বিশেষ প্রতিবেদন

‘কৃষ্ণা কেবিন’র মিষ্টিতে ‘কৃতকার্য’ তিন প্রজন্ম

‘বাবার কাপড়ের দোকান ছিল। সেখানে লোকসান করেন। পরে সাধু (ধর্মীয় পুরোহিত) বলেছেন, তুমি খাবারের দোকান দাও, কৃতকার্য হবে। সাধুর কথা মতো বাবা খাবারের দোকান দিলেন। কৃতকার্যও হলেন। আজকে সারাদেশে তার দোকানের সুনাম।’

Advertisement

কথাগুলো বলছিলেন ময়মনসিংহের ঐতিহ্যবাহী মিষ্টির দোকান ‘কৃষ্ণা কেবিন’র মালিকদের একজন রণজিৎ বসাক। দোকানের বয়স ৭০ বছর, প্রতিষ্ঠাতা তার বাবা পার্বতী বসাক।

চা, নিমকি আর দু-এক পদের মিষ্টি দিয়ে শুরু এই দোকানের যাত্রা। সেখানে নাস্তা খেত মানুষ, ছিল প্রায় ৪০ জনের বসার ব্যবস্থা। বসে খাওয়ার ব্যবস্থা এখন নেই মোটেই। এটি এখন শুধুই মিষ্টির দোকান। কালের পরিক্রমায় অনেক কিছু বদলেছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে দোকানের সুনাম।

ময়মনসিংহ শহরের  স্টেশন রোডের কৃষ্ণা কেবিনের দোকানে বসেই জাগো নিউজের কথা হয় রণজিৎ-এর সঙ্গে। ৬৭ বছরের রণজিৎ অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছেন। বাবার মৃত্যুর পর ব্যবসার হাল ধরেন তার বড় ভাই। এরপর তিনি। তিনিও এখন অসুস্থ-দুর্বল হয়ে পড়ায় সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার ভাতিজা রাজিব বসাক ও ছোটভাই অশোক বসাককে সঙ্গে নিয়ে ব্যবসা সামলাচ্ছেন।

Advertisement

ভিড় লেগেই থাকে ‘কৃষ্ণা কেবিন’ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে/ছবি: মাহবুব আলম 

‘কৃষ্ণা কেবিন’ নাম কীভাবে হলো, জানতে চাইলে দোকানের প্রতিষ্ঠাতার নাতি ইঞ্জিনিয়ার রাজিব বসাক জাগো নিউজকে বলেন, ‘নামটা আমার দাদা (প্রতিষ্ঠাতা পার্বতী বসাক) দিয়েছেন। কৃষ্ণা নামটা আমাদের ধর্মীয় সংস্কৃতি থেকে আসছে। আগের যুগের মানুষ তো, ধর্মীয় দিকে দুর্বল ছিলেন। কেবিন হলো- বসার যায়গা। আগে তো ৪০ জনের সিটিং টেবিল ছিল। নাস্তার দোকান ছিল। এখন তো কালের পরিক্রমায় মিষ্টির দোকান।’

তিনি বলেন, ‘আমি সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছি। এখন ব্যবসায় সেট হতে হয়েছে। বাবা অসুস্থ হয়ে পড়ায় চাচাদের সঙ্গে এখন দোকানটা দেখি। তবে আমরা পূর্বপুরুষদের কথা মতো মানটা ঠিক রাখছি। যা বিক্রি করি, টাটকা। কোনো বাসি মাল রাখি না, বিক্রিও করি না।’

প্রতিষ্ঠাতা পার্বতী বসাকের মেজ ছেলে রণজিৎ বসাক বলেন, ‘৭০ বছর আগে বাবা এই ব্যবসা শুরু করেন। তখন মূলত কৃষ্ণা কেবিন ছিল নাস্তার জন্য নামকরা। এখন তো নাস্তা বেচার জায়গা নেই। এখন শুধু ১০/১২ ধরনের মিষ্টি ও তিন ধরনের দই বিক্রি করি। বাবার মৃত্যুর পর এই দোকান চালাতেন আমার বড় ভাই। আমরা সহযোগিতা করতাম। এখন তিনি অসুস্থ, তার ছেলে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার রাজিব বসাক এখন বসে। আর আমরা দুই ভাই (রণজিৎ ও অশোক) বসি। প্রতিষ্ঠাকাল থেকে আমরা মূল মালিকরাই পরিচালনা করি, ক্যাশে বসি।’

Advertisement

তিনি বলেন, ‘এই দোকান দিয়ে আমরা তেমন কিছু করতে পারি নাই। অনেকে নতুন দোকান দিয়ে বাড়ি-গাড়ি করে ফেলেছে। আমরা এখনো ভাড়া বাসায় থাকি। তবে তিন ভাই ও ভাতিজার সংসার চলে এই দোকানের আয় দিয়ে। তিন ভাইয়ের বিয়ের পাশাপাশি তিন বোনেরও বিয়ে দিয়েছি।’

অবশ্য আহামরি লাভ না হলেও ‘দোকানের সুনাম আছে’ এতেই তুষ্ট রণজিৎ। তিনি বলেন, ‘সাধুর সেই কথায় বাবা কৃতকার্য হয়েছেন, আমরাও। এর চেয়ে বড় পাওয়া কী?’

কেন এই দোকান বিখ্যাত? জবাবে রণজিৎ বলেন, ‘কোয়ালিটির (মান) কারণে বিখ্যাত। আমরা মানটা ঠিক রাখছি। আর আমাদের আরেকটা রেকর্ড আছে, আমরা কখনো কর্মচারী বিদায় দেই না। প্রতিষ্ঠিত হয়ে অনেকে বিদায় নেয় বা ভালো সুযোগ পেলে যায়। কিন্তু আমরা কাউকে কোনো দিন বিদায় দেইনি বা চাকুরিচ্যুত করিনি।’

‘কৃষ্ণা কেবিন’ দোকানটি ময়মনসিংহ শহরের স্টেশন রোডের আসাদ মার্কেটে। আর কারখানা শিববাড়িতে, মালিকদের বাসার পাশে। শোরুমটি মাত্র ১৮০ বর্গফুটের। আর কারখানা দেড় শতাংশ জায়গায়। প্রতিদিন এখানে ১০-১২ জন লোক কাজ করেন। এই দীর্ঘ পথচলায় তারা যেমন কুড়িয়েছেন বিখ্যাত হওয়ার মত সম্মান, তেমনি পেয়েছেন সম্মাননাও।

‘কৃষ্ণা কেবিন’ সর্বোচ্চ করদাতা সম্মাননা পেয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে। পাশাপাশি সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন দোকান করার জন্য একটি বেসরকারি সংস্থার স্বীকৃতিও মিলেছে। প্রতিষ্ঠাতা পর্বতী বসাককে মরণোত্তর সম্মাননাও দিয়েছে একটি প্রতিষ্ঠান।

দাঁড়িয়েই জলাহার সারেন ক্রেতারা/ছবি: মাহবুব আলম

বিখ্যাত এই দোকান দিয়ে শুধু মালিকরাই কৃতকার্য হয়েছেন তা নয়, কর্মচারী এবং ভোক্তারাও তুষ্ট। কর্মচারীরা ঐতিহ্যবাহী এই দোকানে কাজ করে গর্বিত। ক্রেতা-ভোক্তাকেও সেভাবে মূল্যায়ন করতে দেখা গেছে।

কর্মচারীদের একজন মিঠু দে। তিনি ২০ বছর ধরে এখানেই কাজ করছেন। ৫০ টাকা হাজিরায় ২০০১ সালে এখানে কাজ শুরু করেছেন, এখন তার বেতন ১৫ হাজার টাকা।

কাজে তাদের আন্তরিকতা ও দরদ দেখে ‘আপনারা মালিকপক্ষের আত্মীয়?’ জিজ্ঞেস করতেই মিঠু দে জাগো নিউজকে বলেন, ‘আত্মীয়ের চেয়ে বেশি। আমরা তাদের (মালিক) সন্তানের মতো। ভালো প্রতিষ্ঠান, এখানে কর্ম করি। আমার রোজগার হয়। সম্মানও পাই। আমরাও কাস্টমারদের সম্মান দেই। আমাদের আচরণে কাস্টমার বোঝেও না যে আমরা মূর্খ। চেষ্টা করি, হাসিমুখে সর্বোচ্চ সেবাটা দিতে।’

আরেকজন কর্মচারী মাধব বসাক। দুই বছর ধরে কাজ করেন কৃষ্ণা কেবিনে। বেতন পান ১০ হাজার টাকা। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘এখানে কাজ করে মজা পাই। কাস্টমার বেশি। আমরা ব্যবহার ভালো রাখার চেষ্টা করি, কাস্টমারও আমাদের সমীহ করে।’

ক্রেতা-ভোক্তাদের সঙ্গেও কথা বলে ইতিবাচক বক্তব্য মিলেছে। সুদূর শেরপুরের নালিতাবাড়ি থেকে মিষ্টি নিতে এসেছেন হিরন্ময়ী উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক সাখাওয়াত হোসেন।

তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘এটা প্রসিদ্ধ ও ঐহিত্যবাহী দোকান। বন্ধুদের থেকে এই দোকানের গল্প শুনেছি। অনেক মিষ্টিও খেয়েছি। কিন্তু আসা হয়নি। আজ বন্ধুর কাছ থেকে লোকেশন জেনে এসেছি। আমি মূলত কিশোরগঞ্জ বন্ধুর বাড়ি বেড়াতে যাচ্ছি, তাই সবচেয়ে সেরা মিষ্টিটাই নিয়ে যাচ্ছি।’

এখানে ১০/১২ ধরনের মিষ্টি হয়। মালাইকারি প্রসিদ্ধ। এছাড়া রসগোল্লা, চমচম, কালোজাম, রসমালাই, দানাদার, গোল্লা, কাঁচাগোল্লা ইত্যাদি আছে। টক দই, টক-মিষ্টি দই ও মিষ্টি দই পাওয়া যায় ‘বসার জায়গা না থাকা’ কৃষ্ণা কেবিনে।

এসইউজে/এমএইচআর/এসএইচএস/এইচএ/জিকেএস