দেশজুড়ে

২০০ কোটি টাকার শুঁটকির বাজার ১৫ ‘সাহেবের’ নিয়ন্ত্রণে

অক্টোবরের শেষের দিক থেকে শুরু হয়েছে শুঁটকি মৌসুম। এ মৌসুমকে কেন্দ্র করে বঙ্গোপসাগরের দুবলার চরে জড়ো হয়েছেন ১০ হাজারের অধিক জেলে-মহাজন। সাগর থেকে লইট্যা, ছুরি, পোয়া, খলিশা, ভেদা, চিংড়ি, ইছা, রূপচাঁদাসহ শতাধিক প্রজাতির মাছ সংগ্রহ করে সেগুলো রোদে শুকিয়ে শুঁটকি করবেন তারা। এরপর সে শুঁটকি চলে যাবে ঢাকা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজারসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। এ অঞ্চলের শুঁটকি রপ্তানি হয় বিদেশেও।

Advertisement

স্থানীয়রা বলছেন, পাঁচ মাস সময়ে এ পল্লীতে প্রায় ২০০ কোটি টাকার লেনদেন হয়। শুঁটকির বড় বাজার হলেও ১৫ সাহেবের সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করছে দুবলার চরের পল্লী। প্রত্যেক মৌসুমে তিন কোটি টাকার অধিক রাজস্ব আদায় হলেও বাজার সম্প্রসারণ ও নিয়ন্ত্রণে নজরদারি নেই বাণিজ্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর। শুটকি পল্লীতে ১৩ মৎস্য আহরণ, প্রক্রিয়াজাত ও বাজারজাতকরণ কেন্দ্র গড়ে উঠলেও এখানে অবহেলিত জেলেরা।

জেলেরা জানান, শুঁটকির মৌসুম এলেই মোংলা, রামপাল, খুলনা, সাতক্ষীরা, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, বরিশাল এমনকি চট্টগ্রাম উপকূলের জেলেরা দুবলার চরে চলে আসে। সাগর থেকে শতাধিক প্রজাতির মাছ ধরে তিন-চার দিন রোদে শুকিয়ে তারা শুঁটকি তৈরি করেন।

খুলনা ডুমুরিয়া এলাকার জেলে ইউসুফ শেখ বলেন, আগামী পাঁচ মাস দুবলার চরে অবস্থানের অনুমতি মিলেছে। সে কারণে চরে অস্থায়ী বসতি গড়ে তুলেছি। প্রয়োজনীয় খাবার-পথ্য সঙ্গে নিয়ে এসেছি। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আগামী পাঁচ মাস সাগর পাড়ে অবস্থান করতে হবে।

Advertisement

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক জেলে বলেন, দস্যু মুক্ত হলেও আমরা ‘সাহেব’ মুক্ত নই। সরকারি-বেসরকারি সাহেবরা নানান কায়দায় আমাদের শোষণ করে থাকেন। দাদন ছাড়া আমরা সাগরে আসতে পারি না। কাঁচামাছ বিক্রিসহ নানা কৌশলে জেলে-মহাজনরা আমাদের কাছ থেকে টাকা আদায় করেন।

তিনি বলেন, যে মাছ বাজারে প্রতি কেজি সাড়ে ৭০০ টাকা সে মাছ ওই সাহেবদের নির্ধারিত মাহাজনের কাছে ২৫০ টাকায় বিক্রি করতে হয়। বাজারে যে মাছ বিক্রি হয় ৫০০ টাকা আমাদের তা বিক্রি করতে হয় ২০০ টাকায়।

তবে রামপাল এলাকার জেলে-মহাজন শেখ আবু তাহের বলেন, দুবলার চরে আমি ২৬-২৭ বছর ধরে মাছ ধরতে আসি। সাহেবদের সহযোগিতা ছাড়া সাগরে আসা অধিকাংশ জেলের পক্ষে সম্ভব নয়। জেলে-মহাজনরা সাহেবদের কাছ থেকে ৪-৫ খাতে দাদন নেন।

তিনি বলেন, যে যাই বলুক; সাহেবরা না থাকলে সাগরে পাঁচটা ট্রলার ভাসানো আর ৪২ জন লোক নামানো আমার মতো মানুষের পক্ষে কোনো দিনই সম্ভব হতো না।

Advertisement

বন বিভাগ সূত্র জানায়, ১০ হাজার টাকা দিয়ে সাগরে মাছ ধরার জন্য বন বিভাগ থেকে লাইসেন্স নিতে হয়। প্রতি বছর সাড়ে ৭০০ টাকা ফি দিয়ে লাইসেন্স নবায়ন করতে হয়। প্রতিবারের ন্যায় চলতি বছরও মাত্র ১৫ ব্যবসায়ীর মধ্যে লাইসেন্স প্রদান সীমাবদ্ধ রেখেছে। এ ১৫ জন ব্যবসায়ী নির্ধারণ করবে কে দুবলার চরে বসতি স্থাপন করতে পারবেন। এ ব্যবসায়ীদের অধীনে থেকে ৯৮৫ জন মহাজন আর ১০ হাজারের অধিক জেলেকে মৌসুমের পাঁচ মাস চলতে হবে।

সূত্র জানায়, কামাল উদ্দিন আহমেদ, আফিয়া বেগম, খান শফিউল্লাহ, শেখ মইনুদ্দিন আহমেদ, আরিফ হোসেন, রেজাউল শেখ, এবিএম মুস্তাকিন, ইদ্রিস আলী, হাকিম বিশ্বাস, জালাল উদ্দিন আহমেদ, সুলতান মাহমুদ, বেলায়েত সরদার, কামরুর নাহার, শাহানুর রহমান ও আসাদুর রহমানের অনুমোদন রয়েছে সাগরে মাছ ধরার।

সূত্র আরও জানায়, প্রতি কেজি শুঁটকি থেকে বনবিভাগ পাঁচ টাকা ৭৫ পয়সা রাজস্ব আদায় করে। ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে দুবলার চরে শুঁটকি সংগ্রহ করা হয়েছে ৪১ হাজার ৫৪ টন। ওই বছর ১৬৪ কোটি ২১ লাখ টাকা লেনদেন হয়। আর শুঁটকি থেকে বনবিভাগ রাজস্ব আদায় করে দুই কোটি ৪৭ লাখ টাকা।

একইভাবে ২০১৯-২০ অর্থ বছরে শুঁটকি আহরণ করা হয়েছে ৪৪ হাজার ৭১৩ টন। ওই বছর লেনদেন হয় ১৭৮ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। ওই পরিমাণ শুঁটকি থেকে বনবিভাগ তিন কোটি ১৭ লাখ টাকা রাজস্ব আদায় করে।

গত ২০২০-২১ অর্থ বছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল তিন কোটি ২০ লাখ টাকা। কিন্তু মাছ আহরণের পরিমাণ বেশি হওয়ায় রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় তিন কোটি ২২ লাখ টাকা আর বাজার পৌঁছায় ২০০ কোটি টাকায়। চলতি বছর সে তিন কোটি ২২ লাখ টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।

পূর্ব সুন্দরবনের হিসাব বিভাগের কর্মকর্তা সত্যজিৎ সাহা বলেন, চলতি বছর দুবলার চরে জেলেদের জন্য ৯৮৫ ঘর ও ৬৬ ডিপো তৈরির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। জেলেদের প্রত্যেকটা ঘরপ্রতি ১০০ টাকা ও ডিপোপ্রতি ২০০ টাকা রাজস্ব আদায় করা হয়।

দুবলা ফিসারম্যান গ্রুপের সভাপতি কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, গত তিন বছর ধরে সুন্দরবনে বনদস্যুদের চাঁদাবাজি বন্ধ রয়েছে। অনেকটা স্বস্তি নিয়ে সাগরে মাছ ধরছেন জেলেরা। উৎসবমুখর ও নিরাপদ পরিবেশে মাছ আহরণ ও শুঁটকি প্রক্রিয়াজাতকরণ করা হচ্ছে।

পূর্ব সুন্দরবনের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মুহাম্মদ বেলায়েত হোসেন বলেন, ২৬ অক্টোবর থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত শুঁটকি পল্লীতে অবস্থানের জন্য জেলেদের অনুমোদর দেওয়া হয়েছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি রাজস্ব আদায় সম্ভব হবে বলে আশাবাদী তিনি।

আলমগীর হান্নান/আরএইচ/জিকেএস