জাগো জবস

বাধা পেরিয়ে পররাষ্ট্র ক্যাডারে চতুর্থ হন সৌরভ

সৌরভ বিজয় ৩৮তম বিসিএসে পররাষ্ট্র ক্যাডারে উত্তীর্ণ হন। তার জন্ম চট্টগ্রামে হলেও বেড়ে ওঠা ঢাকায়। তার বাবা জিপি দাশ গুপ্ত একজন এলএমএফ ডাক্তার। মা মৃত কৃষ্ণা দাশ গুপ্ত গৃহিণী ছিলেন। সৌরভ ২০০৯ সালে কদমতলা পূর্ববাসাবো স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি ও ২০১১ সালে নটর ডেম কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে ইলেক্ট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে স্নাতক শেষ করেন। স্নাতক শেষ করে গ্রিন ইউনিভার্সিটিতে দুই বছর শিক্ষক হিসেবে ছিলেন। তারপর পিজিসিবিতে সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে প্রায় এক বছর ছিলেন। পরবর্তীতে বিভিন্ন কারণে স্নাতকোত্তর শেষ করেননি।

Advertisement

বর্তমানে তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব পদে কর্মরত। সম্প্রতি তার বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া, ভবিষ্যৎ স্বপ্ন ও সফলতার গল্প শুনিয়েছেন জাগো নিউজকে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আনিসুল ইসলাম নাঈম—

জাগো নিউজ: আপনার শৈশব ও বেড়ে ওঠার গল্প দিয়ে শুরু করতে চাই—সৌরভ বিজয়: শৈশব বলতে গেলে একটি সংগ্রামের মধ্যেই কেটেছে। ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত মায়ের কাছেই ছিলাম। তারপর ঢাকায় চলে আসি। ঢাকায় আমি ও বড় ভাই একসাথে থাকতাম। তারপর একটি স্কুলে ভর্তি হই। যখন ক্লাস সিক্সে উঠি; তখন মা ঢাকায় চলে আসেন। সেখান থেকে অষ্টম শ্রেণিতে পাস করি। মা আমাদের জন্য প্রচুর কষ্ট করতেন। তিনি সব সময় আমাদের পড়াশোনার কথা বলতেন। তিনি চাইতেন, যা-ই করি পড়াশোনা যেন চালিয়ে যাই। শত প্রতিকূলতা থাকা সত্তেও তিনি আমাদের পড়াশোনা চালিয়ে নিয়ে গেছেন। আমি যে পরিবেশে বড় হয়েছি, প্রথমে খুব বেশি প্রতিষ্ঠিত মানুষ কমই দেখেছি। যখন কলেজ ও ভার্সিটিতে গেলাম; তখন ভালো স্টুডেন্টদের সাথে পরিচয় হয়। তাদের পরিবেশ ও চিন্তা-ভাবনা ফলো করতাম। নিজের জন্য বড় অনুপ্রেরণা ছিল আমার বড় ভাই। তিনি অনেক পরিশ্রম করতেন। তাছাড়া মায়ের ক্যান্সার ছিল। তখন ফ্যামিলির হাল ধরার দায়িত্ব তার ওপর চলে আসে। প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য ভাইয়া কম সময় পেয়েছেন। আমার একটি বড় গাইডলাইন ছিলেন। তিনি সব সময় আমাকে ভালো কিছু হওয়ার পরামর্শ দিতেন। শৈশবে কিছু সুখের স্মৃতিও ছিল। তাছাড়া মানুষের ভালাবাসাও পেয়েছি। পাশাপাশি কিছুটা কষ্টের মুহূর্তও ছিল, পরিশ্রম করেছি অনেক।

জাগো নিউজ: পড়াশোনায় কোনো প্রতিবন্ধকতা ছিল কি?সৌরভ বিজয়: পড়াশোনায় প্রতিবন্ধকতা কিছুটা ছিল। আর্থিক ও সামাজিকভাবে চিন্তা করলে অবশ্যই ছিল। শুরুতে ভালো টিচার ও ভালো স্কুলে পড়তে পারিনি। ভালো গাইডলাইন পাইনি। তবে ইচ্ছে ও পরিশ্রম থাকলে প্রতিবন্ধকতা দূর করা যায়। তখন মনে হয়েছিল এসব প্রতিবন্ধকতা কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এসব প্রতিবন্ধকতা ছিল বলেই আমার উন্নতি হয়েছে। এখন এসব পজিটিভভাবে নিই।

Advertisement

জাগো নিউজ: বিসিএসের স্বপ্ন দেখেছিলেন কখন থেকে?সৌরভ বিজয়: বিসিএস ক্যাডার সম্পর্কে অনার্স তৃতীয় বর্ষ পর্যন্ত তেমন কিছু জানতাম না। যখন অনার্স ফাইনাল ইয়ারে এলাম; তখন চিন্তা করলাম কী জব করা যায়? আমার সাবজেক্টে পড়ে বেশিরভাগ স্টুডেন্ট স্কলারশিপ নিয়ে দেশের বাইরে চলে যায় এবং সেখানেই সেটেল্ড হয়ে যায়। তাছাড়া দেশে পাওয়ার সেলে জব করা যায়। তখন হতাশায় ছিলাম। দেশে থাকবো, না কি দেশের বাইরে চলে যাবো! তখন দাদা ৩৬তম বিসিএসের জন্য প্রিপারেশন নেন। দাদার প্রিপারেশন ও পড়াশোনা দেখে কৌতূহলবশত বিসিএস সম্পর্কে জানতে চেষ্টা করলাম। যারা ক্যাডার হয়েছেন, তাদের সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিই। আশেপাশের সিনিয়রদের থেকে পরামর্শ নিতে শুরু করলাম। ফাইনালি সিদ্ধান্ত নিই বিসিএসের জন্য ট্রাই করবো। মনে আছে, ২০১৭ সালের এপ্রিল মাস থেকে বিসিএসের জন্য প্রিপারেশন নেওয়া শুরু করি। ৩৮তম বিসিএসের সার্কুলার হয়েছিল ২০১৭ সালের জুন মাসে। এটাই আমার প্রথম বিসিএস ছিল।

জাগো নিউজ: বিসিএস যাত্রার গল্প শুনতে চাই, প্রস্তুতি কিভাবে নিয়েছেন?সৌরভ বিজয়: ২০১৭ সালের এপ্রিল থেকে সিদ্ধান্ত নিই বিসিএস দেবো। বড় ভাইয়ের তখন প্রিলি এবং রিটেন হয়ে গিয়েছিল। তাই বলা যায়, প্রস্তুতির বেশ কিছু বই বাসায় ছিল। এগুলোই পড়া শুরু করলাম। আসলে আমাদের সাবজেক্ট ছিল সায়েন্স ব্যাকগ্রাউন্ড। কিন্তু বিসিএস সম্পর্কে বিস্তৃতভাবে চিন্তা করতে হয়। ম্যাথ, বাংলা ও ইংরেজি সাহিত্য সম্পর্কে তেমন ধারণা ছিল না। এজন্য প্রথমে হতাশা চলে আসে। তাই প্রিলির ক্ষেত্রে কিছু টেকনিক অ্যাপ্লাই করে পড়ার চেষ্টা করেছি। বিগত ১০-৩৫তম বিসিএস পর্যন্ত সবগুলো প্রশ্ন দেখেছি। বোঝার চেষ্টা করেছি পিএসসি আসলে কী ধরনের প্রশ্ন করে। কোন টপিক, সাবজেক্ট ও প্রশ্নগুলে ফলো করে। প্রিলি, রিটেন ও ভাইবায় পিএসসি যেসব বিষয় বেশি ফোকাস করেছে, সেগুলোতে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার চেষ্টা করি। এসব বিষয় থেকে ধারণা নিয়ে প্রিলির জন্য প্রিপারেশন শুরু করি। বেশি বেশি প্র্যাকটিস করেছি ও নিজে নিজে মডেল টেস্ট দিয়েছি। সময়ের কারণে কোনো কোচিংয়ে ভর্তি হইনি। প্রিলি দেওয়ার পর একটু কনফিউশনে ছিলাম, পাস করবো কি না! যা-ই হোক, প্রিলি পাস করলাম। এরপর রিটেনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করলাম। রিটেনে যে যত ভালোভাবে প্রশ্ন উপস্থাপন করবে; সে তত ভালো নাম্বার পাবে। আমি ফরম্যাট ধরে রিটেনের প্রস্তুতি নিয়েছি। পাশাপাশি যেগুলোয় মনে হয়েছে কম নাম্বার পাবো; সেখানে বেশি গুরুত্ব দিতে থাকি। বিসিএস রিটেন হচ্ছে এমন একটি পরীক্ষা, যেখানে ভাইবা ও বিসিএসের রেজাল্ট নির্ধারিত হয়ে যায়। পরবর্তীতে মেধাতালিকার ক্যাডার লিস্ট রিটেনের নাম্বার থেকে যোগ হয়। তাই রিটেনে সর্বোচ্চ নাম্বার উঠানো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এখানে ম্যাক্সিমাম বা সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। রিটেনে ভালো একটি প্রস্তুতি নিয়েছিলাম এবং ভালো ফরম্যাটে সব লিখে দেওয়ার চেষ্টা করেছি। রিটেন ভালো হয়েছিল এবং রেজাল্ট পজিটিভ এসেছে। ভাইবা একটি ভাগ্যের ব্যাপার। দেখা গেল, অনেক কিছু পড়ে গেলাম কিন্তু কোনো কিছুই ধরলো না। তাই ভাইবার জন্য পরিপূর্ণ প্রস্তুতি নিতে হবে। ১২ জনের মধ্যে আমার ভাইবার পজিশন ছিল ৫ম। ভাইবায় নূরজাহান ম্যাম ছিলেন। যদিও আগে থেকে ভয়ে ছিলাম কিন্তু ম্যামকে ভালো মনে হয়েছে। ভাইবা ১৫-১৬ মিনিট হয়েছিল। এ সময়ে ম্যামকে মনে হয়েছে চমৎকার স্মার্ট একজন মানুষ। তিনি যুক্তি দিয়ে সুন্দরভাবে কথা বলেন। কোনোভাবে আমাকে বিব্রত করেননি, সব কিছু যুক্তি দিয়ে বুঝিয়েছেন। এছাড়া আরও দুজন টিচার ছিলেন। তারাও আমাকে সহযোগিতা করেছেন। সব মিলিয়ে আমার ভাইবার অভিজ্ঞতা চমৎকার ও ভালো ছিল। আমাদের সার্কুলার হয়েছে ২০১৭ সালের জুন মাসে কিন্তু আমি জয়েন করেছি ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে। এ দীর্ঘ সময় পার করতে অনেক ধৈর্য ধরতে হয়েছে। বিসিএসে পড়াশোনার পাশাপাশি মানসিক ধৈর্যেরও একটি পরীক্ষা হয়ে যায়।

জাগো নিউজ: পর্দার আড়াল থেকে কেউ অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে?সৌরভ বিজয়: জীবনে সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা ছিল আমার মা। যদিও তখন তিনি ছিলেন না। তার অনুপস্থিতির বিষয়টাও আমাকে অনুপ্রেরণা দিয়েছে। তিনি সব সময় চাইতেন পড়াশোনা করে যাতে ভালো কিছু হই। তাছাড়া আমার বড় ভাই সুজন দাশ গুপ্ত সব সময় ভালো গাইডলাইন দিতেন। তিনি ৩৬তম বিসিএসে অ্যাডমিন ক্যাডার পান। এছাড়া পরিচিতজনরা উৎসাহ দিতেন ধৈর্য ধরে লেগে থাকার জন্য।

জাগো নিউজ: নতুনরা বিসিএস প্রিলির জন্য কীভাবে প্রস্তুতি নেবেন?সৌরভ বিজয়: প্রিলিটা বিসিএসের জন্য একটি টিকিট মাত্র। প্রিলির ক্ষেত্রে আগের বছরের প্রশ্নগুলো পড়বেন এবং সিলেবাস বুঝার চেষ্টা করবেন। কোন বিষয়গুলো বেশি আসছে এবং কোনগুলো বেশি পড়তে হবে এসব নিয়ে ভালো একটি ধারণা হয়ে যাবে। সেই অনুযায়ী পরিশ্রম ও প্র্যাকটিস করা শুরু করবেন। বিসিএসে সবাই ভিন্ন সাবজেক্ট নিয়ে আসেন। তাই পড়া সবার মনে থাকে না। এজন্য নিয়মিত রুটিন করে পড়াশোনা করতে হবে এবং পড়া রিভিশনের উপর রাখতে হবে। প্রিলির প্রস্তুতি শেষে নিজের অবস্থান বোঝার জন্য মডেল টেস্ট দিতে হবে। ভুল হলে সংশোধনের চেষ্টা করতে হবে। যারা মেসে থাকেন; তারা অন্যদের সঙ্গে উভয়ের চিন্তা-ভাবনা শেয়ার করে পড়াশোনা করতে পারেন।

Advertisement

জাগো নিউজ: প্রিলি শেষ করার পর বিসিএস লিখিত প্রস্তুতি নিয়ে আপনার পরামর্শ কী?সৌরভ বিজয়: বিসিএস ক্যাডার হওয়ার জন্য রিটেন একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা। কারণ রিটেন ও ভাইবার নাম্বার যোগ করে বিসিএস ক্যাডার লিস্ট তৈরি করা হয়ে থাকে। সবচেয়ে বেশি রিটেনে গুরুত্ব দিতে হবে। রিটেনে পাস করার পাশাপাশি ভালো নাম্বার তুলতে হবে। এজন্য প্রশ্নের ক্যাটাগরি ঠিক করা, উত্তর দেওয়ার ফরম্যাট ঠিক করা, বাসায় নমুনা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে প্র্যাকটিস করা এবং বিভিন্ন সাবজেক্টের ছোট ছোট নোট তেরি করে রাখতে হবে। পত্রিকা ও অন্যান্য জায়গা থেকে কমন ইনফরমেশনগুলো নোট করে রাখা। নোটগুলো সব সাবজেক্টের পরীক্ষার আগে দেখে যেতে হবে। রিটেনে সময় একটি বড় বিষয়। লম্বা সময়ের পরীক্ষা এবং প্রচুর প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়। বাসায় আগে থেকে লেখার প্র্যাকটিস করতে হবে এবং কম সময়ে সব প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। লেখার ক্ষেত্রে ভালো কলম নির্বাচন এবং ছোট ছোট বিষয়গুলো গুছিয়ে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে হবে।

জাগো নিউজ: বিসিএস ভাইবার প্রস্তুতি কেমন হতে হয়?সৌরভ বিজয়: ভাইবা অনেকটাই ভাগ্যের ওপর নির্ভর করে। তারপরও পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতি নিয়ে ভাইবায় অংশগ্রহণ করতে হবে। ভাইবা বোর্ডে যতক্ষণ থাকবেন; ততক্ষণ ধৈর্য নিয়ে ভদ্রভাবে কথা বলতে হবে। সব সময় কনফিডেন্ট থাকতে হবে। ক্যাডার হতে নতুন কিছু শেখা ও জানার আগ্রহ রাখতে হবে। যাতে অর্জিত জ্ঞান পরবর্তীতে প্রয়োগ করতে পারে। যাদের নির্ধারণ করা হবে তারা কেউ পারফেক্ট না। তাদের ট্রেনিং দিয়ে ক্যাডার হিসেবে তৈরি করা হয়।

জাগো নিউজ: আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?সৌরভ বিজয়: বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ উন্নত দেশ হবে। সেই লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে আমরা কাজ করছি। একটি উন্নত দেশের যে কয়টি সেক্টর থাকে, আমাদের দেশে সেসব সেক্টর এখনো হয়নি। ইচ্ছে আছে ভালো একটি সেক্টর নিয়ে কাজ করে দেশের উন্নয়নে অবদান রাখবো। অলরেডি বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করা হয়েছে। কিন্তু একসময় আমাদের দেশ থেকে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করা হবে। সরকার যখন এখানে নজর দেবে; তখন আমি এই সেক্টরে যতটুকু সম্ভব কাজ করবো। তাছাড়া দেশের উন্নয়নে অবদান রাখতে পারলে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে হবে।

এসইউ/জিকেএস