মতামত

নির্বাচন এবং গণতন্ত্র নিয়ে উদ্বেগ

বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া অত্যন্ত অসুস্থ বলে জানিয়েছেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বেগম জিয়া এখন রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালের সিসিইউতে চিকিৎসাধীন আছেন। ১৪ নভেম্বর খালেদা জিয়ার চিকিৎসার জন্য গঠিত মেডিকেল বোর্ডের সদস্য ও বিএনপি নেতা ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, ‘তিনি (খালেদা জিয়া) ভালো আছেন, না খারাপ আছেন, এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাই না। তিনি এখন সিসিইউতে আছেন’। আর মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেছেন, ‘তিনি হাসপাতালে আছেন। হাসপাতালে তিনি জীবন-মরণ নিয়ে সংগ্রাম করছেন’।

Advertisement

এসব বক্তব্য থেকে মনে হয়, বিএনপি নেত্রী ভালো নেই। তিনি অনেক দিন ধরেই অসুস্থ। এরমধ্যে তিনি করোনায়ও আক্রান্ত হয়েছিলেন। নানা ধরনের শারীরিক সমস্যা নিয়ে তিনি বাসা এবং হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। পরিবারের পক্ষ থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে একাধিকবার আবেদন করা হলেও ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যায়নি। তিনি দুটি দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামি। তবে চিকিৎসার সুবিধার জন্য সরকার তার সাজা স্থগিত করে বাসায় থাকার সুযোগ দিয়েছে। তবে তার সর্বশেষ শারীরিক অবস্থা যদি জটিল ও সংকটজনক হয়ে থাকে তাহলে সরকার তাকে বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দেবে কি না তা পরিষ্কার নয়। বিএনপির সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক সহযোগিতার নয়। বিএনপি আওয়ামী লীগের সঙ্গে বৈরিতা জিইয়ে রাখার নীতিতে বিশ্বাসী। আওয়ামী লীগ সরকারও স্বাভাবিকভাবেই বিএনপির প্রতি সদয় এবং উদার নয়।

বেগম জিয়ার স্বাস্থ্য সম্পর্কে কিছুটা উদ্বেগের খবর যখন গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে, ঠিক একই সময়ে একজন নির্বাচন কমিশনারের বক্তব্যও সচেতন মহলে উদ্বেগ ছড়িয়েছে। নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার ১৪ নভেম্বর সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বলেছেন, দেশে প্রকৃতপক্ষে নির্বাচন এখন ‘আইসিইউ’তে, এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে গণতন্ত্র ‘লাইফ সাপোর্টে’। মাহবুব তালুকদার মমে করেন, প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর অসহিষ্ণু মনোভাব দেশে গণতন্ত্রকে অন্তিম অবস্থায় নিয়ে গেছে। খেলায় যেমন পক্ষ-বিপক্ষের প্রয়োজন হয়, তেমনি একপক্ষীয় কোনো গণতন্ত্র হয় না।

নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার এবারের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে ‘রক্তাক্ত বললে অত্যুক্তি হবে না' বলে মন্তব্য করেছেন। নির্বাচনের সময় ও তার আগে-পরে এ পর্যন্ত ৩৯ জন নিহত হয়েছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, জীবনের চেয়ে নির্বাচন বড় নয়- এ বার্তা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাছে পৌঁছাতে সম্ভবত ব্যর্থ হয়েছে কমিশন। ১১ নভেম্বর ৮৩৪টি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ৮০ জন চেয়ারম্যান হন। একে আক্ষরিক অর্থে নির্বাচন বলা যায় না।

Advertisement

বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সব প্রার্থী জয়লাভ করায় কুমিল্লার লাকসাম উপজেলা ও চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলা বিশ্বে ‘আদর্শ নির্বাচনের’ অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে বলে কটাক্ষ করে মাহবুব তালুকদার বলেন, আওয়ামী লীগের একক প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পাওয়া কুমিল্লার লাকসাম উপজেলার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান, সাধারণ সদস্য ও সংরক্ষিত সদস্যপদে ৬৫ জন এবং রাউজান উপজেলার ১৪ ইউনিয়ন চেয়ারম্যান, ১২৬ জন পুরুষ ও ৪২ জন সংরক্ষিত আসনের সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আসীন হয়েছেন। দেশের ইতিহাসে এই প্রথম কোনো উপজেলায় চেয়ারম্যান ও সদস্যদের ১৮২টি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্মুখীন না হয়ে ‘নির্বাচিত’ হয়েছেন।

ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন প্রায় একতরফা ভাবেহলেও সহিংসতায় অনেকের জীবন যাচ্ছে। সংঘর্ষে জড়িয়ে আরও অনেকে আহত হচ্ছেন । এসব সংঘাত-সংঘর্ষ সম্প্রকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা বলেছেন, ‘ঘরে ঘরে, পাড়া-মহল্লায় পাহারা দিয়ে নির্বাচনী সহিংসতা ঠেকানো সম্ভব নয়’। আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, ‘এটা গোষ্ঠী গোষ্ঠীর নির্বাচন, আধিপত্যের নির্বাচন, এতে সব সময়ই একটু ঝগড়াঝাটি হয়’।

দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মুখে এসব অসহায় আত্মসমর্পণমূলক কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে, নির্বাচনী সহিংসতা চলবে এবং মানুষের মৃত্যু রোধ করা যাবে না। নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থী-সমর্থকদের শুভবুদ্ধির উদয় হলে, জয়ের জন্য তারা মরিয়া হয়ে না উঠলে, ভোটারদের পছন্দের প্রার্থী বাছাইয়ের অবাধ সুযোগ অবারিত হলেই কেবল সংঘাত বন্ধ হতে পারে। তবে তেমন আদর্শ নির্বাচনী পরিবেশ আমাদের দেশে আর হওয়ার আশা কম।

নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে অংশগ্রহণ করছে না। কিছু কিছু জায়গায় স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। তবে সারাদেশে আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগই। অফিসিয়ালি নৌকা যিনি পেয়েছেন, পাচ্ছেন তার বিরুদ্ধে একাধিক নন-অফিসিয়াল প্রার্থী দাঁড়িয়ে এক সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে, হচ্ছে। কোথাও কোথাও নৌকার প্রাথী ধরাশায়ী হচ্ছেন।

Advertisement

দুই. আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের প্রতিদিন গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন। প্রয়োজনীয় কথা যেমন বলেন, তেমন অপ্রয়োজনীয় কথাও বলেন। তবে গত ২৭ অক্টোবরের তার একটি বক্তব্য রাজনীতি সচেতন অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। দলের মধ্যে ‘দুর্বিষহ’ অবস্থার কথা উল্লেখ করে ওবায়দুল কাদের বলেছেন, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীই এখন একে অপরের দিকে ‘রাজাকারের’ তকমা লাগানোর চেষ্টা করছেন। যার সঙ্গে যার বনবে না, তাকে বলবে রাজাকারের ছেলে অথবা বলবে রাজাকারের নাতি বা শান্তি কমিটির সদস্য ছিল তারা। এসব অভিযোগের স্তূপ হয়ে গেছে পার্টি অফিসে।’

ওবায়দুল কাদেরের এসব বক্তব্য নিয়ে মন্তব্য করার প্রয়োজন নেই। শুধু এটুকুই বলা যায় যে, এমন অবস্থা তৈরি হলো কীভাবে? এর দায় কার? এই অবস্থা থেকে উত্তরণেরই পথ কি? ওবায়দুল কাদের দলের দুই নম্বর গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তার তো কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ করা সাজে না। অন্যরা অভিযোগ করলে তিনি তার নিষ্পত্তি করবেন। বিরোধ মেটাবেন, বিরোধে জড়াবেন না। অথচ তিনি নিজের ছোট ভাইকেই দলীয় শৃঙ্খলার আওতায় আনতে পারেন না। প্রায় এক বছর ধরে নোয়াখালীর বসুরহাট পৌরসভার মেয়র কাদের মির্জা আওয়ামী লীগের কয়েকজন সংসদ সদস্য, অন্য কয়েকজন নেতা এবং সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কামান দেগেই চলেছেন। কাদের মির্জা যদি ওবায়দুল কাদেরের ছোট ভাই না হতেন তাহলে কি তিনি এমন ঔদ্ধত্য দেখিয়ে নিস্তার পেতেন। এই ঘটনা আওয়ামী লীগের তৃণমূলে কি বার্তা দিচ্ছে?

ওবায়দুল কাদের একই দিনের বক্তৃতায় আরো বলেছেন, ‘আমি ব্যবসায়ীদের রাজনীতি করার বিরুদ্ধে নই। কিন্তু রাজনীতিকে যখন ব্যবসার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়, সেটাকে আমি ঘৃণা করি। এদেশে অনেকে ব্যবসা না করেও রাজনীতিতে নেতা হয়ে ব্যবসা করছেন।’ ওবায়দুল কাদের এসব কথা কেন এবং কার উদ্দেশ্যে বলেছেন? যারা ব্যবসা এবং রাজনীতিকে গুলিয়ে ফেলে ব্যবসা এবং রাজনীতি দুটোরই বারোটা বাজাচ্ছেন, তাদের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নিচ্ছে আওয়ামী লীগ? উপরের দিকে মুখ করে থুতু ফেললে তা নিজের গায়েই পড়ে। আগেই বলছি, ওবায়দুল কাদের অভিযোগ করার পর্যায়ে নেই, তিনি প্রতিকার করার অবস্থানে আছেন।

একটু ভালোভাবে লক্ষ করলেই এটা স্পষ্ট হবে যে, একটি কার্যকর, সক্রিয়, দায়িত্বশীল বিরোধী দলের অনুপস্থিতির কারণে দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই শুধু ভঙ্গুর অবস্থায় পৌঁছেনি, বরং আওয়ামী লীগ দলটিও সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছে। বড় কোনো ধাক্কা বা চাপ সামলানোর অবস্থায় আওয়ামী লীগ আছে কিনা তা নিয়ে দলটির শুভাকাঙ্ক্ষীদের মধ্যেও সংশয় তৈরি হয়েছে। এ বছর দুর্গাপূজার সময় ও পরে সাম্প্রদায়িক বিভেদকামীদের বিরুদ্ধে কিন্তু আওয়ামী লীগ কোথাও তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি। কেন্দ্রীয়ভাবে শান্তি সমাবেশ করতেও ৬দিন লেগেছে। আওয়ামী লীগের মতো ঐতিহ্যবাহী একটি দলের কাছে এমন গা ছাড়া ভাব প্রত্যাশিত ছিল না। কেন এমন হচ্ছে?

কেউ কেউ মনে করেন, সরকারের মধ্য যেমন সরকার থাকে, আওয়ামী লীগের মধ্যও তেমনি আওয়ামী লীগ তৈরি হয়েছে। আওয়ামী লীগ এখন আর এক আশে বিশ্বাসী ঐক্যবদ্ধ আওয়ামী লীগ নেই। আওয়ামী লীগ টানা ক্ষমতায় থেকে কেবল জনগণের থেকে দূরে সরে গেছে তাই নয়, আওয়ামী লীগের মধ্যে সুযোগসন্ধানী ও সুবিধাবাদীদের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। আওয়ামী লীগ যে বিভেদ-কোন্দলে জর্জরিত তার প্রমাণ পাওয়া যায় যেকোনো নির্বাচন এলে।

নির্বাচনে অনেকেই প্রার্থী হতে চান। জনসমর্থন আছে কিনা সেটা ভাবার দরকার আছে বলেও কেউ মনে করেন না। কারণ সবাই ধরে নেন যে, ভোটে জিততে এখন আর জনসমর্থন বড় বিষয় নয়, বড় বিষয় হলো মার্কা বা প্রতীক- নৌকা। নৌকা তীরে ভেড়ানোর দায়িত্ব প্রার্থীর নয়, দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার। তিনি সবার তরী পারের দায়িত্ব নিয়েছেন! তাই যেকোনো উপায়ে নৌকা পাওয়ার প্রতিযোগিতায় অনেকেই উন্মত্তের মতো আচরণ করছেন। এই উন্মত্ততা বন্ধের উপায় খুঁজতে বিলম্ব করলে আওয়ামী লীগের ঐতিহ্যে যে কালি লাগবে তা মোছা সহজ হবে না।

লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক। সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা।

এইচআর/জেআইএম