মতামত

এক কিংবদন্তী- আগুনপাখির বিদায়

বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ গল্পকার এক বড় শক্তি; এক কিংবদন্তী- আগুনপাখির বিদায়! হাসান আজিজুল হকের কথায়, ‘দেশ ছেড়েছে যে তার ভেতর বাইরে নেই। সব এক হয়ে গেছে।’ তিনি জন্মেছিলেন ১৯৩৯ সালের ২ ফেব্রুয়ারি বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার যবগ্রামে। অতঃপর দেশভাগ, সেখান থেকে চলে আসা।

Advertisement

ভারতবর্ষের ভাঙা-গড়ার ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত তিনি। শৈশব, কৈশোর ও তারুণ্য কাটিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গে, যৌবনের প্রারম্ভে এবং যৌবনে পূর্ব পাকিস্তানের খুলনার ফুলতলায়। একটি বিশ্বযুদ্ধ, দেশভাগের রাজনীতি, দেশভাগ, দাঙ্গা, বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ এবং উত্তরকালের চার দশকের বাংলাদেশের উত্থান-পতন ইত্যাদি ইতিহাসের বিস্তৃত পথপরিক্রমার অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি সাহিত্যকর্ম রচনা করেছেন। তিনি মানুষের ভেতরে সত্তা, মানুষের জীবন আর জীবন সংগ্রামের কথা লিখেছেন। তাঁর লেখায় ছিন্নমূল , উৎপীড়িত আর শোষিত মানুষের জীবনসংগ্রাম, যন্ত্রণা আর হাহাকার শিল্পিত হয়ে উঠেছে।

দেশহারানো মানুষ হাসান আজিজুল হক- জীবনের অধিকাংশ সময় রাজশাহীতে কাটিয়েছেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের ভূতপুর্ব অধ্যাপক, উপমহাদেশের প্রখ্যাত গল্পকার, কথাশিল্পী- গল্পের জগতে হাসান আজিজুল হক জ্বলজ্বলে, গল্পের আগুনপাখি।

দেশভাগ ব্যক্তিজীবনে তাঁর চিরস্থায়ী ক্ষত। এই বাস্তবের অংশ তিনি। দেশভাগ ও দাঙ্গা বিষয়ক তাঁর গল্প-উপন্যাস দেশভাগের সাহিত্যের অনন্য সংযোজন। দেশভাগের আর দেশত্যাগের প্রত্যক্ষ ক্ষতির শিকার - দেশত্যাগী উদ্বাস্তু মানুষের মিছিলে ছিলেন আমৃত্যু। উৎস থেকে বিচ্ছিন্ন হবার কষ্টকে অনুভব করেছেন।

Advertisement

হাসান আজিজুল হকের ‘আগুনপাখি‘- উপন্যাসের বিষয় বিশ্বযুদ্ধ, দেশভাগ, দাঙ্গা, দুর্ভিক্ষ ও দেশান্তরিত মানুষের ইতিহাস। ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’, বাংলা সাহিত্যের সমস্ত দেশভাগের গল্পের মধ্যে অনন্যতার দাবিদার। দেশত্যাগী মানুষের মর্মঘাতী যন্ত্রণার তীব্রতার সর্বোচ্চ প্রকাশ ঘটেছে এ গল্পে। একটি জাতির ভাঙনের ইতিহাস ও তার বেদনাবহ পরিণতিকে হাসান আজিজুল হক অসাধারণ দক্ষতায় মূর্ত করে উপস্থাপন করেন।

পাঠকের ভালোবাসা ছাড়াও তাঁর প্রাপ্তি - বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার। বাংলাদেশ সরকার তাকে ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে একুশে পদকে ও ২০১৯ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করে। ২০১৫ এ বাংলার পাঠশালা সরদার ফজলুল করিম দর্শন পদক লাভ করেন। সরদার ফজলুল করিম দিনলিপি সম্মাদনা এবং জীবনীগ্রন্থ- সরদার ফজলুল করিম এর রচয়িতা হিসেবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত সম্মাননা অনুষ্ঠানটিতে যোগ দেয়ার সুযোগ হয় ।

দীর্ঘদিন বিভিন্ন অসুস্থতার পর, ২০২১ সালের ১৫ নভেম্বর, হাসান আজিজুল হক তার রাজশাহীর বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন। একটা যুগ শেষ হল। কারো কারো চলে যাওয়া শুধু হারিয়ে যাওয়া নয়, যেন নক্ষত্রপতন। জীবনানন্দ দাশের কথায় যেনো ‘‘আকাশ ছড়ায় আছে শান্তি হয়ে আকাশে আকাশে .../সেখানেই হয়তো গিয়েছেন তারাদের কাছে।’

পরিচয় : লেখক, গবেষক, পরিবেশবিদ।

Advertisement

এইচআর/জেআইএম