মতামত

খালেদা জিয়ার অসুস্থতা এবং তারেক রহমানের দেশে ফেরা না-ফেরা

রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা বিশেষ ভালো না। ১৩ নভেম্বর তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ১৮ নভেম্বর দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, বেগম জিয়া ‘জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে’। তার যারা চিকিৎসা করছেন তারা কেউ অবশ্য স্পষ্ট করে বলেননি যে বিএনপি নেত্রী আসলে কি অবস্থায় আছেন। তবে বিএনপির পক্ষ থেকে তার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর দাবি জানানো হয়েছে। কি কারণে তাকে বিদেশে যেতে হবে, বিদেশে গেলে তিনি সত্যি সুস্থ হয়ে উঠবেন – এটা কি হাসপাতালে যারা তাকে চিকিৎসা দিচ্ছেন, তাদের অভিমত?

Advertisement

এসব বিষয় স্পষ্ট করে না বলে বিএনপির পক্ষ থেকে রাজনৈতিক বক্তব্য এবং সরকার পতনের আন্দোলনের কথা বলায় চিকিৎসা এবং রাজনীতি একাকার হয়ে একটি ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। বিভিন্ন সূত্রের বরাত দিয়ে গণমাধ্যমে খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে যেসব খবর বের হচ্ছে, তাতে এটা মনে হয়, যে কোনো সময় যে কোনো কিছু ঘটতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে খালেদা জিয়ার বড় ছেলে ও বিএনপির ভারপ্রাপ্তের চেয়ারম্যান তারেক রহমান দেশে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলেও শোনা যাচ্ছে। সাজাপ্রাপ্ত তারেক পলাতক অবস্থায় এখন লন্ডনে অবস্থান করছেন।

‘খালেদা জিয়াকে যে বাসায় থাকতে এবং চিকিৎসা করার সুযোগ দিয়েছি সেটাই কি বেশি নয়? খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে দেয়া হবে কিনা- তা আইনগতভাবেই সিদ্ধান্ত নেয়া হবে’।- প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এমন বক্তব্যের পর এটা কেউ মনে করছেন না যে খালেদা জিয়াকে বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হবে। প্রশ্ন হলো, মাকে দেখতে লন্ডন প্রবাসী তারেক রহমান কি বাংলাদেশে ফিরতে পারবেন? তাকে দেশে ফিরতে হলে কি ধরনের আইনি বাধার মুখে পড়তে হতে পারে সে বিষয়ে ভোরের কাগজে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে ২২ নভেম্বর। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে , তারেক রহমানের দেশে আসার প্রক্রিয়া সহজ নয়। তিনি ‘নো ভিসার’ জন্য আবেদন করেছেন কিনা, দেশে ফেরার জন্য বিমানের টিকিট কেটেছেন কিনা? এ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। যদি তা না করেন তবে, হালনাগাদ বাংলাদেশি পাসপোর্ট না থাকায় তাকে লন্ডন থেকে দেশে ফিরতে দ্রুত ট্রাভেল ডকুমেন্ট অথবা ব্রিটিশ পাসপোর্টের ক্ষেত্রে লন্ডনস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনে ‘নো ভিসা রিকোয়ার্ড’ সিলমোহরের জন্য আবেদন করতে হবে। কিন্তু এ ব্যাপারে তারেক রহমানের পক্ষ থেকে লন্ডনের বাংলাদেশ হাইকমিশনে গত রোববার পর্যন্ত আবেদন করা হয়নি।

ব্রিটিশ মানবাধিকারবিষয়ক আইনজীবী ব্যারিস্টার মনোয়ার হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, মাকে দেখা না দেখা পরের কথা। তিনি আসামি হলে অবশ্যই এয়ারপোর্টেই গ্রেপ্তার হবেন। এমন পরিস্থিতিতে এটা অত্যন্ত কঠিন প্রশ্ন, আদৌ তিনি দেশে যেতে পারবেন কিনা, বা যেতে চান কিনা। কারণ, এটা তার জন্য নিরাপদ না। তবে খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর নির্বাহী ক্ষমতার পাশাপাশি আদালতে সিদ্ধান্ত দেয়ার এখতিয়ার রয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।

Advertisement

পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম বলেছেন, ২০০৮ সালে তিনি ব্রিটিশ অফিসে তার পাসপোর্টসহ সব কাগজপত্র জমা দিয়েছেন। তাকে দেশে আসতে হলে নতুন করে আবেদন করতে হবে। তবে আমি যতটুকু জানি, আইনের দৃষ্টিতে তিনি একজন দণ্ডিত আসামি। তার নামে হুলিয়া জারি হয়েছে। তাই তাকে আইনি প্রক্রিয়াতেই দেশে ফিরতে হবে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত এক যুগ ধরে যুক্তরাজ্যের লন্ডনে অবস্থানরত তারেক রহমান দেশে ফিরে রাজনীতি করতে চান বলে গত কয়েক বছর ধরেই জানিয়ে আসছেন বিএনপির সিনিয়র নেতারা। তবে তার দেশে ফেরার পথে প্রধান বাধা সরকার। লন্ডনে অবস্থানরত তারেক রহমান তার পাসপোর্ট নবায়ন করতে দিলেও বাংলাদেশ হাইকমিশন তার পাসপোর্ট নবায়ন করেনি।

দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দেশে ফিরতে চান জানিয়ে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান চান দেশে ফিরতে। কিন্তু দেশে আসতে চাইলে প্রথমেই দরকার পাসপোর্ট। পাসপোর্টের জন্য আবেদন করলেও সরকারের নির্দেশনা না থাকায় যুক্তরাজ্যের বাংলাদেশ হাইকমিশন তার পাসপোর্ট দিচ্ছে না। একটা দলের প্রধান পাসপোর্ট ছাড়া তো কোনোভাবেই দেশে ফিরতে পারবেন না।

অন্যদিকে, যে কোনো পরিস্থিতিতে তারেক রহমান দেশে ফিরতে প্রস্তত বলে জানিয়েছেন বিএনপির যুক্তরাজ্য শাখার সভাপতি। আইনি জটিলতায় অসুস্থ মাকে দেখতে তারেক রহমানের দেশে আসা নিয়ে নানা জটিলতা থাকলেও তার স্ত্রী এবং কন্যার আসতে বাধা নেই বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা। কারণ, তারেকের স্ত্রী জোবায়দা রহমান গত দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে খালেদা জিয়ার মেডিকেল টিমের প্রধান হিসেবে লন্ডন থেকে চিকিৎসার ব্যাপারে মনিটরিং করছেন। সে হিসেবে অসুস্থ খালেদা জিয়ার সেবা করতে তিনি যদি দেশে আসতে চান সে ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে বাধা দেয়ার সুযোগ নেই। এ ব্যাপারেও ব্রিটিশ মানবাধিকারবিষয়ক আইনজীবী ব্যারিস্টার মনোয়ার হোসেন বলেছেন, তারেকের পরিবার অবশ্যই আসতে পারে, সেখানে কোনো বাধা থাকবে না। তবে এখন পর্যন্ত জোবায়দা রহমান এবং জায়মা রহমান খালেদা জিয়াকে দেখতে আসার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন এমন খবর পাওয়া যায়নি।

Advertisement

দীর্ঘ ১৪ বছর ধরে তারেক রহমান লন্ডনে অবস্থান করছেন। অনেক দিন ধরেই মা খালেদা জিয়া অসুস্থ। কিন্তু তারপরও এতদিন কেন তিনি মাকে দেখতে আসার ব্যাপারে আগ্রহ দেখাননি তা নিয়েও চলছে আলোচনা। বিশ্লেষকরা বলছেন, জিয়াউর রহমান যখন মারা যান তখন তারেক রহমান এবং আরাফাত রহমান কোকো খুব ছোট ছিলেন। খালেদা জিয়া একা স্নেহ-মমতা দিয়ে দুই ছেলেকে বড় করেছেন। এখন তিনি যখন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে; তখন ছেলে হয়ে তারেক রহমান গ্রেপ্তার হয়ে জেলে যাওয়ার ভয়ে মাকে দেখতে আসেননি। এতেই বোঝা যায়, তারেক রহমান মায়ের প্রতি কতটা উদাসীন। তিনি রাজনীতি নাকি মাকে ভালোবাসেন এখন তা দেখার সময় এসেছে। এটা তার জন্য মায়ের প্রতি ভালোবাসার বড় পরীক্ষা।

একদিকে তারেক রহমান মাকে দেখতে দেশে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছেন এমন খবর পাওয়া যাচ্ছে। অন্যদিকে আন্দোলনের মাধ্যমে খালেদা জিয়াকে বিদেশ নেয়ার দাবি আদায়ে মাঠে নেমেছে বিএনপি। বিএনপি বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে। সারাদেশে বিক্ষোভ করবে দলটি। সরকার শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালনে বাধা দেবে না বলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানিয়েছেন। কিন্তু পরিস্থিতি অস্বাভাবিক হলে সরকার বরদাশত করবে না, সেটাও জানিয়ে রেখেছেন।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ২২ নভেম্বর বলেছেন, বিএনপির আন্দোলনের হুমকিকে আওয়ামী লীগ ভয় পায় না। বিএনপির অনেক আন্দোলন-হুমকি গত কয়েক বছরে মোকাবিলা করে এসেছে আওয়ামী লীগ। বিএনপি আন্দোলনের হুংকার না দিয়ে খালেদা জিয়ার চিকিৎসার বিষয়টি নিয়ে আলোচনায় বসার চেষ্টা করলে ভালো করতো বলে অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকই মনে করেন। বিএনপির দাবি মানার মতো মানসিক অবস্থা যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেই – সেটা তিনি একাধিকবার স্পষ্ট করেছেন। আবার দাবি আদায়ে বিএনপির অক্ষমতাও কারো অজানা নয়।

ভোরের কাগজের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিএনপি নেতাদের ধারণা, এটি তারেক জিয়ার দেশে ফেরার উপযুক্ত সময়। এই রকম সময় যদি তারেক রহমান দেশে ফিরে আসে তাহলে লাভবান হবে বিএনপি। এর ফলে জনগণের মধ্যে একটি ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া হবে। এছাড়া খালেদা জিয়ার যদি কিছু হয় এবং সে সময় যদি তারেক দেশে ফেরেন তাহলে খালেদা জিয়ার শেষ পরিণতি নিয়ে যে আবেগ সেই আবেগের সঙ্গে তারেকের দেশে ফেরা যুক্ত হলে একটি বড় ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হবে এবং এটিতে সরকার চাপের মধ্যে পড়বে।

অন্যদিকে ক্ষতির বিষয়টিও বিবেচনায় রয়েছে বিএনপি নেতাদের। কারণ, দুটি মামলায় তারেক রহমান দণ্ডিত আছেন। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়ছে। অন্য একটি মামলায় তার সাত বছরের দণ্ড দিয়েছেন আদালত। এই দুটি মামলাতেই তার আপিল করার নির্দিষ্ট সময়সীমা শেষ। তিনি যদি দেশে ফিরে গ্রেপ্তার হন তাহলে বিএনপির নিঃশেষ হওয়ার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত হবে। আর এ বিবেচনা থেকেই বিএনপি নেতাদের ওই অংশ তারেক রহমানের দেশে ফেরার বিপক্ষে।

তবে এটাও ঠিক যে, সরকার এবং আওয়ামী লীগও নিশ্চেষ্ট বসে আছে বা কোনো ভাবনাচিন্তা করছে না তা নয়। যেকোনো সংকটপূর্ণ পরিস্থিতি মোকাবিলায় শেখ হাসিনার দক্ষতার প্রমাণ বহুবার পাওয়া গেছে। দেশে এবং বিদেশে যাদের সমর্থন ও পরামর্শ অতীতে বিএনপি ভরসা জোগাতো তারা এখন খুব শক্ত অবস্থানে আছে বলে মনে হয় না। বৈশ্বিক রাজনীতির হাওয়া এখন বিএনপির অনুকূলে বলে মনে হয় না। তাই হুট করে বড় কোনো ওলট-পালট ঘটে যাওয়ার আশা করে হতাশ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। বিএনপিকে বাস্তবতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার রাজনীতির সঙ্গ অভ্যস্ত হতে হবে। আকাশ কুসম চয়ন না করাই ভালো।

লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক। সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা।

এইচআর/জেআইএম