ঝটিকা সফরে কুমিল্লা ভ্রমণ শেষে যাত্রা এবার পাশের জেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়া। তপ্ত রোদে নির্মেয়মাণ ছয়লেনের সড়ক ধরে এগোনো। ব্যাপক কর্মযজ্ঞ চলায় গাড়ি একটু ধীরগতিতেই চলছিল। ৭৫ শতাংশ ভারতীয় ঋণে হওয়া সড়কটি আশুগঞ্জ নৌবন্দর থেকে আখাউড়া হয়ে আগরতলায় ঢুকেছে। আশুগঞ্জ নৌবন্দর থেকে সরাইল বিশ্বরোড মোড়, সেখান থেকে আখাউড়ার ধরখার। পরে ঢুকেছে ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলায়। সড়কটির কাজ সম্পন্ন হলে এ অঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্য, পরিবহনে উন্মুক্ত হবে নতুন দিগন্ত।
Advertisement
এ সড়ক ধরেই ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরে ঢোকা। পথে পড়লো জেলা কারাগার। তবে শহরের বেশ বাইরে। থাকা হবে সাকুল্যে ঘণ্টা চারেক। এর মধ্যে কাছাকাছি দর্শনীয় স্থান দেখে নেওয়া হলো নেট ঘেঁটে। পরবর্তী গন্তব্য নরসিংদী। তাই সিদ্ধান্ত হলো যাত্রাপথে যা পড়বে সেটা দেখা হবে। মধ্যাহ্নভোজ শেষে সেই মোতাবেক সুর সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সংগীত একাডেমি দিয়ে শুরু হলো দর্শন। কদিন আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে ছড়ানো গুজবে সহিংসতার বলি হয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি। সহিংসতায় পুড়ে যায় প্রতিষ্ঠানটির অনেক মূল্যবান সম্পদ। ক্ষত শুকিয়ে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে আবার নতুন রূপ পেলেও অন্দরে প্রবেশ করা গেলো না কেয়ারটেকার না থাকায়। ম্যুরালের সঙ্গে ছবি তুলে পরবর্তী গন্তব্য কালভৈরবের মন্দির। চাউর আছে এটা নাকি এই উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় শিবমূর্তি। তবে কোনো দালিলিক প্রমাণ মেলে না।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরের মেড্ডা এলাকায় যখন আমাদের গাড়ি থামলো তখন সূর্য হেলান দিয়েছে পশ্চিম কোণে। সড়ক থেকেই চোখে পড়ে মন্দিরটির বিশাল তিনটি মঠ। একটু সামনে এগোতেই গেট ঠেলে পা রাখতে রাখতেই দৃষ্টি পড়লো খোদাই করা লেখার দিকে। লেখা ‘শ্রী শ্রী কালভৈরব নাটমন্দির’। তিতাস নদীর তীরবর্তী এলাকায় মন্দিরটি অবস্থান।
উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে, এটি মূলত কালভৈরবের মূর্তির জন্য বিখ্যাত। কালভৈরব হচ্ছে হিন্দু দেবতাবিশেষ। অন্যতম প্রধান দেবতা শিবের অংশ থেকে বা দেহ থেকে জাত ভৈরব।
Advertisement
মন্দিরটির প্রধান আকর্ষণই হচ্ছে কালভৈরব বা শিবমূর্তি। সুবিশাল মূর্তিটির উচ্চতা ২৮ ফুট। বিশাল আকৃতিবিশিষ্ট ও চোখ ধাঁধানো মূর্তিটি ১৯০৫ সালে তৈরি করা হয়। মূর্তিটির ডান পাশে রয়েছে একটি কালীমূর্তি এবং বাম পাশে পার্বতী দেবী। তবে বিশাল আকৃতির এ মূর্তিটি দেখে যে কেউই প্রথমে ভড়কে যেতে পারেন। মন্দিরের মূল কালভৈরবের বয়স প্রায় তিনশ বছর।
কথিত আছে, কালীশ্বর শ্রীশ্রী কালভৈরবের আবির্ভাবের পর স্বপ্নে আদেশ পেয়ে স্থানীয় দূর্গাচরণ আচার্য মাটি দিয়ে নির্মাণ করেন এই বিরাটাকার কালভৈরবের বিগ্রহ। তিনি ছিলেন ফুলবাড়িয়া গ্রামের স্থায়ী অধিবাসী ও প্রখ্যাত মৃন্ময়মূর্তি প্রস্তুতকারক শিল্পী। তিনি মূর্তির পাশে নির্মাণ করেন শিবের স্ত্রী পার্বতীর মূর্তি। দুর্গাচরণ প্রথমে তিতাস পঞ্চবঢী মূলে মূতিটি স্থাপন করে পূজা অর্চনার ব্যবস্থা করেছিলেন, যা চলমান থাকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত।
মুক্তিযুদ্ধের সময় কালভৈরবের বিগ্রহটি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নজরে এলে তারা বৈদ্যুতিক ডিনামাইটের আঘাতে শিব ও পার্বতী মূর্তির অনেকাংশ ক্ষতিগ্রস্ত করেন। পরে এটি মেরামত করা হয়। তবে এখানেই শেষ নয়, ২০০৯ সালের ১২ জুন মন্দিরের তালা ভেঙে কে বা কারা শত বছরের পুরনো শিবলিঙ্গটি চুরি করে নিয়ে যায়। যদিও তিন মাস পর এটি উদ্ধার করেন র্যাব সদস্যরা।
মন্দিরের ভেতরে কালভৈরবের বিগ্রহটি লোহার ফটকে সব সময় তালাবদ্ধ থাকে। মন্দিরটি পরিদর্শনের সময় দেখা গেলো কয়েকজন নারী-পুরুষ বিগ্রহ দর্শন শেষে বাইরে এসে মোম জ্বেলে প্রণাম করছেন। ভেতরে ঢুকে দেখা গেলো বিশালাকায় মূর্তিটির বিশাল বপু। মাথা ঠেকে আছে মন্দিরের ছাদে। প্রশস্ত মধ্যপ্রদেশ উঁচিয়ে পায়ের উপর হাত রেখে বসে আছেন শিব। জটা বিছিয়ে কাঁধজুড়ে। হাতের ডান পাশে বিশাল এক ত্রিশুল। সামনে থেকে না দেখলে মূর্তিটির বিশালতা আন্দাজ করা যায় না। মন্দিরটির ডান পাশে রয়েছে শ্রী শ্রী শনিদেবের বিগ্রহ মন্দির।
Advertisement
জানা যায়, কালভৈরব মন্দিরের জায়গাটি দান করেছিলেন সরাইলের বিখ্যাত জমিদার নূর মোহাম্মদ। প্রতি বছর ফাল্গুন মাসে চারদিনব্যাপী পূজা ও প্রতিষ্ঠা উৎসব অনুষ্ঠান পালন করা হয়। পূজা অনুষ্ঠানে ভারত, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, ইংল্যান্ড, জাপান, চীনসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে পূজারিরা ভিড় জমান। দেশ-বিদেশ থেকে বহু পর্যটকও এখানে ভিড় করেন এসময়। উৎসব ঘিরে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
সরাইল বিশ্বরোডে এসে রিকশা বা সিএনজি অটোরিকশায় করে যাওয়া যাবে ঐতিহাসিক এ মন্দিরে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলওয়ে স্টেশন থেকে লোকাল পরিবহনেও যাওয়া যাবে।
মন্দিরটি ঘুরে দেখতে দেখতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে আসে। এবার ফেরার পালা। তবে ঐতিহাসিক এ স্থাপত্যকর্ম সাগ্রহে দেখানোর জন্য বিশেষ ধন্যবাদ পেতেই পারেন জাগো নিউজের জেলা প্রতিনিধি রাফি ভাই।
এসআর/এএ/এমএস