মতামত

ভাড়া বাড়লো এবার মাফিয়াদের শাস্তি চাই

আশির দশক থেকে আমি ক্রিকেটের নেশায় বুঁদ। তখন আমার প্রিয় দল ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ আর ভারত। নব্বইয়ের দশকে পাতানো খেলার বিষ ঢুকে ক্রিকেটটাকেই এলোমেলো করে দেয়। আজহারউদ্দিন, হ্যানসি ক্রনিয়ের মত তারকার পতনে হৃদয় ভেঙে যায় আমাদের মত লাখো ভক্তের। ক্রিকেটে বাংলাদেশের আগমনে আবার নতুন করে ক্রিকেটে ভরসা করি। কিন্তু আশরাফুল কাণ্ডের পর আমি ক্রিকেট দেখা ছেড়েই দিয়েছিলাম। সাকিবকাণ্ডেও আঘাত কম পাইনি। আঘাতে আঘাতে ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসাটাই মরে যেতে বসেছে। এখন আমি শুধু বাংলাদেশ জাতীয় দলের খেলা দেখি। আর খুব ভালো টেস্ট ম্যাচ ফলো করি। অন্য ক্রিকেট নিয়ে আগ্রহ কম। এই যে আইপিএল নিয়ে এত মাতামাতি, আমি কোনোদিন আইপিএল' এর কোনো ম্যাচ দেখিনি। কেন জানি মনে হয়, সব ম্যাচ পাতানো। আজ প্রবল উত্তেজনা নিয়ে খেলা দেখবো, দুই বছর পর ফাঁস হবে ম্যাচটি পাতানো ছিল। ব্যাকডেটে প্রতারিত হতে মন সায় দেয় না। আইপিএল' এর সব ম্যাচ পাতানো কিনা জানি না, তবে বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের পুরোটাই যে পাতানো, সেটা এখন সবাই জানে। গতবছর সাকিবের এক লাথিতে খুলে গেছে প্যান্ডোরার বাক্স। কে জিতবে, কে হারবে, কে কত রান করবে, কে কখন আউট হবে, কে উইকেট পাবে; সবই পূর্ব নির্ধারিত। মাঠে যা হয়, তা শুধু নাটক।

Advertisement

বাংলাদেশে শুধু খেলা পাতানো নয়, প্রায় সব নির্বাচনই পাতানো। এবার দেখলাম পাতানো আন্দোলনও। ডিজেলের দাম বাড়ানোর সাথে সাথে পরিবহন মালিকরা কোনোরকম আলোচনা-আলটিমেটাম ছাড়াই আন্দোলনে নেমে গেলেন। যান চলাচল বন্ধ করে অচল করে দিলেন দেশ। তিনদিন দেশের পথে পথে দুর্ভোগ, আহাজারি, কান্না; তাতে পরিবহন মালিকরা নিশ্চয়ই উল্লাস করেছে। এটাই তো তারা চেয়েছিল। জনগণের ভোগান্তি চরম সীমায় তুলে দাবি আদায়। আসলে আদায়েরও ব্যাপার নেই। সরকার পক্ষও দাবি মানার জন্য বসেছিল। খালি বাড়তি ভাড়াটা তাদের গা সওয়া করার জন্য তিনদিন তাদের ভোগানো হলো। জনগণের অবস্থা হয়েছে, ভিক্ষা চাই না, কুত্তা সামলা অবস্থা। ডিজেলের দাম বাড়ার প্রতিবাদ করার আগেই দেশ অচল। এখন সবার মনোভাব, ভাড়া বাড়িয়ে হলেও বাস চালু করেন। তিনদিন দেশ অচল রেখে ডিজেলের দাম এবং বাস ভাড়া বাড়ানোর প্রতিবাদের রাস্তা বন্ধ রাখা হলো। ডিজেলের দাম বাড়ানো হলে বাস ভাড়া বাড়াতে হবে সেটা সবাই জানেন। তাহলে ডিজেলের দাম বাড়ানোর সাথে সাথে বাস ভাড়া সমন্বয়ের বিষয়টি ভাবা হলো না কেন? বৃহস্পতিবার বৈঠক করে ভাড়া বাড়িয়ে দিলে পরের তিনদিন মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হতো না। আর দুর্ভোগ না হলে ভাড়া অত বেশি বাড়ানো যেতো না। ভাড়া বাড়ানোর মিটিং ডাকতে তিনদিন লাগলো কেন? এই প্রশ্নের জবাবে বিআরটিএর চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার বলেছেন, 'সবাইকে একসঙ্গে করতেই এই সময়টুকু দরকার ছিল।' এই জবাবের পরই আসলে বিআরটিএ চেয়ারম্যানকে বরখাস্ত করা উচিত। ডিজিটাল বাংলাদেশে যেখানে এখন ১৫ মিনিটের নোটিশে বৈঠক ডাকা যায়, সেখানে একটি বৈঠক ডাকতে যার সারাদেশের মানুষকে তিনদিন জিম্মি রাখতে হয়; তার আর যাই হোক সরকারি চাকরি করার যোগ্যতা নেই। এটুকু খামখেয়ালিও না হয় মাফ করলেন। এরপর একটু কুইজ দেই। রোববারের ৭ ঘণ্টার বৈঠক শেষে একজন বলেছেন, ‘আট বছর ধরে বাসের ভাড়া বাড়ানো হয়নি। আমরা আজকে ব্যয় বিশ্লেষণ কমিটির মাধ্যমে হিসাব করে দেখেছি, গত আট বছরের ভাড়া ও এখনকার তেলের দাম সমন্বয় করতে গেলে দূরপাল্লার বাসে ৪৭ শতাংশ ও মহানগরীতে ৪৬ শতাংশ ভাড়া বাড়ানো দরকার।’

বলুন তো এটা কার বক্তব্য? সবাই নিশ্চয়ই বলবেন, পরিবহন মালিকদের কারো। কিন্তু তা নয়, এটা বিআরটিএর সেই চেয়ারম্যানের বক্তব্য, যার জরুরি একটি মিটিং ডাকতে তিনদিন লাগে। বিআরটিএর চেয়ারম্যান যদি মনে করেন ডিজেলের দাম ২৩ ভাগ বাড়ানোর পর বাস ভাড়া ৪৭ ভাগ বাড়ানো দরকার ছিল, তাহলে তো আর মিটিংই দরকার ছিল না। বিআরটিএ চেয়ারম্যানের প্রস্তাবটা প্রজ্ঞাপন করে দিলেই হতো। তবে বিআরটিএর চেয়ারম্যানের দয়ার শরীর। যদিও তিনি মনে করেন, ভাড়া ৪৭ ভাগ বাড়ানো উচিত, তবে বাড়িয়েছেন মাত্র ২৭ ভাগ। ডিজেলের দাম ২৩ ভাগ বাড়িয়ে ভাড়া যে ২৭ ভাগ বাড়ানো হলো; এ জন্যই এত নাটক, এত কালক্ষেপণ, এত হয়রানি; সবই আসলে পাতানো খেলা।

আচ্ছা বাস ভাড়া তো বাড়ানো হলো, এখন এটা মনিটর করবে কে, কার্যকর করবে কে? প্রজ্ঞাপনের আগেই রোববার সন্ধ্যা থেকে রাজধানীর বাসভাড়া ৫০ ভাগ বাড়িয়ে আদায় করা হচ্ছে। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটের মালিকরা তো কোনো ঝামেলায় যাননি। ডিজেলের দাম ২৩ ভাগ বাড়ার সাথে সাথে তারা ভাড়া ৩৯ ভাগ বাড়িয়ে আদায় করছেন। আমি ধরে নিচ্ছি, সোমবার প্রজ্ঞাপনের পর থেকে নতুন ভাড়া কার্যকর হবে। নতুন ভাড়া কার্যকর হওয়ার পর কি ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটের ভাড়া বা রাজধানীতে নিজ দায়িত্বে বাড়িয়ে নেয়া ভাড়া সমন্বয় করা হবে। সরকার যদি কঠোরভাবে নতুন ভাড়া কার্যকর করে, তাহলে অনেক রুটের ভাড়া কমে যাবে। কারণ তারা অনেক আগেই নিজ দায়িত্বে ভাড়া বাড়িয়ে আদায় করছে। কিন্তু মনিটরটা করবে কে? বিআরটিএর চেয়ারম্যান? যিনি নিজে পরিবহন মালিকদের দালাল। শেয়ালের কাছে মুরগি বর্গা দেয়ার গল্প হবে আরেকটা।

Advertisement

আরেকটা কথা বলে রাখি। ভাড়া কিন্তু বেড়েছে শুধু ডিজেলচালিত বাসের। আর ঢাকায় ৯৫ ভাগ এবং দূরপাল্লার বাস চলে সিএনজিতে। এখন সিএনজিচালিত বাসগুলো কি আগের ভাড়াই নেবে না নতুন বাড়তি ভাড়া নেবে। আমি এক হাজার ভাগ গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, সিএনজিচালিত বাসও ডিজেলচালিত বাসের ভাড়া নেবে। মানুষ তো আর গাড়িতে ওঠার সময় উঁকি দিয়ে দেখবে না, সিএনজি সিলিন্ডার আছে কিনা। তারপরও দুয়েকজন বিচ্ছিন্ন প্রতিবাদ করবেন। তারা বাসের হেলপারের হাতে মার খাবেন। প্রতিবাদকারীকে ধাক্কা দিয়ে বাস থেকে ফেলে দেয়া হবে। আর এটা মনিটর করবে কে? বাস মালিকদের দালাল বিআরটিএর চেয়ারম্যান? হা-হতোস্মি!

বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় নৈরাজ্য হলো এই পরিবহন খাতে। তাদের যা ইচ্ছা তাই করার স্বাধীনতা আছে। তারা মানুষ মেরে ফেলবে, আপনি বিচার চাইতে পারবেন না। সংসদে পাস করা আইন তাদের জন্য প্রয়োগ করা যায় না। ভাড়া তারা নিজেদের আদায় করবে, সরকারকে দিয়ে সেটা পাস করিয়ে নেবে। কিছু মনপুত না হলে সারাদেশ করে দেবে। এরা ব্যবসায়ী না; এরা মাস্তান, এরা মাফিয়া।

রোববার বৈঠকে বাস ভাড়া বাড়ানোর পর বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েতুল্লাহ ঘোষণা করেন, ‘আমরা ধর্মঘট প্রত্যাহার করলাম।’ এই ঘোষণার সাথে সাথে তাকে বৈঠক থেকেই গ্রেপ্তার করা উচিত ছিল। কারণ পরিবহন ধর্মঘটই তো কেউ ডাকেনি, তাহলে তিনি কী প্রত্যাহার করলেন? পরিবহন খাতের 'গডফাদার' শাজাহান খান বলেছেন, ‘মালিক বা শ্রমিকেরা পরিবহন ধর্মঘট ডাকেনি। পরিবহন ধর্মঘট বলে আমি কিছু জানি না। পরিবহন ধর্মঘট কে ডেকেছেন, তা আমার জানা নেই।’ শ্রম আইন বিশেষজ্ঞ শাজাহান খান আরো বলেছেন, 'বিভিন্ন লোক বলছেন, পরিবহন ধর্মঘট। ধর্মঘট ডাকতে হলে একটা নোটিশ দিতে হয়। কী কারণে ধর্মঘটের দাবি উত্থাপন করতে হয়, সেটা কেউ বলেনি। সুতরাং এটাকে ধর্মঘট বলা যাবে না।' ধর্মঘট না ডেকেও দেশ অচল করার কৌশলটি শাজাহান খানের আবিষ্কার। সেটারও ব্যাখ্যা দিয়েছেন তিনি, ‘ব্যবসায়িকভাবে যদি কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হন, তিনি দোকানদার হতে পারেন, শিল্পপতি হতে পারেন, তিনি ইন্ডাস্ট্রির মালিক হতে পারেন। যদি কেউ মনে করেন, আমি এই ইন্ডাস্ট্রি চালাতে পারছি না, আমার লোকসান হচ্ছে, সেই জায়গায় তিনি ব্যবসাটা বন্ধ করে দিতে পারেন। সেই দিক বিবেচনা করে এখন যে তেলের দাম ১৫ টাকা লিটারপ্রতি বেড়েছে, মালিকদের হিসাবটা যে তাঁরা দেখেছেন, এই টাকায় তেল কিনে হয়তো লাভ করতে পারবেন না। লাভ না করলে তাঁরা তো পকেটের পয়সা দিয়ে গাড়ি চালাবেন না।’

শাজাহান খানের এমন কৌশলী ব্যাখ্যার পরও যখন খন্দকার এনায়েতুল্লাহ বলেন, 'আমরা ধর্মঘট প্রত্যাহার করলাম' তখন বেআইনী ধর্মঘট ডাকার অপরাধে আগে তাকে গ্রেপ্তার করা হোক। ট্রাক-লরির মালিক যারা এখনও ধর্মঘট চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিচ্ছে, তাদেরও গ্রেপ্তার করা হোক।

Advertisement

রোববারের বৈঠকে পরিবহন মালিকরা খুশি, বিআরটিএ চেয়ারম্যান খুশি। কিন্তু পাতানো গেম খেলে যে তিনদিন দেশের কোটি মানুষকে অবর্ণনীয় কষ্ট দেয়া হলো, তার বিচার কে করবে? ডিজেলের দাম বাড়িয়েছেন মানলাম। ডিজেলের দাম বাড়ালে বাস ভাড়া বাড়বে, তাও মানলাম। কিন্তু যারা বিনা নোটিশে যান চলাচল বন্ধ করে মানুষকে জিম্মি করে নিজেদের দাবি আদায় করতে চায়; তাদের অন্যায় আর মানবো না। আমি এই পরিবহন মাফিয়াদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার ও বিচার দাবি করছি।

৭ নভেম্বর, ২০২১

লেখক : বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।

এইচআর/এএসএম