সাতসকাল বেলা ঘুম ভেঙে ‘মডেল তিন্নি হত্যা মামলার রায় আজ’ শিরোনামে যে লিড নিউজে চোখে পড়লো তা দেখে মুহূর্তেই চোখের সামনে ভেসে উঠলো দুই দশক আগের দেশের অন্যতম প্রধান জাতীয় দৈনিক যুগান্তরের জটজমাট নিউজ রুমের সেই রাতের কথা। দেশের সাংবাদিকতায় সফল সম্পাদক হিসেবে যে কয়জনের নাম শীর্ষে রয়েছে তাদের মধ্যে অন্যতম মরহুম গোলাম সারওয়ার ভাই তখন সম্পাদক। বর্তমান যুগান্তর সম্পাদক সাইফুল আলম ভাই তখন চিফ রিপোর্টার। সম্ভবত মরহুম রাশিদুন্নবী বাবু ভাই তখন নিউজ এডিটর। এছাড়া পীর হাবিবুর রহমান, মাহমুদ হাসান, রফিকুল ইসলাম রতন, ফকরুল আলম কাঞ্চন, সাইদুর রহমান রিমন, মুজতাহিদ ফারুকী, শাহনেওয়াজ করিমভাইসহ অনেকেই তখন যুগান্তর টিমে।
Advertisement
আমি তখন যুগান্তরের ক্রাইম টিমের (ফকরুল আলম কাঞ্চন ভাইয়ের নেতৃত্বে পিনাকি দাস গুপ্ত, তৌহিদুর রহমান,মরহুম শফিউল আলম রাজা) একজন তরুণ সদস্য। প্রায় প্রতিদিনই খুন, ডাকাতি ও ছিনতাইসহ নানা অপরাধের ঘটনা ঘটে। আমার দায়িত্ব ঢাকা মেডিকেলসহ অন্যান্য মেডিকেল কভার করা। মার্ডার বা অন্য ঘটনা ঘটলেই আগে মেডিকেলে আগে যায়। তাই মেডিকেল আর মর্গেই দিন কাটে।
সেই সময় তথ্যপ্রযুক্তির এতো সহায়তা পাওয়া যেতোনা। থানায় ফোন করে তথ্য পাওয়া যেতো বটে তবে সম্পাদক গোলাম সারওয়ার ভাইয়ের সাফ কথা ক্রাইমের যে কোন ছোট ঘটনাও স্পটে যেতে হবে। স্পটে গেলে নাকি রিপোর্টে তার গন্ধ পাওয়া যায়। কেউ না গেলে তিনি রিপোর্টে একবার চোখ বুলিয়ে এমনভাবে তাকাতেন যে আত্মারাম উড়ে যাওয়ার দশা হতো।
চিফ রিপোর্টার সাইফুল ভাই বিকেল চারটার মধ্যে ঘড়ি ধরে চেয়ারে বসতেন। কার কাছে কি আছে তা দ্রুত লিখে দিতে বার বার তাগাদা দিতেন। সন্ধ্যা হতে না হতেই তিনি দু’চারজন ছাড়া সবাইকে বাসায় চলে যেতে বাধ্য করতেন! আমরা লুকিয়ে ঘন্টা দু’ঘন্টা থেকে জমা দেয়া রিপোর্টটা পত্রিকার কোন পাতায় যাচ্ছে তা জানার চেষ্টা করতাম।
Advertisement
২০০২ সালের ১০ নভেম্বর খুন হন মডেল কন্যা তিন্নি। গুমের উদ্দেশ্যে ওই রাতে বুড়িগঙ্গার ১ নম্বর চীন মৈত্রী সেতুর ওপর থেকে নদীতে ফেলে দেওয়া হয় মরদেহ। কিন্তু পানিতে নয়, মরদেহটি পড়ে পিলারের উঁচু অংশে। পরদিন সকালে মরদেহ ঘিরে উৎসুক জনতা ভিড় করে। চারদিন পর অজ্ঞাত হিসেবে তার লাশ দাফন করা হয়।
সম্ভবত ১৫ নভেম্বর বা ১৬ নভেম্বর রাতে (সম্ভবত রাত ৮টা সাড়ে ৮টা) সাইফুল ভাইয়ের তাড়া খেয়ে মোটরসাইকেল নিয়ে বাসায় রওয়ানা হই। বাসার কাছাকাছি যেতেই সাইফুল ভাইয়ের ফোন, তুমি কোথায়? নিউমার্কেট থানায় যাও। বুড়িগঙ্গা সেতুর নিচে এক তরুণীর লাশ পাওয়া গেছে। ধারণা করা হচ্ছে ওটি মডেল কন্যা তিন্নির লাশ। তার বাবা থানায় বসে আছেন। সারওয়ার ভাই ডিটেইল কভার করতে বলেছেন বলে ফোন রেখে দিলেন।
বাসার কাছাকাছি হওয়াতে দ্রুত থানায় যাই। থানায় গিয়ে জিডির কপি সংগ্রহ করি। থানায় যে ভদ্রলোক বসে আছেন (তিন্নির বাবা) তাকে দেখে মডেল কন্যার বাবা মনে হলো না। নিতান্তই সাধারণ এক ভদ্রলোক। আভিজাত্যের কোন ছাপ নেই। তিনি জানালেন, তিন্নিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। প্রাথমিকভাবে বুড়িগঙ্গা ব্রিজের নিচ থেকে যে লাশ উদ্ধারের কথা শুনেছেন তার বর্ণনা শুনে মনে হয়েছে লাশটি তার মেয়ের।
জিডির কপি, তিন্নির বাবা ও থানার ওসির বক্তব্য নিয়ে দ্রুত বাসায় গিয়ে রিপোর্ট লিখে পাঠালাম। পরদিন প্রথম পাতায় সিঙ্গেল কলামে বাই নেমে ছাপা হলো ‘ বুড়িগঙ্গা সেতুর নিচ থেকে উদ্ধারকৃত লাশটি কি মডেল কন্যা তিন্নির’। রাতেই সাইফুল ভাই বলে দেন পরদিন যেন ভালভাবে কভার করি। ঘটনাস্থল কেরানীগঞ্জ থানা হওয়াতে পরদিন সকালে তিন্নির স্বামী ফ্যাশন ডিজাইনার পিয়ালের বিরুদ্ধে তিন্নির বাবা বাদি হয়ে মামলা করেন । সেদিনই কলাবাগানের বাসা থেকে গ্রেফতার হন পিয়াল। পিয়াল গ্রেফতার ও কেরানীগঞ্জ থানায় রয়েছে শুনে ছুটে যাই। পিয়ালের সঙ্গে কৌশলে কথা বললে অনেক তথ্য জানার চেষ্টা করি। তিনি দাবি করেন, তিনি নির্দোষ। তিন্নি তার শিশু কন্যাকে ফেলে চলে গেছে। সম্ভবত তিনি সেদিন ৯০’র ছাত্র নেতা ও সাবেক সাংসদ গোলাম ফারুক অভি জড়িত বলে জানিয়েছিলেন।
Advertisement
টাইম টু টাইম যা পাচ্ছি তাই সারওয়ার ভাই, সাইফুল ভাই ও ক্রাইম চিফ কাঞ্চন ভাইকে জানাচ্ছি। পরদিন বাই নেমে তিন কলাম শিরোনামে ‘ মডেল কন্যা তিন্নি খুন হয়েছেন’ প্রতিবেদন ছাপা হয়। সে সময়ে এ মার্ডারটি বহুল আলোচিত ছিল। সারওয়ার ভাই ও সাইফুল ভাইয়ের নির্দেশনায় সে সময় ঘন্টা মিনিটের হিসাব না করে কেবলই নতুন নতুন তথ্যের পেছনে ছুটেছি। সে সময় যুগান্তরের সার্কুলেশন তিন্নি ইস্যুর জন্য অনেক বেড়ে যায়। প্রতিদিন নানা অ্যাঙ্গেলে গোলাম সারওয়ার ভাইয়ের সুন্দর সুন্দর শিরোনামের কারণে নিউজ হিট হওয়ায় ক্রাইম রিপোর্টার হিসেবেও তখন আমার বেশ নাক ডাক হয়। অনেক বড় ভাইয়েরা দিন শেষে আমার কাছ থেকে তথ্য নিতো।
মনে পড়ে ওই সময় ‘তিন্নি হত্যার সাথে অভি জড়িত ’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর অভি যুগান্তর অফিসে ফোন করে আমাকে খোঁজাখুঁজি করে। আমার সঙ্গে কথা বলতে চায়। আমাকে না পেয়ে রিমনের (পরবর্তীতে পুলিশ কর্মকর্তা) কাছে নিজেকে নির্দোষ দাবি করে সাক্ষাৎকার দিলে সেই প্রতিবেদন ছাপা হয়। মামলাটি পরে সিআইডিতে গেলে ওই ঘটনায় সে সময়কার বেশ কয়েকজন টিভি তারকাসহ আরও কয়েকজনকে সিআইডি কার্য়ালয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এছাড়া একদিন কলাবাগানের বাসায় তিন্নির দেড় দুই বছরের মেয়েটিকে দেখে এসে ‘ আনুসকা কাঁদছে’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন বেশ পাঠকপ্রিয় হয়েছিল মনে পড়ে।
সিআইডির সঙ্গে তথ্যের জন্য বিভিন্ন স্থানে যাওয়া, রমজান মাসে তিন্নির ভাড়া বাসায় যাওয়া, ছিমছাম সুন্দর বাসার দেয়ালের চারদিকে নানা পোজের ছবি টাঙানো, রমজান মাসে পানি খেয়ে ইফতার করা ইত্যাদি বহু স্মৃতি আজ মনে পড়ছে। টানা মাস খানেক তিন্নি ফলোআপ প্রতিবেদন করতে গিয়ে সাধারণ এক সময়ের মডেল ও সিনেমার নায়িকা হওয়ার স্বপ্নে বিভোর হওয়া, প্রেমে পড়ে কিম্বা হুমকি ভয়ে স্বামী ও মেয়েকে ফেলে চলে যাওয়া, প্রতারিত হয়ে শেষ পর্য়ন্ত হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া-অনেক ঘটনার পেছনের ঘটনা পাঠককে জানাতে পেরেছিলাম।
হত্যাকাণ্ডের পর ১৯বছর পেরিয়ে গেছে। তিন্নি হত্যা মামলায় একমাত্র আসামি বরিশাল-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম ফারুক অভি।
আজ সোমবার (১৫নভেম্বর) মামলাটির রায় হওয়ার কথা রয়েছে। জানিনা মামলায় কি রায় হবে। এখন শুধু মনে পড়ছে প্রায় দুই দশক আগের বহুল আলোচিত এ মামলার বিচারের রায় এতো দীর্ঘসূত্রিতা কেন? জানিনা তিন্নির বাবা আজ বেঁচে আছেন কিনা? তিন্নির সেই ছোট মেয়েটি এখন অনেক বড় হয়ে গেছে, হয়তো দেশে কিম্বা বিদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা নাকি মায়ের স্নেহমায়াবঞ্চিত হয়ে বখে গেছে!
বহুল আলোচিত এ হত্যা মামলার রায় আজ যদি হয় তাহলে ১৯ বছর পর রায় হবে, তবে যে সকল হত্যাকাণ্ড আলোচিত হন, আদালতের বারান্দায় ঘুরে বেড়ানো কিম্বা উকিলদের খরচপাতি দেয়ার সামর্থ্য যাদের নেই তাদের হত্যাকাণ্ডের বিচার পেতে কতদিন লাগে, তাই বুঝি বলা হয়, ‘বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে।’
এইচআর/জেআইএম