দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলায় চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দুর্নীতিবাজদের ১ হাজার ৪৯১ কোটি ৬৭ লাখ টাকার সম্পদ ক্রোক ও অবরুদ্ধ করেছেন আদালত। গত তিন বছরের মধ্যে চলতি বছরই দুর্নীতিবাজদের দেশে-বিদেশে থাকা সবচেয়ে বেশি সম্পত্তি ক্রোক ও অবরুদ্ধ করা গেছে। দুদকের সম্পদ ব্যবস্থাপনা ইউনিট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
Advertisement
আর ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দুর্নীতিবাজদের দেশে-বিদেশে থাকা প্রায় ২১০০ কোটি টাকার সম্পদ ক্রোক ও অবরুদ্ধ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে দুদক সচিব ড. মু. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার জাগো নিউজকে বলেন, দুদকের শিডিউলভুক্ত মামলার আসামিরা যাতে অবৈধভাবে অর্জিত সম্পদ ভোগ করতে না পারেন সেজন্য এই সম্পত্তিগুলো ক্রোক ও অবরুদ্ধ করতে আদালতে আবেদন করে দুদক।
তিনি আরও বলেন, অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের অভিযোগ প্রমাণ না হয়ে এসব সম্পদের মালিক যিনি অভিযুক্ত থাকেন তার পক্ষে যদি রায় হয় তাহলে অবরুদ্ধ সম্পত্তি তিনি ফিরে পান। আর অভিযোগ প্রমাণিত হলে এসব সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হয়।
Advertisement
প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, ২০১৯ সালে দুর্নীতিবাজদের দেশে-বিদেশে থাকা ২৩৪ কোটি ২৫ লাখ ৯৬ টাকার সম্পদ অবরুদ্ধ ও ক্রোক করা হয়েছে। ক্রোক করা সম্পদের মধ্যে রয়েছে- ২২ কোটি ৭৮ লাখ ৪১ হাজার ৯৯ টাকা মূল্যের ১৪ দশমিক ৪৪ একর জমি। ৩৮ কোটি ১৯ লাখ ৪০ হাজার ২৭২ টাকা মূল্যের ১৭টি বাড়ি, ৭ কোটি ২২ লাখ টাকা মূল্যের ১৭টি ফ্লাট, ৩৬ কেটি টাকা মূল্যের চারটি কমার্শিয়াল স্পেস, ৩৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা মূল্যের ৯টি গাড়ি ও ৭ কোটি ৭০ লাখ টাকা মূল্যের চারটি স্থাপনা। এসবের মোট আর্থিক মূল্য ছিল ১১৫ কোটি ৬৬ লাখ ৩০ হাজার ২১১ টাকা।
আর অবরুদ্ধ করা হয় ২৮৮টি ব্যাংক হিসাব, ছয়টি বিও হিসাব, ৩৬টি সঞ্চয়পত্র, জামানত হিসাবে ২ কোটি ১৩ লাখ ৮২ হাজার ৪৪৪ টাকা ও ১০ লাখ ২৪ হাজার ৮০০ টাকা মূল্যের পলিসি রয়েছে। এছাড়া দুবাইয়ে দুটি শেয়ার ও মালয়েশিয়ায় পাঁচটি ব্যাংক হিসাবও সেই বছর অবরুদ্ধ হয়। সবমিলে ১১৮ কোটি টাকা ৫৯ লাখ ৬৫ হাজার ৮৭৬ টাকার সম্পদ অবরুদ্ধ করা হয়।
২০২০ সালে ৩৩২ কোটি ১৬ লাখ ২৮ হাজার ২৪২ টাকার সম্পদ ক্রোক ও অবরুদ্ধ করা হয়। এর মধ্যে ১৮০ কোটি ১১ লাখ ৯১ লাখ ৭৪৬ টাকার স্থাবর সম্পদ ক্রোক করা হয়। যার মধ্যে রয়েছে- ২৫৬ দশমিক ৩৪৫ একর জমি। যার বাজারদর ১০৮ কোটি টাকার বেশি। ২৮ কোটি টাকার ৩৪টি বাড়ি, ১৪ কোটি মূল্যের ৩৫টি ফ্লাট, ১ কোটি ৯৭ লাখ টাকা মূল্যের ১১টি প্লট, ৩ কোটি টাকা মূল্যের সাতটি কর্মাশিয়াল স্পেস ও ২৩ কোটি ৫৫ লাখ টাকা মূল্যের ১৭টি গাড়ি।
এছাড়া ১ হাজার ১১৮টি ব্যাংক হিসাবে থাকা ৬১ কোটি ৪ লাখ টাকা, সঞ্চয়পত্রের ৮৮ লাখ টাকা, ৯০ কোটি ৯৫ লাখ টাকা শেয়ার ও ৫ লাখ টাকার পিস্তল অবরুদ্ধ করা হয়েছে। সবমিলে মোট ১৫২ কোটি ৪ লাখ ৩৬ হাজার ৪৯৬ টাকার সম্পদ অবরুদ্ধ করা হয়েছে।
Advertisement
এদিকে, কেবল চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্তই ৩২৪ কোটি ৫৯ লাখ ৮৬ হাজার ৫৯২ স্থাবর সম্পত্তি ক্রোক করা হয়। আর অবরুদ্ধ করা হয় ১১০০ কোটি টাকার বেশি সম্পদ।
ক্রোকের মধ্যে রয়েছে- ২৫৫ কোটি টাকার ১২৭ একর জমি, ২৬ কোটি টাকা মূল্যের ৩০টি বাড়ি, ৩৫ কোটি মূল্যের ১৪টি ফ্লাট, ৩৩ লাখ টাকার মূল্যে একটি প্লট ও ৭ কোটি টাকা মূল্যের ২৭টি গাড়ি।
আর অবরুদ্ধ সম্পত্তির মধ্যে ৯১৬টি ব্যাংক হিসাব, ৫৬টি সঞ্চয়পত্র, বন্ড ও শেয়ার, তিনটি পিস্তল এবং সাতটি জাহাজ। এছাড়া কানাডায় ১১টি ব্যাংক হিসাব, অস্ট্রেলিয়ায় ২৩টি ব্যাংক হিসাব ও সিঙ্গাপুরে পাঁচটি ব্যাংক হিসাব রয়েছে। অবরুদ্ধ এসব সম্পদের মোট পরিমাণ ১ হাজার ১৬৭ কোটি ৭ লাখ ১৫ হাজার ৬০৪ টাকা।
দুদকের তৎপরতায় ৫ দেশে দুর্নীতিবাজদের ব্যাংক হিসাব ও কোম্পানির শেয়ার অবরুদ্ধ
গত ৩৩ মাসে দুর্নীতিবাজদের ৩৯টি বিদেশি ব্যাংক হিসাব ও দুটি কোম্পানির শেয়ার ফ্রিজ বা অবরুদ্ধ করা গেছে। দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের আদালতের মাধ্যমে পাঁচ দেশের আদালতের হস্তক্ষেপে এসব হিসাব অবরুদ্ধ হয়েছে। এর মধ্যে কানাডায় ১১টি, অস্ট্রেলিয়ায় ২৩টি, সিঙ্গাপুরে পাঁচটি ও মালয়েশিয়ায় পাঁচটি ব্যাংক হিসাব এবং দুবাইয়ে দুটি কোম্পানির শেয়ার রয়েছে।
জানা গেছে, যাদের বিদেশি অ্যাকাউন্ট জব্দ করা হয়েছে প্রত্যেকেই দেশে দুর্নীতি মামলার আসামি। তারা অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থ বিদেশের বিভিন্ন হিসবে গচ্ছিত রেখেছেন। বিদেশে পাচার করা এই অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনতে দেশের আদালতের মাধ্যমে বিদেশের আদালতে আবেদন করা হয়। পরে ওই পাঁচ দেশের আদালতের নির্দেশে অ্যাকাউন্টগুলো অবরুদ্ধ করা হয়। শিগগির এই অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনতে উদ্যোগ নেবে দুদক।
এ প্রসঙ্গে দুদক সচিব ড. মু. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার জাগো নিউজকে বলেন, আদালতের আবেদনে বলা হয়- হিসাবে থাকা অর্থ বৈধভাবে আয় করা নয় এবং পাচার হয়েছে। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিদেশের আদালত সেইসব হিসাব অবরুদ্ধ করেছে।
দুদকের সম্পদ ব্যবস্থাপনা ইউনিট বলছে, ২০১৯ সালে দুবাইয়ে দুইটি কোম্পানির শেয়ার অবরুদ্ধ করেন দেশটির আদালত। যার অর্থিক মূল্য ৩৯ লাখ ৪০ হাজার টাকা। সেই বছর মালয়েশিয়ায় পাঁচটি ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়। হিসাবগুলোতে ২২ লাখ ৮১ হাজার ৯৯০ রিঙ্গিত বা ৪ কোটি ৭৪ লাখ ৫৭ হাজার ৭৩৯ টাকার সম্পদ ছিল।
পরের বছর বিদেশি কোনো হিসাব জব্দ না করা গেলেও চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কানাডার ১১টি, অস্ট্রেলিয়ার ২৩টি ও সিঙ্গাপুরের পাঁচটি জব্দ করা ব্যাংক হিসাবে প্রায় এক হাজার ১০০ টাকার বেশি অর্থ ছিল।
এসএম/এমআরআর/এসএইচএস/এমএস