মতামত

মুক্তিযুদ্ধ, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ ও আমাদের সশস্ত্রবাহিনী

সশস্ত্র বাহিনী দিবস কাল। প্রতি বছর ২১ নভেম্বর দিবসটি উদযাপিত হয়। মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ১৯৭১ সালের এই দিনে সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর সমন্বয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে গঠিত হয়েছিল বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী। স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে গিয়ে, করোনাকাল অতিক্রম করে যে সময়ে এসে আমরা উপস্থিত হয়েছি, তখন এ দিবসের বিশেষ তাৎপর্য আছে। আমাদের সংবিধানের মূল কথা— ন্যায়বিচার, স্বাধীনতা, সাম্য ও ভ্রাতৃত্ববোধ এব তা রক্ষা করতেই সশস্ত্রবাহিনী। তিন বাহিনীর প্রধান কাজ হল, দেশের ভৌগোলিক অখণ্ডতা ও সংবিধানের মূল্যবোধকে রক্ষা।

Advertisement

একটা প্রশ্ন আজ সবার সামনে - বাংলাদেশটা কী বদলে গেছে? প্রশ্নটা এ কারণে যে, আমরা দেখছি এ সমাজে একটা মানুষ আরেকটা মানুষকে ভয় পেতে শুরু করেছে। মানুষ, মানুষের বিরুদ্ধে আঘাত হানতে শুরু করেছে যেটা হবার কথা ছিল না। ১৯৭১-এ আমরা সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছি দখলদার পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে। কিন্তু আজ আবার বিভাজনের খেলা।

দেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তির সাম্প্রতিক হামলা, স্বাধীনতার ৫০ বছর উদযাপনে তাণ্ডব, ভাস্কর্য বিরোধী, নারী প্রগতি বিরোধী নানা বক্তব্য ও কাণ্ডের পর একটা প্রশ্ন সবার সামনে উপস্থিত – বাংলাদেশ কী তার মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে অনেক দূরে চলে গেছে? চলে গেছে হয়তো বলা যাবে না, তবে বলা যায় যে, নিয়ে যাওয়ার চক্রান্ত আছে।

১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-কে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে পেছনের দিকে যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর কন্যার হাত ধরে ১৯৯৬ এ একবার এবং গত তিন মেয়াদ ধরে দেশ পরিচালিত হলেও সাম্প্রদায়িক শক্তির দাপটে লাগাম টানা যায়নি, যদিও এ সময়ে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হয়েছে, যুদ্ধাপরাধের বিচার হয়েছে।

Advertisement

এখন যে সঙ্কটটা আমরা দেখতে পাচ্ছি তা যেন আমাদের সত্তার সঙ্কট এবং সত্তার পারস্পরিক সংঘাত। অন্য সত্তাকে তার পরিসরটুকু দিতে না চাওয়ার অভিপ্রায়। অথচ ১৯৭১-এ আমাদের মুক্তিযুদ্ধে একটা সব মানুষের দেশ চেয়েছিলাম যখন আমরা বলেছিলাম ‘বাংলার হিন্দু, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খ্রিস্টান এবং বাংলার মুসলমান সবাই বাঙালি’।

ধর্মের নামে বহুত্ববাদী সেই প্রত্যয়ের শিকড় নিয়েই যেন টান দিয়েছে একটা চক্র। স্বাধীন যুক্তিবাদী চিন্তার একটা ধারা বরাবর বাঙালি মুসলমানের মধ্যে ছিল। বঙ্গবন্ধু সেই নেতা যিনি ধার্মিক ছিলেন, কিন্তু সাম্প্রদায়িক মনোভাব কখনও তাকে গ্রাস করেনি।

ইতিহাসের গতিপথ ইতিহাসের ঘটনাপ্রবাহের ভিতরেই অবস্থান করে। আর ইতিহাস পরিবর্তন সহজ কর্ম নয়, তবে প্রচেষ্টা থাকতে হয়। শ্রেণি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এক বাংলাদেশের প্রত্যয় যদি হৃদয়ে থাকে তবে সফল হওয়া সম্ভব। এ বিষয় যখন আলোচনা করছি তখন আমাদের সামনে উপস্থিত ২১ নভেম্বর। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ২১ নভেম্বর ১৯৭১ সালে সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত হয়েছিল বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে সেদিন দেশকে শত্রুমুক্ত করতে সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর বীর সেনানীরা মুক্তি পাগল বাঙালির সঙ্গে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যৌথভাবে আক্রমণের সূচনা করেছিলেন। দিনটি মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ ও ভারতের সেনা সদস্যদের নিয়ে গড়া মিত্র বাহিনীর কাছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়েই সৃষ্টি হয় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ।

Advertisement

রাজনৈতিক নেতৃত্বের ডাকে একটা জনযুদ্ধের ভেতর দিয়ে গড়ে উঠা বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনী জাতীয় ঐক্যের প্রতীক। মুক্তিযুদ্ধের সময় যেমন দেশমাতৃকাকে স্বাধীন করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশেও সংকটের সময় জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছে বারংবার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সশস্ত্র বাহিনী দিবসের এক সভায় বলেছিলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত সশস্ত্র বাহিনী আমাদের জাতির অহংকার। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ যখনই ক্ষমতায় এসেছে সশস্ত্র বাহিনীর উন্নয়নে কাজ করছে। কারণ আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। সশস্ত্র বাহিনীকে কখনও আমাদের ক্ষমতা দখলের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করিনি। ক্ষমতা দখলের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে বার বার ক্যু করে শত শত অফিসার-সৈন্যদের হত্যা করিনি। আমরা চেয়েছি শান্তি ও নিরাপত্তা স্থাপন করে একে একটি সুন্দর সংগঠন হিসেবে গড়ে তুলতে এবং এই সশস্ত্র বাহিনী যেন আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন হয়। শুধু বাংলাদেশের জনগণ নয়, সারাবিশ্বে আস্থা-বিশ্বাস যেন অর্জন করে সেদিকে লক্ষ্য রেখেই আমরা বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। বঙ্গবন্ধু সশস্ত্র বাহিনীর যে সূদৃঢ় ভিত্তি রচনা করে গেছেন তারই উপর দাঁড়িয়ে আজ আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর পেশাদারিত্ব ও কর্মদক্ষতা দেশ ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে স্বীকৃত ও প্রশংসিত।’

রাজনৈতিক নেতৃত্বের এই বক্তব্য আসলে শাসন প্রণালীর দর্শন। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের চাওয়া ছিল একটি উদার, অসাম্প্রদায়িক ও মানবিক বাংলাদেশ। পুরো ন’মাসের যুদ্ধে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানিদের হাতে বন্দী থাকলেও তার নামেই যুদ্ধ হয়েছে প্রবাসী রাজনৈতিক সরকারের নেতৃত্বে। আর সশস্ত্র যুদ্ধটা হয়েছে বাঙালি সেনা,নৌ ও বিমান বাহিনীর সদস্যদের নেতৃত্বে গড়ে উঠা সাধারণ মানুষের মুক্তিবাহিনীর মাধ্যমে। তাই প্রধানমন্ত্রী যখন সশস্ত্রবাহিনীর কাছে তাঁর প্রত্যাশার কথা বলেন, তখন জনযুদ্ধের মাধ্যমে জন্ম নেওয়া তিন বাহিনীর সেই গৌরবের ইতিহাসই সামনে চলে আসে।

ভেতর থেকে মেধাশক্তির কিংবা চিন্তাশক্তির ক্ষয় ঘটানোর প্রচেষ্টা আছে। আমরা জানি এর জন্য অনেকাংশে দায়ী বিশ্বের নানা রাজনীতি। মৌলবাদী শক্তি রাজনীতির হাতিয়ার এখন অনেক দেশেই। রাষ্ট্রশক্তি যখন মৌলবাদী শক্তির হাতিয়ার হয়ে উঠে, তখন তা ভয়ের কারণ হয়। বিশেষত, আমাদের মতো দেশে, বিশাল জনসংখ্যা যার মাথাব্যথার কারণ।

বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের মহান আত্মত্যাগ ও বীরত্বগাথা জাতি সবসময় গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে। বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে দক্ষতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছেন। সারাবিশ্বে তাদের দক্ষতা ও সক্ষমতার কথা আজ প্রমাণিত। আর সে কারণেই প্রত্যাশা এই যে, সাম্প্রদায়িক অসহিষ্ণুতা বা অস্থিরতা সৃষ্টির যে ষড়যন্ত্র আছে একটি মহল থেকে সেটা সফল হবে না।

শুধু যুদ্ধ নয়, বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনী আজ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিরন্তর প্রচেষ্টায় শিক্ষার বিস্তারে, বৃহত্তর অবকাঠামো ও স্থাপনা নির্মাণে, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়নে, দুর্যোগ মোকাবেলায় এক অনন্য নাম। মানুষকে সচেতন ও প্রগতিমুখী করার কাজ এই বাহিনীর মাধ্যমেই সম্ভব যেন কোন বিভেদকামী শক্তি আমাদের জাতিকে দুর্বল করতে না পারে।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, জিটিভি।

এইচআর/এমএস