সাগর-চাপা কলার রাজধানী হিসেবে খ্যাত নরসিংদী জেলা। আর এই জেলা শহরের প্রাণকেন্দ্রে এখন চলছে পৌর নির্বাচনের আমেজ। অত্যন্ত জনবসতির এই নগরীর চারিদিকে শুধু নির্বাচনী আলোচনা ছাড়া আর যেন কিছুই নেই। কে হবেন প্রয়াত মেয়র লোকমানের উত্তরসূরী। এমন আলোচনাই এখানকার সাধারণ ভোটারদের মাঝে। নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে ততই চিত্র পাল্টে যাচ্ছে। এখানে গোপনে গোপনে আওয়ামী লীগ-বিএনপি-জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীদের স্বতন্ত্র প্রার্থী কাইয়ুমের মোবাইল ফোন প্রতীকের পক্ষে কাজ করতে দেখা গেছে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের অনেক পদভারী নেতারা এখন মেয়র লোকমানের সবচেয়ে আস্থাভাজন শীর্ষ কাইয়ুমের পক্ষেই রয়েছেন বলে জানায় নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগের অনেক নেতা। শুধু তাই নয়, জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরা এখন স্বতন্ত্র প্রার্থী কাইয়ুমের পক্ষে রয়েছেন। নরসিংদীতে মেয়র লোকমানের প্রকৃত অনুসারিরা এখন তার ভাই কামরুলের পক্ষে নেই। আর এসব লোকজন এখন লোকমানের আস্থাভাজন শীর্ষ (সেকেন্ড ইন কমান্ড) কাইয়ুমের পক্ষেই রয়েছেন। নরসিংদী পৌর এলাকার সাধারণ ভোটারদের অতিপ্রিয় ব্যক্তি প্রয়াত মেয়র লোকমান। আর এই লোকমানের দোহাই দিয়েই ভোট চাওয়া হচ্ছে এখানে। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে একজন লোকমানের ছোট ভাই আরেকজন লোকমানের আস্থাভাজন শীর্ষ। তাদের একজন আওয়ামী লীগের নৌকা পেলেও অন্যজন পাননি। তবে মেয়র লোকমানের আস্থাভাজন শীর্ষ কাইয়ুমের মোবাইল ফোন প্রতীকের পাল্লাই ভারি রয়েছে বলে জানান সাধারণ ভোটার। অপরদিকে, বিএনপিতে একক প্রার্থী থাকলেও পক্ষে নেই পদভারী নেতারা। বিএনপির ধানের শীষের প্রার্থী সোহেল নাকি ডামি প্রার্থী এমন গুঞ্জন রয়েছে শহরে। শুধু তাই নয়, এখানে সাধারণ মানুষের মাঝে আলোচনা রয়েছে যে, নৌকা মার্কাতো অন্তরের, কিন্তু মানুষটা তো পছন্দের না। অপরদিকে, আওয়ামী লীগের (নৌকা) প্রার্থী কামরুল প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করছেন বিএনপিকে। কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন। মূলত এখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে ত্রিমুখী। অপরদিকে, সরকারের পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী লে. কর্নেল (অব.) নজরুল ইসলামের বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগও রয়েছে। তবে নরসিংদী জেলা বিএনপির সভাপতি খায়রুল কবির খোকন বলেন, আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে ধানের শীষের পক্ষে কাজ করছি।এদিকে, নরসিংদী শহরে গুঞ্জন রয়েছে, আওয়ামী লীগের নৌকায় ডাকাত ভর করেছে। এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী (মোবাইল ফোন) কাইয়ুম জাগো নিউজকে বলেন, কামরুল তিনটি ডাকাতি মামলার আসামি এবং ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিও দিয়েছেন। নেত্রীর সম্মান রক্ষার্থে ও নৌকাকে কলঙ্কমুক্ত করতে নির্বাচনে অংশ নিয়েছি।১০.০৮ বর্গ কিলোমিটারের নরসিংদী পৌরসভায় মোট ভোটার সংখ্যা ৮৭ হাজার ২৪ জন। এরমধ্যে পুরুষ ৪৩ হাজার ৩৭৮ জন ও নারী ৪৩ হাজার ৬৪৫ জন। এখানে মেয়র পদে ৫ জন, ৯টি ওয়ার্ডে সাধারণ কাউন্সিলর পদে ৪৭ জন এবং সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর পদে ১১ জন প্রার্থী নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। এখানে আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের মেয়র প্রার্থী কামরুল ইসলাম, বিএনপি মনোনীত ধানের শীষ প্রতীকের সাইফুল ইসলাম সোহেল, আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী স্বতন্ত্র মোবাইল ফোন প্রতীকের এসএম কাইয়ুম, জাতীয় পার্টির (মঞ্জু) মনোনীত বাইসাইকেল প্রতীকের সাদেকুর রহমান সাদেক, ন্যাশনাল পিপলস পার্টি আম প্রতীকের ফারজানা আক্তার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তবে একমাত্র নারী মেয়র প্রার্থী থাকলেও প্রচারণায় মাঠে নেই।সরেজমিনে দেখা গেছে, রাজধানী ঢাকার পূর্বে বাণিজ্যিক নগরী হিসেবে খ্যাত নরসিংদী শহরের চারিদিকে শুধু নির্বাচনী প্রচারণা। যেদিকে তাকানো যায়, সেদিকেই শুধু পোস্টার আর পোস্টার। শহরের এই গলিতে যদি থাকে নৌকার মাইকিং তো পাশের অন্য গলিতে রয়েছে ধানের শীষের মাইকিং। আবার পাশেরই আরেকটি গলিতে রয়েছে মোবাইল ফোনের মাইকিং। নির্বাচনকে ঘিরে এ যেন এক উৎসবের নগরীতে পরিণত হয়েছে। দুপুরেই জেলা আওয়ামী লীগের অফিস প্রাঙ্গণে দেখা হয় বর্তমান মেয়র আওয়ামী লীগের (নৌকা) মেয়র প্রার্থী কামরুল সঙ্গে। এসময় তিনি নেতাকর্মীদের নির্বাচনী বিভিন্ন কার্যক্রমের খোঁজ খবর নিতে দেখা যায়। সকালে তিনি নিজ বাড়ি বাসাইল এলাকায় গণসংযোগ করেন। পরে দলীয় কার্যালয়ে সাধারণ শ্রমিকদের সঙ্গে বৈঠক করেন। ২টার দিকে দলীয় আইনজীবীদের নিয়ে গণসংযোগ করেন। বিকেলে বালুরমাঠ ও বানিয়ারছলে পথসভা করেন।বর্তমান মেয়র নৌকার প্রার্থী কামরুল বলেন, যারা আমার ভাই লোকমানকে হত্যা করেছে, আজ তারাই কাইয়ুমের সঙ্গে নির্বাচনী কার্যক্রমে অংশ নিচ্ছেন। লোকমান হত্যার আসামি মতিন সরকার বিভিন্ন এলাকায় মোবাইল ফোনের ভোট চেয়ে বেড়াচ্ছেন। তিনি আরও বলেন, আমি ভাই লোকমানের লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছি এবং এর ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে জনগণ আমাকে আবারও নির্বাচিত করবেন। আমি ২৫০টির মতো ছোট-বড় ড্রেন ও রাস্তা করেছি। নতুন করে সাড়ে ১৫ কোটি টাকার উন্নয়নের একটি টেন্ডার করিয়েছি।অপরদিকে, বিএনপির প্রার্থী সাইফুল ইসলাম সোহেলের সঙ্গে দেখা হয় চৈতালপাড়া এলাকায়। এসময় সোহেলকে দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে গণসংযোগ করতে দেখা যায়। তিনি বলেন, আমার কর্মী-সমর্থকদের পুলিশ দিয়ে গ্রেফতার করাচ্ছেন নৌকার প্রার্থী। জেলা ছাত্রদলের সহ-প্রচার সম্পাদক মাইনউদ্দিনের বাড়ি ভাঙচুর করে তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। আমার লোকজনদের হুমকি, ধামকি দেয়া হচ্ছে।অন্যদিকে, আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী এসএম কাইয়ুম সকালে একটি সংবাদ সম্মেলন করেন। পরে বিকেলে সাটিরপাড়ায় একটি কর্মীসভায় অংশ নেন। বিদ্রোহী প্রার্থী এসএম কাইয়ুম বলেন, আমার সঙ্গে আওয়ামী লীগের সকল নেতাকর্মীরা রয়েছেন। কিন্তু তাদেরকে বিভিন্নভাবে হুমকি, ধামকি দিচ্ছেন কামরুলের লোকজন। তিনি আরও বলেন, এক সময় এই শহরকে একটি সুন্দর পরিবেশে নিয়ে এসেছিলেন মেয়র লোকমান। আর আমিই ছিলাম সেইসব কাজের দ্বিতীয় ব্যক্তি। কিন্তু লোকমান ভাই মারা যাবার পর এখন নরসিংদীতে পুনরায় সন্ত্রাসী, মাদক, অস্ত্রের খেলা শুরু হয়েছে। যাদের বিরুদ্ধে লোকমান ভাই ও আমি আন্দোলন করেছি আজ তারাই কামরুলের কাছের লোক। তিনি বলেন, কামরুলের আচরণে দলীয় নেতাকর্মী এখন জেলা আওয়ামী লীগের অফিসে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। শহরের কালিবাজারের কাপড় ব্যবসায়ী শ্রীকান্ত দাস বলেন, আমরাতো সবসময় নৌকায় ভোট দেই। এইবার কি যে করি তার ঠিক নাই।ভেলানগর মোড়ের অটো চালক সুমন জানান, লোকমান ভাই ভালা লোক ছিল। এহন লোকমান ভাইয়ের কাছের একজনকেই ভোটটা দিমু। ব্রাহ্মনদী এলাকার মতিন বলেন, নৌকাতো আমাগো মার্কা, তয় ভাবছি নৌকাতেই ভোটটা দিমু।নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মতিন ভূইয়া বলেন, আমরা আওয়ামী লীগের সকল নেতাকর্মী ঐক্যবদ্ধভাবে নৌকার পক্ষে কাজ করছি। মোবাইল প্রতীকের পক্ষে কেউ নেই। নৌকা যেহেতু আমাদের নেত্রীর মার্কা সেহেতু আমরা অন্য কোনো চিন্তা করতে পারি না।নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও জেলা পরিষদের প্রশাসক অ্যাডভোকেট আসাদুজ্জামান বলেন, এখানে মূলত তিনজনের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। আমরা সরকারের লোক সরকারের প্রার্থীর পক্ষেই আছি।জাতীয় পার্টির সাবেক সাংসদ মেজর (অব.) শামসুল হুদা বাচ্চু বলেন, আমরা এখনো দলীয়ভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নেইনি। তবে সাধারণ কর্মীদের মোবাইল প্রতীকের পক্ষে কথা বলতে দেখা যায়।নরসিংদী জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি সফিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, প্রকাশ্যে ভোট চেয়ে লাভ কী? গোপনে গোপনে ভোট দেবো। গোপনে গোপনে ভোটও চাইবো।নরসিংদী জেলা বিএনপির সভাপতি খায়রুল কবির খোকন জাগো নিউজকে বলেন, নরসিংদীতে ধানের শীষের জোয়ার বাইছে। আর এই জোয়ার কেউ আটকে রাখতে পারবে না। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে জয় আমাদের ঘরেই আসবে।এদিকে বিদ্রোহী স্বতন্ত্র প্রার্থী কাইয়ুমের সমর্থকদের হাত-পা কেটে ফেলার হুমকি দেয়া হয়েছে বলে থানায় একটি জিডি করেছেন কাইয়ুমের কর্মী সজিব।রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সুরাইয়া বেগম জাগো নিউজকে বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করতে সকল প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে তিন প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। পাশাপাশি র্যাব, পুলিশ, আনসারসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য প্রস্তুত রয়েছে।এমজেড/পিআর
Advertisement