দেশজুড়ে

সচেতন না হলে পুরান ঢাকায় রূপ নেবে রংপুর

কর্মসংস্থান, শিক্ষা-স্বাস্থ্যসহ নানা সুযোগ-সুবিধা এবং নাগরিক জীবনে সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের কথা ভেবে বিভাগীয় নগরী রংপুরের প্রতি আকর্ষণ বাড়ছে মানুষের। মৌলিক পেশায় আগ্রহ হারিয়ে নিজ এলাকা ছেড়ে এ শহরে পাড়ি জমাচ্ছে মানুষ। এ অবস্থায় দিনে দিনে বাড়ছে এর জনসংখ্যা। কিন্তু সক্ষমতার অভাবে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। ফলে দিনে দিনে অস্বাস্থ্যকর পরিস্থিতির আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে বিভাগীয় এ নগরীতে।

Advertisement

টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে না ওঠা, পানি নিষ্কাশনের অন্যতম শ্যামাসুন্দরী খালের দূরাবস্থা, অনুমোদনহীন ভবন নির্মাণ এবং অনিয়ন্ত্রিত অটোরিকশা চলাচলসহ নানা কারণে অপরিকিল্পত নগরী হিসেবে গড়ে উঠছে রংপুর।

নগরীর প্রধান সড়কসহ পাড়া-মহল্লার সড়ক সম্প্রসারণ, ভবন নির্মাণ ও নিয়ন্ত্রণ করা, সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থপনা এবং পানি নিষ্কাশনের সুব্যবস্থা করা না গেলে আগামী ২০৪০ সালে পুরান ঢাকার মতোই রংপুর নগরী রূপ ধারণ করবে বলে মনে করা হচ্ছে। সিটি কর্পোরেশন গঠনের পর ২০১৪ সালে ৩৫ বছর মেয়াদী মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করে তা অনুমোদনের জন্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হলেও তা ঝুলে আছে। এ অবস্থায় রংপুর সিটি কর্পোরেশেনে দক্ষ জনবল বৃদ্ধি, উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে মাস্টার প্ল্যান বাস্তবায়ন ও নগরবিদদের নিয়ে দ্রুত পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ওপর মত দিয়েছেন সচেতন মহল।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, মাত্র ৭ হাজার লোকসংখ্যা নিয়ে ১৮৬৯ সালের ১ মে যাত্রা শুরু করে রংপুর মিউনিসিপ্যালিটি। কালের বিবর্তনে ২০১২ সালের ২৮ জুন ২০৫.৭০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা নিয়ে গঠিত হয় সিটি কর্পোরেশন। ২০১৯ সালের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী ৩৩টি ওয়ার্ডে এর জনসংখ্যা প্রায় ৮ লাখ।

Advertisement

সূত্র মতে, প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১০০ টন বর্জ্য উৎপাদন হলেও ৭০ শতাংশ অপসারণ করা সম্ভব হয়। অপসারিত বর্জ্য দিয়ে কপোস্ট প্লান তৈরি করার কথা থাকলেও তা দীর্ঘদিন ধরে থমকে আছে।

এদিকে অনিয়ন্ত্রিতভাবে অটোরিকশা চলাচল করায় হচ্ছে না যানজট নিরসন। বিশেষ করে নগরীর অন্যতম এলাকা টাউনহলের সামন থেকে প্রেসক্লাব চত্বর পর্যন্ত অসহনীয় যানজটে নাকাল হতে হয় নগরবাসীকে। এছাড়া অনুমোদনহীন ভবন নির্মাণ ও নগরীর বিভিন্ন সড়ক সংকুচিত হয়ে আসায় আধুনিক মানসম্মত নগরী গড়ার কার্যক্রম রয়েছে ঝুঁকির মধ্যে।

জলাবদ্ধতা নিরসনের অন্যতম নগরীর শহরের বুক চিরে বয়ে যাওয়া শ্যামাসুন্দরী খাল। একটা সময় এই শ্যামাসুন্দরী খালের জন্য দীর্ঘদিন নগরীতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হতো না। সহজে পানি নিষ্কাশন হতো। কিন্তু বর্তমানে খালটি সংস্কার না হওয়ায় পানি অপসারণের ক্ষমতা হারিয়েছে।

২০০৭ থেকে ২০১৩ সালে সাত বছরে দুই দফায় কিছুটা সংস্কার হলেও পরে দীর্ঘ সময়ে শ্যামাসুন্দরী খাল সংস্কার করা হয়নি। যদিও ২০১৯ সালে পানি উন্নয়ন বোর্ড শ্যামাসুন্দরী খাল পুনর্খননের কাজ হাতে নিলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। দীর্ঘ সময়ে খালটি খনন না হওয়ায় এবং পানিপ্রবাহ না থাকায় খালটি অধিকাংশ স্থানে মাটি ভরাট হয়ে উঁচু হয়ে গেছে। এছাড়া খালটিতে যেখানে-সেখানে ময়লা ফেলা অব্যাহত থাকায় খালটি বর্তমানে আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে।

Advertisement

রংপুর সিটি কর্পোরেশনের নগর পরিকল্পনাবিদ নজরুল ইসলাম বলেন, রাস্তা সম্প্রসারণ, ভবন নির্মাণ ও নিয়ন্ত্রণ করাই হচ্ছে পরিকল্পিত নগরী গড়ার প্রধান চ্যালেঞ্জ।

তিনি বলেন, এর প্রধান অন্তরায় দক্ষ জনবল এবং মানুষের অসচেতনতা। মানুষ ৩তলা ভবনের অনুমোদন নিয়ে ৫তলা করছে। ৫তলা ভবনের অনুমোদন নিয়ে ৭তলা করছে। কিন্তু সিটি কর্পোরেশনে জনবলের অভাবে তা মনিটরিং করা সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়া মানুষ আইন মানতে চায় না। যে কাঠামো অনুযায়ী ভবন নির্মাণ করার কথা তা অমান্য করে বিভিন্ন প্রভাব খাটিয়ে ভবন নির্মাণ করছে মানুষ। চলাচলের রাস্তা সংকুচিত করে ফেলা হচ্ছে। এতে ঝুঁকি বাড়ছে, ভেস্তে যাচ্ছে পরিকল্পনা।

এজন্য উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা অথবা জনবল বৃদ্ধি করা গেলে আধুনিক মানসম্মত নগরী গড়ে তোলা সম্ভব। অন্যথায় ২০৪০ সালে রংপুর নগরী পুরান ঢাকার মতোই রূপ ধারণ করবে।

পরিকল্পনাবিদদের মতে, একটি শহরের জনস্বাস্থ্য যথাযথ রাখতে জনঘনত্ব অনুযায়ী পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। এটি করা না গেলে সুফল পাওয়া যাবে না। জনঘনত্বের মানদণ্ড প্রতি একরে ৭০ থেকে ৮০ জন মানুষের বাস আদর্শ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। শহরকেন্দ্রিক এ সংখ্যা সর্বোচ্চ ১২০ পর্যন্ত হতে পারে। সমাজ পরিবর্তন ও উন্নয়ন ফোরামের কেন্দ্রীয় সভাপতি মোস্তফা আরিফ সাব্বির বলেন, রংপুরকে বসবাসের উপযুক্ত করতে হলে এখনই জনসংখ্যা ও জনঘনত্ব নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। পরিকল্পনামাফিক অবকাঠামো উন্নয়নে জনঘনত্ব বিচেনায় নেওয়া জরুরি। না হলে পরিকল্পনা ব্যর্থ হবে।

তিনি বলেন, যথাযথ পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের অভাবে নগর জীবন ক্রমাগত জটিল হচ্ছে। শহর-গ্রাম ভারসাম্য রক্ষার প্রয়োজনে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দ্রুত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) রংপুর মহানগর কমিটির সভাপতি অধ্যক্ষ ফখরুল আনাম বেঞ্জু বলেন, জনস্বাস্থ্য বিবেচনায় যেকোনো শহরের নিজস্ব পরিকল্পনা থাকা উচিত। কারণ জনস্বাস্থ্য ঠিক না থাকলে টেকসই উন্নয়ন ব্যাহত হয়। নগর পরিকল্পনায় তরুণদের অংশগ্রহণের বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে নিতে হবে। তাদের জন্য পর্যাপ্ত খেলার মাঠ ও বিনোদনের ব্যবস্থা করতে হবে। শ্যামাসুন্দরী খাল সংস্কার করে চলাচলের জন্য বিকল্প আরেকটি সড়ক নির্মাণ করা গেলে শহরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি পাবে এবং যানজট অনেকটাই কমে আসবে।

ফখরুল আনাম বলেন, সরকার কর্তৃক পরিকল্পিত নগরায়নের জন্য যেসব নীতি, আইন ও নিয়মকানুন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন সেক্ষেত্রে দুর্বলতা ও ব্যর্থতা রয়েছে। তারপরও স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন-২০০৯ প্রণীত হওয়ায় মাস্টার প্ল্যান প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে পরিকল্পিত নগর উন্নয়ন নিশ্চিত করা আইনগতভাবে সম্ভব। এজন্য সকলের সহযোগিতা প্রয়োজন।

এফএ/এএসএম