কৃষি ও প্রকৃতি

দুর্যোগ মোকাবিলা করে চাষ করছেন দাকোপের কৃষকরা

সিডর, আইলা, বুলবুলেরমতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করে, নদীভাঙ্গনকে ও লবাণাক্ততার আগ্রাসনকে পিছনে ফেলে চাষ করছেন সুন্দরবন সংলগ্ন দাকোপ উপজেলার কৃষকরা। তারা বিভিন্ন ফসলের সাথে ধানও আবাদ করছেন।

Advertisement

শিম, টমেটো, শসা, পেঁপে, ঢেঁড়শ, করলার পাশাপাশি মৌসুম ছাড়া তরমুজও এখন চাষ করছেন তারা। কৃষি বিভাগের নিবিড় তত্ত্ববধানে কৃষকরা এখন প্রাকৃতিক দুর্যোগকে হাতিয়ার করে লবণাক্ত জমিতে ফসল ফলাতে সক্ষম হচ্ছেন। যদিও খুলনার দাকোপ উপজেলা সারাদেশে তরমুজের জন্য বিখ্যাত।

দাকোপের মাঠে মাঠে সবুজ ধানের বুক চিরে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে ধানের শীষ। শীষগুলো প্রতিদিন একটু একটু করে বড় হচ্ছে সেই সাথে বড় হচ্ছে কৃষকের স্বপ্ন। কয়দিন আগেও বৃষ্টির কারণে সেই স্বপ্নে একটু হলেও ভাটা পড়েছিলো। তবে কৃষকের সেই স্বপ্নকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে শীতকালীন সব সবজি। ধানের পাশাপাশি তারা উৎপাদন করছেন নানা জাতের সবজি। একটা সময় যা ছিলো শুধুই স্বপ্ন। এখন তা সবই বাস্তব।

কৃষকরা জানান, এবছর ধান ভালো হয়েছে। গত বছর ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের কারণে আমন ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল। আবহাওয়া ভালো থাকায় এবার আমন ফলন সবচেয়ে ভালো হয়েছে। তাই কৃষকের চোখেমুখেও সোনালি ধানের সোনালি স্বপ্ন। শুধু ধান নয়, সবুজে ছেয়ে গেছে দাকোপের প্রত্যন্ত এলাকাগুলো।

Advertisement

দাকোপর সুতারখালী গ্রামের কৃষক মো. ইয়াসিন মোল্যা, আজিজুল মোল্লা, সাব্বির আহমেদ সানা, নবিবুল্লাহ সানারা বলেন, এক সময় দাকোপে যতদূর দৃষ্টি যেতো ততদূরই দেখা যেতো পানি আর পানি। লোনা পানিতে হাতে গোনা কয়েকজন প্রভাবশালী চিংড়ি মাছ উৎপাদন করে নিজেদের ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়েছে। কিন্তু সেই দাকোপে এখন আর ঘের নেই বলতে গেলে। এখন যেদিকে তাকানো যায় সেদিকেই শুধু ফসল আর ফসল। প্রথম দিকে লবণাক্ততার কারণে একটু সমস্যা হলেও এখন তা প্রায় কেটে গেছে।

এই কৃষকরা বলেন, ধানের ছড়ায় মাঠ ভরে গেছে। সোনা-রঙের মাঠভর্তি ধান ক্ষেত দেখে প্রাণটা ভরে যাচ্ছে। তিনি বলেন, ধানের সাথে সবজির চাষও করেছেন তিনি। শীতের এই সময় পাশের উপজেলা ডুমুরিয়াতেই শুধু শীতের সবজি হয়। কিন্তু আমরা লবণসহিষ্ণু সব ফসল উৎপাদনে নেমে পড়েছি। কৃষি বিভাগ থেকে আমাদেরকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হচ্ছে। কৃষি কর্মকর্তারা প্রতিনিয়ত খোঁজ-খবর নিচ্ছেন। ধানের পাশাপাশি নানা সবজিও উৎপাদন করছেন তারা।

দাকোপের নলিয়ান ও কালাবগি এলাকার বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, বড় বড় ঘেরের পরিবর্তে এখন সব ঘের ছোট হয়ে গেছে। ঘেরের চারপাশ দিয়ে ওপরে কঞ্চি দিয়ে জাল টাঙানো। তার ওপরে ও বাগানের চারপাশের বেড়া বেয়ে উঠেছে নানা সবজির গাছ। বেগুন, করলা, বরবটি, টমেটো যেনো পাল্লা দিয়ে বড় হচ্ছে সেখানে। অন্যদিকে ঘেরে বড় হচ্ছে বাগদা চিংড়িসহ সাদা মাছ।

নলিয়ানের বাসিন্দা আব্দুল লতিফ মোড়ল বলেন, তিনি এবার প্রায় ৭০ বিঘা জমিতে ধান চাষ করেছেন। সেই সাথে জমির আইলে চাষ করেছেন নানা জাতের সবজি। যা এখন তিনি বিক্রিও করছেন। তিনি বলেন, গত ৩ থেকে ৪ বছর ধরে তিনি ধানের সাথে সাথে সবজির চাষও করে আসছেন। প্রথম দিকে লবণাক্ততার কারণে সবজি ভালো না হলেও এখন তিনি খুব ভালো সবজি উৎপাদন করছেন বলেও জানান।

Advertisement

দাকোপ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মেহেদী হাসান খান বলেন, এবার জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি দাকোপে ১৮ হাজার ৮০০ হেক্টর জমিতে আমন আবাদ হয়েছে। দাকোপে চলতি আমন মৌসুমে গতবারের তুলনায় এবার ফলন ভালো দেখা যাচ্ছে। তিনি বলেন, এরমধ্যে চাষিরা ৫ শতাংশ জমির ধান কেটে ফেলেছে কৃষকেরা। আগামী ২০ দিনের মধ্যে চাষিরা সব ক্ষেতের ধান ঘরে তুলতে পারবে বলে ধারণা করেন তিনি।

এই কৃষি কর্মকর্তা আরও বলেন, আমন ধান রোপণের সময় কৃষকরা তাদের জমির আইলে নানা সবজি ফলিয়েছেন। এখনো তা অব্যাহত রয়েছে। তরমুজ চাষে দাকোপের কৃষকরাও এগিয়ে রয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, এখানের তরমুজ দেশ বিখ্যাত। তাই মৌসুম ছাড়াও এখানকার কৃষকরা তরমুজ চাষ করছেন। লবণাক্ততা উপকূলীয় মানুষ এবং পরিবেশের ওপর যে নেতিবাচক প্রভাব তৈরি করেছে তা মোকাবিলায় সম্মিলিত উদ্যোগ কম। সরকারি সংস্থাগুলো তাদেরমতো করে এসব নিয়ে কাজ করছে। এর মধ্যে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর লবণসহিষ্ণু জাতের বিভিন্ন সফল উৎপাদন করছে। নদীর লবণ পানি যাতে লোকালয়ে প্রবেশ না করে এজন্য বাঁধ নির্মাণ ও মেরামত করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।

আলমগীর হান্নান/এমএমএফ/এমএস