মতামত

ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় হোক জ্ঞান চর্চার বাতিঘর

অধ্যক্ষ মো.শাহজাহান আলম সাজু

Advertisement

গতকাল ২২ নভেম্বর ছিল ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৪তম জন্মদিন। বাংলাদেশের অন্যতম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কুষ্টিয়া। ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে প্রথম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৭৯ সালে কুষ্টিয়া ও ঝিনাইদহ জেলার মধ্যবর্তী স্থান শান্তিডাঙা-দুলালপুরে বিশ্ববিদ্যালয়টি যাত্রা শুরু করে। বিশ্ববিদ্যালয়টির স্থান নির্বাচনকে কেন্দ্র করে শুরু থেকেই দেশের আলেম ওলামা ও মাদরাসা শিক্ষার্থীরা রাজধানীর কাছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন। ১৯৮১ সালে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এরশাদ সরকার ঢাকার কাছে গাজীপুরের বোর্ডবাজারে (বর্তমান জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস) ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়টি স্থানান্তর করে।

১৯৮৫- ৮৬ শিক্ষাবর্ষে চারটি ডিপার্টমেন্ট (হিসাববিজ্ঞান, ব্যবস্থাপনা, আল কোরআন ও তাওহিদ) নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টি যাত্রা শুরু করে। আমার পরম সৌভাগ্য আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ব্যাচের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র ছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রশাসন শুরু থেকেই অদ্ভুত সব নিয়ম-কানুন চালু করে।

যেমন- ছাত্রী ও অমুসলিম শিক্ষার্থীদের ভর্তি না করা, আল কোরআন ও তাওহিদ বিভাগে নিধারিত শতভাগ আসনে মাদরাসার শিক্ষার্থীদের ভর্তি করা, হিসাববিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগে নির্ধারিত আসনের ৫০ শতাংশ কলেজ শিক্ষার্থী এবং বাকি ৫০ শতাংশ মাদরাসা শিক্ষার্থীর কোঠা নির্ধারণ, আবাসিক হলে এশার নামাজের সময় রোল কল করা, হিসাববিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের ১০০ নম্বরের আরবি পড়া বাধ্যতামূলক করা, বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো অনুষ্ঠানে হাতে তালি দেওয়ার পরিবর্তে আরবিতে ‘মারহাবা’ এবং স্বাগতম শুভেচ্ছার পরিবর্তে আরবিতে ‘আহলান ওয়া সাহলান’ বলা, বিশেষ কোনো অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের পাজামা-পাঞ্জাবি পরিধান, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি করা যাবে না মর্মে ভর্তি ফরমের সাথে বন্ড নেওয়া ইত্যাদি। নামে বিশ্ববিদ্যালয় হলেও শুরু থেকেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ছত্রচ্ছায়ায় একটি মহল বিশ্ববিদ্যালয়টিকে একটি বড় মাদরাসা হিসেবেই গড় তোলার অপচেষ্টা চালিয়ে আসছিল।

Advertisement

ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের স্বাধীনতাবিরোধী নগ্ন চরিত্র প্রকাশ পায় মূলত ১৯৮৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস পালনকে কেন্দ্র করে। আমরা কয়েকজন ছাত্র ১৫ ডিসেম্বর সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদনে একটি বাসের ব্যবস্থার জন্য ভিসি স্যারের কাছে আবেদন করলে তিনি আমাদের সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন। তিনি স্মৃতিসৌধে ফুল দেওয়া নাজায়েজ বলে ফতোয়া দেন এবং আমরা যারা স্মৃতিসৌধে যাওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিলাম তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দেন।

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বাসের ব্যবস্থা না করলেও আমরা ২৫-৩০ জন শিক্ষার্থী নিজেরা চাঁদা উঠিয়ে একটি ট্রাকভাড়া করে সাভার স্মৃতিসৌধে গিয়ে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করি। এর কিছুদিন পর ২১ ফেব্রুুয়ারি শহীদ দিবস সামনে রেখে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে ক্যাম্পাসে একটি শহীদ মিনার নির্মাণের দাবি জানালে ভিসি স্যার আমাদের ডেকে নিয়ে কঠিন ভাষায় ভর্ৎসনা করেন। তিনি সুস্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেন, কোনো ভাবেই ক্যাম্পাসে শহীদ মিনার নির্মাণ করা যাবে না। এটা অনৈসলামিক। এ ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করা হলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হবে বলে হুমকি দেন।

আমরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ক্যাম্পাসে শহীদ মিনার নির্মাণ করি। সে অনেক লম্বা ইতিহাস (এ বিষয়ে আমার একাধিক প্রবন্ধ জাতীয় বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে)। ১৯৮৭ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষাসৈনিক গাজিউল হক শহীদ মিনার উদ্বোধন করেছিলেন। ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নির্দেশ অমান্য করে ক্যাম্পাসে শহীদ মিনার নির্মাণের অভিযোগে ২০ জন ছাত্রকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়। ওই বহিষ্কারের বিরুদ্ধে সারাদেশে আন্দোলন গড়ে উঠলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বহিষ্কারদেশ স্থাগিত রাখতে বাধ্য হলেও পরে শহীদ মিনার নির্মাণের সাথে জড়িত ১২ জনের প্রমোশন স্থাগিত করে। ফলে আমাদের ১২ জনের জীবন থেকে একটি বছর হারিয়ে যায়।

১৯৯০ সালে এরশাদ সরকারের সিদ্ধান্তেই ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় কুষ্টিয়ায় পূর্বতন ক্যাম্পাসে স্থানান্তর করা হয়। ওই স্থানান্তরের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী ব্যাপক আন্দোলন গড়ে ওঠে। একপর্যায়ে আমি ও ছাত্রদলের সভাপতি আশরাফসহ কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়।

Advertisement

ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় কুষ্টিয়ায় স্থানান্তরের পর কুষ্টিয়া শহরে পিটিআই ক্যাম্পাস, ম্যাটস ক্যাম্পাসসহ শহরের বিভিন্ন স্থানে ক্যাম্পাসে কার্যক্রম চলতে থাকে। কুষ্টিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থানান্তরের পর তৎকালীন উপাচার্য দেশের প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ প্রফেসর ড. সিরাজুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়টি মাদরাসার গণ্ডি থেকে বের করে প্রকৃত অর্থে একটি আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করার উদ্যোগ নেন। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম আমাকে নিজ সন্তানের মতো দেখতেন। তার এ উদ্যোগে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ভ্যানগার্ডের মতো সহযোগিতা করেছে।

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম আমাদের দাবি অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রী ও অমুসলিম শিক্ষার্থীদের ভর্তি, বাংলা, ইংরেজি, লোকপ্রশাসনসহ আধুনিক ডিপার্টমেন্ট চালু করেন এবং প্রগতিশীল শিক্ষকদের নিয়োগ দেন। চরম দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি সেদিন ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক অপশক্তি একটি ছাত্র সংগঠন ও একটি প্রগতিশীল দাবিদার ছাত্র সংগঠনও যৌথভাবে এর বিরোধিতা করে। তারা ভর্তি বিজ্ঞপ্তি বাতিলের দাবিতে ভিসি অফিস ঘেরাও করে অন্যদিকে ছাত্রলীগসহ প্রগতিশীল সংগঠন গুলিভর্তি বিজ্ঞপ্তি বহাল রাখার দাবিতে পাল্টা ঘেরাও কর্মসূচি দিলে সেখানে সংঘর্ষ বাধে। এতে কয়েকজন আহত হন।

ভর্তিবিরোধীদের মামলায় আমি, আলমগীরসহ (বর্তমান ইবির উপ-রেজিস্ট্রার) স্থানীয় দুই ছাত্রনেতার ছয় মাসের কারাদণ্ড হয়েছিল। সেদিন আমরা ছাত্রী, অমুসলিম শিক্ষার্থীদের ভর্তি এবং বালা, ইংরেজি ও লোকপ্রশাসসহ আধুনিক বিভাগসমূহ চালু করতে সক্ষম হলেও এর কিছুদিন পরই আধুনিক ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের জনক দেশের বরেণ্য শিক্ষাবিধ অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলামকে সরকার সরিয়ে দেয়।

সময়ের বিবর্তনে ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক অপশক্তি সব ষড়যন্ত্র ধূলিস্যাৎ করে ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় আজ স্বমহিমায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। আজ ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় সব ধর্ম, বর্ণ এবং বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তিসহ বিশ্বের যুগোপযোগী আধুনিক বিভাগসমূহ চালু রয়েছে। ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ে আজ বহু সংখ্যক বিদেশি শিক্ষার্থীসহ হিন্দু্, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানসহ সব ধর্ম ও বর্ণের ছাত্রছাত্রীদের পদচারণায় মুখরিত। বিশ্ববিদ্যালয়টি আজ মুক্ত জ্ঞান চর্চার তীর্থ ভূমিতে পরিণত হয়েছে।

বিশেষ করে বর্তমান সরকারের গত ১২ বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা বরাদ্দে আধুনিক ও নান্দনিক স্থাপত্য শিল্পে নির্মিত বড় বড় অট্টালিকা ও নৈসর্গিক গাছপালায় আচ্ছাদিত ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস আজ যে কারও মন হরণ করবে।

ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবি ডিগ্রিধারীরা আজ ঈর্ষনীয় সাফল্য অর্জন করছেন। তারা রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োজিত থেকে দেশ এবং জাতির জন্য অনন্য অবদান রেখে চলেছেন। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আজ বহির্বিশ্বেও ইবিয়ানরা মর্যাদাপূর্ণ বিভিন্ন পেশার সঙ্গে যুক্ত থেকে দেশের জন্য সুনাম বয়ে আনার পাশাপাশি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অবদাব রেখে চলেছেন। শিল্পদ্যোক্তা ও সৃজনশীল বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমেও ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারীরা আজ দেশের বেকারত্ব নিরসন ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক অবদান রেখে চলেছেন।

ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় হোক জ্ঞান চর্চার বাতিঘর। বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৩তম জন্মদিনের সব ইবিয়ান এবং বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সবাইকে অফুরান শুভেচ্ছা ও শুভকামনা।

লেখক: সিন্ডিকেট সদস্য, ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়, প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ইবি ছাত্রলীগ ও ইবি প্রেস ক্লাব ও ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন, সচিব বেসরকারি শিক্ষক কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্ট-শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

এইচআর/এমএস