বিশেষ প্রতিবেদন

চিকিৎসকের পরামর্শে মাল্টাচাষ, লাখ টাকা খরচে আসছে কোটি টাকা

২০১৯ সালে হার্টে পাঁচটি ব্লক ধরা পড়ে স্কুলশিক্ষক মো. কাজিম উদ্দিনের। ঢাকায় এসে রিং পরান তিনটি। যে চিকিৎসকের অধীনে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন, তিনি পরামর্শ দেন গাছ-গাছালি প্রকৃতি নিয়ে ব্যস্ত থাকতে। নিজের বেশকিছু জমিও ছিল। ঝোঁক হলো বাগান করার। নিজের ৬৫ শতক জমিতে শুরু করলেন মাল্টার বাগান। চারা কিনলেন ২৩০টি। খরচ হলো এক লাখ টাকা। করোনাকালে বছর দুই পেরুতেই গাছে ফল এলো। বিক্রি করলেন তিন হাজার কেজি। লাভ হলো দুই লাখ টাকার মতো। এ বছর ফল ও চারা বিক্রি থেকে কোটি টাকা আয় হবে বলে আশাবাদী তিনি।

Advertisement

কাজিম উদ্দিন বলছিলেন, ‘প্রতিটি ২৫০ টাকা করে আমি ২৩০টি চারা কিনি। এগুলো ভিয়েতনামি মাল্টার চারা। এ মাল্টার বিশেষ দিক হলো সারাবছরই ফল থাকে। প্রথম ধাপে আমি তিন লাখ টাকার মাল্টা বিক্রি করেছি। দ্বিতীয় ধাপে এত না হলেও কাছাকাছি হবে। এই মাল্টা কেজিতে সর্বোচ্চ তিনটি হয়। দুটোতেও কেজি হয়ে যায়। এ বছর পাইকারিতে ১০০-১২০ টাকা বিক্রি করেছি। তবে সবচেয়ে লাভজনক হলো চারা বিক্রি। চারার পর্যাপ্ত চাহিদা রয়েছে। চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত যদি এক লাখ চারা বিক্রি করতে পারি, তাহলে সব খরচ বাদ দিয়ে এক কোটি টাকার মতো লাভ থাকবে।’

ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার রাঙামাটি ইউনিয়নের পাহাড় অনন্তপুর গ্রামের বাবুগঞ্জ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ইংরেজির শিক্ষক কাজিম উদ্দিন। চিকিৎসকের বাগান করার পরামর্শে কৃষি পেশায় যুক্ত হয়ে এখন লাখপতি। আশা করছেন খুব শিগগির কোটিপতি হয়ে উঠবেন।

তার বাগানে গিয়ে দেখা গেলো বেশ পরিপাটি। একজন নিপাট ভদ্রলোক শিক্ষকের মতো তার বাগানটিও সাজানো। রুচিবোধ পরতে পরতে। মাত্র দুই বছরে তিনি এলাকার কৃষকদের কাছে ‘আইডল’ বনে গেছেন। বিশেষ করে মাল্টাচাষে। তার বাগানে কয়েক জাতের লেবুও রয়েছে। রপ্তানিযোগ্য কলম্ব লেবু, সিডলেস লেবুর রয়েছে কয়েক বিঘার বাগান।

Advertisement

শিক্ষিত এই চাষি বলেন, ‘একটি সুন্দর স্বপ্ন মানুষকে কীভাবে এগিয়ে নিতে পারে সেটার বাস্তব প্রমাণ আমি। বর্তমানে বৈশ্বিক সমস্যা করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯), সেদিকে লক্ষ্য রেখেই আমি লেবুজাতীয় ফলচাষের দিকে ঝুঁকি এবং কমলা-মাল্টার চারা সংগ্রহ করি। শুরু করেছি আমি এবং আমার শ্যালক মিলে। আমাদের এখানকার কৃষি অধিদপ্তরও সহায়তা করে। সরকারি কিছু সহযোগিতাও পেয়েছি। এটা ভিয়েতনামের বারোমাসি মাল্টা। অন্য যে কোনো জাতের তুলনায় এটার ফলন বেশি। ঠিকমতো পরিচর্যা করতে পারলে একটি বড় গাছে তিন থেকে চার মণ ফল আসে।’

‘আমি চারা সংগ্রহ করি এই ইউনিয়নের প্রিন্স নামে একজনের কাছ থেকে। তিনি ভিয়েতনাম থেকে নিয়ে এসেছিলেন। ২৫০টি চারার ২৩০টি টিকে আছে। তিন হাজার কেজি মাল্টা পাইকারি বিক্রি করেছি ময়মনসিংহের বিভিন্ন বাজারে। ৬৫ শতক জমিতে এক বছরে পাঁচ লাখ টাকা আয় করা সম্ভব শুধু ফল থেকে। আমি আরও ৬০০ শতক জমিতে আবাদ করবো’—বলেন কাজিম উদ্দিন।

এই শিক্ষকের ফার্মের নাম গ্রিন অ্যাগ্রো। এই ফার্মের সংগ্রহে আছে বারি-১ মাল্টা, রঙিন মাল্টা, দার্জিলিং কমলা, ম্যান্ডারিন কমলা, পাকিস্তানি কমলা, নাগপুর কমলা, অস্ট্রেলিয়ান কমলা ও কেনু কমলা।

ভিয়েতনামি মাল্টা গাছে সারাবছরই ফল থাকে/ছবি: জাগো নিউজ

Advertisement

গ্রিন অ্যাগ্রোর কর্ণধার কাজিম উদ্দিন বলেন, ‘ভিয়েতনামি বারোমাসি মাল্টার চারার বেশ চাহিদা আছে। ১৫ হাজার চারা এরই মধ্যে আমি তৈরি করেছি কাটিং করে। এ বছর এক লাখের মতো চাহিদা আছে। এই লক্ষ্য পূরণ করতে কাজ করছি। সরকারিভাবেও আমার কাছ থেকে চারা নেবে। ধোবাউড়া, মুক্তাগাছা কৃষি অফিস থেকেও আমার কাছ থেকে এ চারা নেবে। এই অঞ্চলটি পাহাড়ি। মাটি লাল। গোবর আর কেঁচো সার ছাড়া অন্য কিছু দেওয়ার দরকার নেই। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে যেন গোড়ায় পানি না জমে।’

ফুলবাড়িয়া উপজেলার উপ-সহকারী কৃষি অফিসার আবু রায়হান জাগো নিউজকে বলেন, ‘কৃষকরা মনে করেন গাছ লাগালেই ফল আসবে। আসলে তা কিন্তু নয়। মাল্টা গাছের প্রধান শত্রু হচ্ছে ওয়াটার সাকার। গাছে এটি প্রচুর পরিমাণে হয়। একটি গাছে প্রচুর ওয়াটার সাকার (অতি বাড়ন্ত ডাল) হয়। এতে ফলও হয়। একটি ওয়াটার সাকার ডালে দুই বছর পর দু-একটি মাল্টা আসতে পারে। অথচ প্রতি বোটায় বোটায় মাল্টা আসার কথা। সবুজ এই ডাল হঠাৎ বড় হয়ে যায় এবং প্রচুর পুষ্টি উপাদান খেয়ে ফেলে। এতে গাছ পুষ্টি পায় না। এটা না চিনলেই সমস্যা।’

ভিয়েতনামি মাল্টা কেজিতে সর্বোচ্চ তিনটি হয়। দুটোতেও কেজি হয়ে যায়/ছবি: জাগো নিউজ

‘এছাড়া জাত পোকা আছে। জাত পোকা স্প্রে করে না মেরে ফেললে কচি পাতা খেয়ে ফেলে। যখন ছোট ফল আসে তখন মাচি পোকা আক্রমণ করে। তখন আমরা ফেরোমেন ট্রাপ ব্যবহার করি। এটাকে জাদুর বাক্সও বলা হয়। এই বাক্সে স্ত্রী পোকাগুলো এসে মরে যায়। এই দুটো জিনিস নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে ভালো উৎপাদন সম্ভব।’

কাজিম উদ্দিনের চাষের বিষয়ে আবু রায়হান বলেন, ‘রাঙামাটি ইউনিয়নে স্যারই প্রথম মাল্টা চাষি। স্যারকে দেখে অনেকে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। আশা করি এ ইউনিয়নে প্রায় ২০ জন চাষি বাড়বে।’

এ বছর ফল ও চারা বিক্রি থেকে কোটি টাকা আয় হবে বলে আশাবাদী মো. কাজিম উদ্দিন/ছবি: জাগো নিউজ

শিক্ষক কাজিম উদ্দিনের কোটি টাকা আয়ের লক্ষ্যের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘স্যার বিভিন্ন দিক দিয়ে চারার চাহিদা পেয়েছেন। আমাদের মাধ্যমেও চাহিদা এসেছে। চারার দামও কম নয়। একটি চারা ১৫০-২০০ টাকা। আরও যে চাহিদা আছে আমি আশা করছি তাতে স্যার টার্গেট পূরণ করতে পারবেন। স্যার চাষ করার পর মনে হচ্ছে এ জাতটি আমাদের আবহাওয়ায় মানিয়ে গেছে। ফলন ভালো হচ্ছে। দেখতে সুন্দর। ওজন বেশি, মিষ্টিও বেশি, আর সারাবছর ফল আসে। ফলন দেখে আমরাও এখন ভিয়েতনামি মাল্টার চাষে উদ্বুদ্ধ করছি।’

ফুলবাড়িয়া উপজেলায় প্রায় ১০ হেক্টর জমি এখন মাল্টা চাষের আওতায় উল্লেখ করে উপ-সহকারী কৃষি অফিসার বলেন, ‘আমাদের প্রকল্প থেকেও অনেককে চারা দেওয়া হয়েছে। যদি বিপণন ব্যবস্থা ভালো হয়, ঢাকায় চাহিদা তৈরি করা যায়, তাহলে আরও প্রসার হবে।’

এএ/এইচএ/জেআইএম