অংশ নেয় তখন হতাশ হতে হয়। ২৪ নভেম্বর ২০২১ দুপুরে একজন ফোন করলেন। ভাবলাম গুরুত্বপূর্ণ কিছু। বললেন, আমার খুব কাছের কিছু ডাক্তার, এর মধ্যে আওয়ামী লীগ সমর্থকও আছে, তারা এক আড্ডায় জানালো- খালেদা জিয়া মারা গেছেন। সরকার এটা গোপন রেখেছে। দেখছেন না রেড এলার্ট জারি করেছে।

Advertisement

আমি তাকে জানালাম খালেদা জিয়ার মৃত্যু গোপন করার বিষয় নয়। এটা এক্সক্লুসিভ নিউজও নয়। এটা ঘটার ১০ মিনিটের মধ্যে আপনি জাতীয় গণমাধ্যমে জানতে পারবেন। আপনি এসব ছড়িয়ে খামাখা বিপদ ডেকে আনবেন না। তিনি বললেন, তা ঠিক আছে, আপনি সাংবাদিক, তাই তো নিশ্চিত হতে খবরটা শেয়ার করলাম। আর আমরা কিন্তু বুঝি, এরশাদের মৃত্যু সংবাদও অনেক পরে প্রচার করা হয়েছে। আমি স্মরণ করতে পারলাম না, সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের মৃত্যু খবরে এমন কিছু ঘটেছে কিনা।

খালেদা জিয়াকে নিয়ে এ ধরনের গুজবই চলছে কদিন ধরে। গুজব ও বিশৃঙ্খলা ঠেকাতেই যে সতর্ক অবস্থানে পুলিশ সেটাও বোঝা গেল। খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কেউ যাতে গুজব ছড়িয়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করতে না পারে, সেজন্য সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে দেশজুড়ে গোয়েন্দা তৎপরতাও বাড়ানো হয়েছে বলে দাবি করছেন পুলিশ কর্তারা। অবশ্য বিষয়টি নিয়ে পুলিশের কোনো পর্যায় থেকেই আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য দেওয়া হয়নি। নাম প্রকাশ করে কোনো কর্মকর্তা বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে চাননি। এটাও ঠিক যে গুজব রটনাকারীরা বিষয়টি ইনবক্সে বেশি রেখেছেন, আইনের ভয়ে হয়তো প্রকাশ্যে গুজব রটনা থেকে বিরত আছেন।

গুজবের ডালপালাটা আরও বাড়ে যখন গণস্বাস্থ্যকেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মতো লোকরা বেফাঁস কথা বলেন। প্রথম আলোর রিপোর্টে দেখলাম তিনি বলেছেন, ‘আমি গতকাল এভারকেয়ার হাসপাতালে গিয়ে খালেদা জিয়াকে দেখে এসেছি, যা দেখেছি, সাম্প্রতিককালে এত মর্মান্তিক ঘটনা আমি দেখিনি। খালেদা জিয়া কতক্ষণ, কয় দিন, কয় মিনিট বাঁচবেন, তা আমি বলতে পারব না। এটা বলতে পারি, তিনি ক্রান্তিকালে আছেন, তাকে হত্যা করা হচ্ছে।’

Advertisement

খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য সম্পর্কে সঠিক খবর কেউ বলেননি মিডিয়ায়। তথ্যমন্ত্রীর ভাষায় বিএনপি নেতারা সবাই ডাক্তার হয়ে উঠেছেন। বিবিসি বাংলার একটি খবরে নিশ্চিত করা হয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর লিভারের সমস্যা জটিল হওয়ায় মেডিকেল বোর্ড তাকে বিদেশে চিকিৎসার সুপারিশ করেছে। বুধবার তার একজন ব্যক্তিগত চিকিৎসক বিবিসিকে বলেছেন, খালেদা জিয়ার লিভার বা যকৃতের জটিলতার কারণে মেডিকেল বোর্ড বিদেশে চিকিৎসার পরামর্শ দিচ্ছে। মেডিকেল বোর্ডের সদস্য জাহিদ হোসেন বলেছেন, খালেদা জিয়ার আর্থরাইটিস, ডায়াবেটিস, কিডনি এবং হার্টের পুরোনো সমস্যাগুলো রয়েছে।

এখন লিভারের জটিলতাই বড় সমস্যা কিন্তু এখন জটিল হয়েছে লিভারের সমস্যা এবং সেজন্য অন্য সমস্যাগুলোতে ওষুধ সেভাবে কাজ করছে না। হোসেন বলেছেন, লিভারে একটি অপারেশন জরুরি হয়ে পড়েছে, এ ধরনের অপারেশন করার আধুনিক সুবিধা বাংলাদেশে নেই। এই সুবিধা যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যসহ উন্নত দেশগুলোতে আছে। সেজন্য মেডিকেল বোর্ড দ্রুত বিদেশে চিকিৎসার সুপারিশ করেছে।

খালেদা জিয়া ১৩ নভেম্বর ঢাকায় একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর থেকে তাকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে সিসিইউতে রাখা হয়েছে। তাহলে একটি বিষয় পরিষ্কার করেছেন ডাক্তাররা-খালেদা জিয়ার জন্য যে চিকিৎসা দরকার সেটা দেশে নেই তাই যেতে হবে। এর আগে প্রশ্ন ছিল তিনি যেখানে চিকিৎসা নিচ্ছেন সেটি একটি প্রথমসারির হাসপাতাল, বিদেশে চিকিৎসার প্রয়োজনিয়তা দেখা দিল কেন?

আইনের মারপ্যাঁচ অবশ্য এখনও তাকে বাইরে চিকিৎসা নেওয়ার বিরুদ্ধে। সাজাপ্রাপ্ত আসামি হিসেবে তার বিদেশে যাওয়ার সুযোগ সীমিত। এ সংক্রান্ত খালেদা জিয়ার পরিবারের একটি আবেদন ঝুলিয়ে রেখেছে সরকার। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, সরকারের নির্বাহী আদেশে খালেদা জিয়া মুক্ত থাকায় আইন অনুযায়ী বিদেশে চিকিৎসার অনুমতি দেয়ার সুযোগ নেই। তবে তিনি উল্লেখ করেছেন, তারা সার্বিক বিষয় পর্যালোচনা করে দেখছেন।

Advertisement

বিএনপি চিকিৎসার অনুমতির দাবিতে আটদিনের অর্থাৎ ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। বিএনপির অভিযোগ, খালেদা জিয়ার চিকিৎসার সুযোগ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিচ্ছেন না। প্রধানমন্ত্রী অবশ্য গত সপ্তাহে নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছেন। এ ব্যাপারে আইনমন্ত্রীও বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শক্ত অবস্থান বলাটা সঠিক হবে না। তার কারণ হচ্ছে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই কিন্তু নির্দেশ দিয়ে উনাকে (খালেদা জিয়া) মানবিক কারণে সাজা স্থগিত করে জেল থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন।

এটা পরিষ্কার যে বিদেশে চিকিৎসা নেওয়ার আইনগত বাধা দূর করার জন্য সরকারের আশীর্বাদ ছাড়া এখন বিএনপির কোনো উপায় নেই। কিন্তু সে আশীর্বাদ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বিএনপি রাজনীতিতে আছে। খালেদা জিয়ার সাজা বাতিল করে তাকে মুক্তি দিয়ে বিদেশে উন্নত চিকিৎসা গ্রহণের আদেশ দিতে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের কাছে আবেদন করেছেন বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের একাংশ।

২২ নভেম্বর পাঠানো আবেদনে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রপতি হিসেবে সাবেক একজন প্রধানমন্ত্রীকে নিঃশর্ত মুক্তি দিয়ে বিদেশে উন্নত চিকিৎসা গ্রহণের আদেশ দেওয়ার ক্ষমতা আপনার আছে। যে ক্ষমতা সংবিধান আপনাকে দিয়েছে। দেশের একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর জীবন রক্ষায় সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদ প্রয়োগ করে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সাজা বাতিল করে, বিদেশে গিয়ে উন্নত চিকিৎসা গ্রহণ করে বাঁচার সুযোগ দিন।’

এ ধরনের আবেদন যে রাজনৈতিক ধোঁকাবাজি তাতে সন্দেহ নেই কারও। খালেদা জিয়ার চিকিৎসার জন্য সত্যি সত্যি যদি বিদেশ যাওয়ার প্রয়োজন হয় তাহলে আইনজীবী কেন, তিনি নিজেই ক্ষমা প্রার্থনা করতে পারেন। জীবনের চেয়ে রাজনীতি যদি বড় হয় তাহলে বলবো খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক মৃত্যু অনেক আগেই হয়ে গেছে, যখন তাকে জেলে নেওয়া হয়েছে এবং বিএনপি এর বিরুদ্ধে কিছুই করার ক্ষমতা ছিল না।

বিএনপির এখানে ক্যাশ করার আর কিছু নেই। বিএনপি যদি খালেদা জিয়ার চিকিৎসা নিয়ে রাজনীতি করে তাহলে পরিণতি খালেদা জিয়াকেই ভোগ করতে হচ্ছে। সরকারকে দোষারোপ করা যেত যদি রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনার পরও বেগম জিয়াকে চিকিৎসার সুযোগ দেওয়া না হতো। আশা করছি চিকিৎসা নিয়ে রাজনীতি বিএনপি এবং সরকার দুপক্ষই বন্ধ রাখবে এবং চিকিৎসা নেওয়ার অধিকার থেকে খালেদা জিয়া বঞ্চিত হবেন না। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সুস্বাস্থ্য কামনা করছি।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট। ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত। anisalamgir@gmail.com

এইচআর/এএসএম