নূহ নবীর নৌকার মতো আওয়ামী লীগের নৌকা মানুষের বিপদে এগিয়ে এসেছে বলে বরাবরের গর্ব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনী প্রচারণায় তিনি সাধারণত এ উচ্চারণটি বেশি করে থাকেন। তার ভাষায়, একমাত্র নৌকাই পারে দেশের উন্নয়ন করতে। ইতিহাস বলে, এই নৌকা কেবল আওয়ামী লীগের প্রতীক নয়।
Advertisement
মানুষের-আস্থা-ভরসার স্বাধীনতার প্রতীকও। মুক্তিযুদ্ধ, মানুষের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক- সামাজিক মুক্তির প্রতীক। আবশেষে ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রতীকও। কিন্তু, এবার ইউপি নির্বাচনকে ঘিরে নৌকাকে কেবল নাজেহাল নয়, কলঙ্কিতও করে ছাড়ছে এর নানা কিছিমের কাণ্ডারিরা। অথচ কোনো বিতর্কিত, দাগী সন্ত্রাসীকে বঙ্গবন্ধুর নৌকা দেয়া হবে না বলে ছিল কড়া দলীয় অঙ্গীকার।
ইউপি নির্বাচনের বিভিন্ন ধাপেই সন্ত্রাসী, মাদক কারবারী, বীর মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়ে রাজাকার পরিবারের সদস্য, হত্যা-ধর্ষন মামলার আসামিসহ চিহ্নিত-বিতর্কিতদের দাপট। আওয়ামী লীগের দপ্তরে এ বিষয়ক অভিযোগের স্তুপের কথা জানিয়েছেন দলের সাধারণ সম্পাদকও। কেন্দ্র থেকে দায়ী করা হচ্ছে এমপি, জেলা-উপজেলা নেতাদেরকে। তারা দূষছেন কেন্দ্রকে। টাকা-পয়সা দিয়ে ঢাকা থেকে নৌকার নমিনেশন বাগানোর অভিযোগ তাদের।
পাল্টাপাল্টি এ অভিযোগের মাঝে দেয়া হচ্ছে হুমকি-ধামকি। সহ্য না করার হুঁশিয়ারি। এর মধ্য দিয়ে যা হবার সেটা হয়ে চলছে। খুনাখুনি চলছে সমানে। নিজেরাই নিজেদের প্রতিপক্ষ। নৌকায়-নৌকায় রক্তারক্তি। প্রাণহানির শিকারদের প্রায় সবাই নিজেরাই। নির্বাচন কমিশন সচিব বলেছেন, নির্বাচন ভালো হচ্ছে। সামনে আরো ভালো হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মতে, ইউপি নির্বাচনে এমন ঝগড়াঝাটি হয়েই থাকে।
Advertisement
ডজনে-ডজনে লাশ পড়ার নাম ঝগড়াঝাটি? হার-জিতও নিজেদের মধ্যে। তবে, জনগণের ওপর দায় চাপানোর একটা সুক্ষ চেষ্টা লক্ষণীয়। বলা হচ্ছে, জনগণ সচেতন হলে এমনটি হতো না। দোষ বিএনপির ওপর চাপানোর চেষ্টাও আছে। বলার চেষ্টা করা হচ্ছে- তারা নির্বাচনে এলে এমনটি হতো না। আস্তবে ক্ষমতাসীন দলের নমিনিশন পাওয়াই নির্বাচন। ভোটের দরকার নেই। জনগণের কাছে যাওয়ার পর্বই ‘নাই’ হয়ে যাচ্ছে।
ভোটের বদলে বন্দুক, চাপাতি, কিরিচ, দা-বঁটি, লাঠি-সোটায় জেতার মানসিকতা নৌকাকে কেবল কলঙ্কিতই করছে না। একটি ভয়ের প্রতীকও করে ছাড়ছে। দল থেকে হিম্মতওয়ালা -বাহাদুর খোঁজার সংস্কৃতি চালু হয়েছে। হিম্মতের প্রমাণ দিতে গিয়ে তারা প্রতিপক্ষের কান কেটে ফেলছে। হাত-পায়ের রগ কেটে পুকুরে ছুঁড়ে ফেলছে। এর মাঝে আস্ত মেরে ফেলার কিছু ঘটনা তো ঘটছেই।
হতাহতের সমান্তরালে ‘নৌকায় ভোট না দিলে কবরেও জায়গা হবে না, নৌকায় ভোট না দিলে কেন্দ্রে আসা নিষেধ-এ ধরনের প্রকাশ্য হুকুমের ভিডিও ফুটেজও ভাসছে সামাজিক মাধ্যমে। এর জেরে কোথাও কোথাও নৌকার প্রার্থীর চরম ভরাডুবি ঘটছে বা ঘটানো হচ্ছে। নৌকার এমন হেনস্তা পীড়া দিচ্ছে দলের ত্যাগী নেতাদের। নৌকা বিদ্বেষীদের কাছে এটি বিকৃত আনন্দের। এক সময় এরা নৌকা প্রতীকে আগুন দিতো। এখন আওয়ামী লীগের আগুনেই জ্বলছে ভালোবাসার নৌকা। নৌকার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ, আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নৌকার এ জ্বালাও পোড়াও।
কেউ কেউ বলতে চান, বিজয়ীরা নৌকারই লোক। আবার এ কথাও সত্য জয়ীরা নৌকা ডুবিয়েই জিতেছেন। নৌকার সর্বনাশকারীরা নৌকার হন কিভাবে? তাদের 'নৌকার লোক' বলে চালিয়ে বাস্তবতা এড়িয়ে যাওয়া ছাড়া আর কিছু নয়। ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে তদানীন্তন আওয়ামী লীগ নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে যে ভূমিধ্বস বিজয় অর্জন করেছিল, তখন থেকেই এ দেশের মানুষের কাছে 'আওয়ামী লীগ' আর 'নৌকা' প্রায় সমার্থক হয়ে গেছে। সেই নৌকার আজকের এ গুরুচরণ অবস্থা কেবলই সরকারি দলের অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহের ফল, নাকি আগে-পিছে আরো কিছু আছে? সময়ের সঙ্গে নৌকার উজানে ভাটার টান ফেলার কোনো কারসাজি নেই তো?
Advertisement
সাধারণ বুঝজ্ঞানের যে কেউ বুঝতে পারছেন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ঘাড়ে ভর করে গত দেড় দশকে ধরিবাজদের শাখা-প্রশাখা প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে। দলের হার্ডকোরে ঢোকার লিপ্সায় এরা জাতীয়, স্থানীয়, এমনকি পেশাজীবী সংগঠনের নেতৃত্বেও জায়গা নিচ্ছে। ইউপি নির্বাচন এর একটা শো-ডাউন মাত্র। সেটা নৌকা কেন আওয়ামী লীগের সর্বনাশ করে হলেও। এরা এরইমাঝে বিভিন্ন এলাকায় নৌকাকে ভীতির প্রতীক প্রমাণের কাজে সফল হয়ে গেছে। সামনে আরো কী করবে- অপেক্ষা করে দেখার বিষয়।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।
এইচআর/জেআইএম