বিশেষ প্রতিবেদন

থার্টি ফাস্টের আগেই লোকারণ্য কক্সবাজার

আর মাত্র চারদিন পর শুরু হবে নতুন বছরের পথ চলা। ৩৬৫ দিনের সফলতা-ব্যর্থতা পিছনে ফেলে সুন্দর আগামীর আহ্বানে ৩১ ডিসেম্বর রাতে পালন করা হয় থার্টি ফাস্ট নাইট বা বর্ষবরণ উৎসব। এ উৎসবকে উপলক্ষ করে পর্যটন রাজধানী খ্যাত কক্সবাজার ওই সময়ে লোকে লোকারণ্য হয়ে ওঠে। বিগত এক দশক সময়ে এমন চিত্রই দেখে এসেছে এখানকার ব্যবসায়ী ও অধিবাসীরা। কিন্তু রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার কারণে থার্টি ফাস্ট নাইট উৎসবের আগেই পর্যটকে ভরে গেছে কক্সবাজার।১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের ছুটির সঙ্গে সাপ্তাহিক দু’দিনের ছুটি যোগ করে বছরের শেষ সময়ে কক্সবাজারে উপচেপড়া পর্যটক আগমন শুরু হয়। ইতোমধ্যে বার্ষিক পরীক্ষা হওয়ায় এ পর্যটক আগমন ধারা অব্যাহত রয়েছে। দল বেঁধে পিকনিক পার্টিতে আসছে অগণিত ভ্রমণপিপাসু। সৈকত তীরের ছোট-বড় চার শতাধিক হোটেল-মোটেল, গেস্ট হাউস, কটেজ প্রতিদিনই পরিপূর্ণ কক্ষ ভাড়ায় দিন পার করছে। অনেক পিকনিক পার্টির লোকজন রাত কাটাচ্ছেন গাড়িতেই।১৬ ডিসেম্বরের ছুটির দিন থেকে সমুদ্র সৈকত, প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন, টেকনাফ, শাহপরীর দ্বীপ, ইনানী, হিমছড়ি, রামু, চকরিয়ার ডুলাহাজারা বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক, মহেশখালী, সোনাদিয়াসহ পুরো কক্সবাজারেই এখন উপচেপড়া ভিড় লেগেই আছে। থার্টি ফাস্ট নাইটের জন্য বসে না থেকে পর্যটকরা দল বেঁধে নানা অনুষ্ঠানে অংশ নিচ্ছেন। কিন্তু প্রতিবারের মতো এবারো থার্টি ফাস্ট নাইট উপলক্ষে কক্সবাজারে ওপেন কনসার্টসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন রাখা হয়েছে।অপরদিকে, সরকার কর্তৃক ২০১৬ সালকে পর্যটন বর্ষ ঘোষণা করা হয়েছে। এ উপলক্ষে দেশে প্রথমবারের মতো আয়োজন করা হচ্ছে তিন দিনব্যাপি ‘মেগা বিচ কার্নিভাল’। ৩১ ডিসেম্বর থেকে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে শুরু হয়ে চলবে ২ জানুয়ারি পর্যন্ত। এ অনুষ্ঠান থার্টি ফাস্টে নতুন মাত্রা যোগ করবে বলে বিশ্বাস সবার। সাগরপাড়ের তারকা হোটেলগুলো নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় আয়োজন করছে ডিজেসহ নানা সাংস্কুতিক অনুষ্ঠানের। এসব কারণে অর্ধসহস্রাধিক আবাসিক প্রতিষ্ঠান ৩১ ডিসেম্বর থেকে নতুন বছরের ৩ জানয়ারি পর্যন্ত অগ্রিম বুকিং দিয়ে রেখেছে ভ্রমণপিয়াসীরা।পর্যটন সংশ্লিষ্টরা জানান, চলতি বছরের শেষদিন বৃহস্পতিবার থার্টি ফার্স্ট নাইট এবং পহেলা জানুয়ারি শুক্রবার ও পরদিন শনিবার সাপ্তাহিক ছুটি থাকায় পর্যটকের প্রচণ্ড ভিড় থাকবে। এছাড়া ৩১ ডিসেম্বর সৈকতে শুরু হচ্ছে দেশের প্রথম ‘মেগা বিচ কার্নিভাল’। তিন দিনের ওই উৎসব ঘিরে সৈকতকে সাজানো হচ্ছে অপরূপ সাজে। থার্টি ফাস্ট নাইটের আগের সাপ্তাহিক ছুটি শুক্রবার ও শনিবারকে ঘিরে কক্সবাজারের পর্যটন স্পটগুলোতে দেখা গেছে ভ্রমণপিপাসু লোকজনের ভিড়। পিকনিক পার্টিসহ পর্যটকবাহী যানবাহনের নির্দিষ্ট পার্কিংয়েও দেখা যায় বিপুল সংখ্যক গাড়ি। মহাসড়ক ধরে দেশের নানা প্রান্ত থেকে ‘পিকনিক পার্টির’ যানবাহন সকালে আসে আবার বিকেলে ফিরে যায় গন্তব্যে। তবে অনেকে রাতযাপনও করেন। তাদের জন্য সৈকতের তীরে শেখ কামাল আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম সংলগ্ন বিশাল এলাকায় রয়েছে গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা। সাগরপাড়ের ঝাউবীথির আড়ালেও পিকনিক পার্টির লোকজন রান্নাবান্না করছেন। সব মিলে এবারের শীতে জমজমাট পর্যটন মৌসুম যাচ্ছে।জানা গেছে, কক্সবাজারে এবার শীত মৌসুমের শুরুতেই পর্যটকের ঢল নামে। প্রথম দিকে এখানকার পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা নতুন বছরের ৫ জানুয়ারি নিয়ে আবারও আন্দোলনের কর্মসূচির আতঙ্কে ছিলেন। কিন্তু এ রকম কোনো কর্মসূচির ঘোষণা না থাকায় পর্যটন ব্যবসায় চাঙ্গাভাব ফিরে আসে। হোটেল-মোটেলগুলোতে এখন ঠাঁই নেই অবস্থা। আগামী জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসেও অনেক হোটেল-মোটেলের আগাম বুকিং হয়ে গেছে।কক্সবাজারের তারকা হোটেল ওশ্যান প্যারাডাইসের অপারেশন ম্যানেজার মজিদুল আলম মাজেদ বলেন, রাজনৈতিকসহ নানা প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে বিগত কয়েক বছর ধরে পর্যটন ব্যবসা চরম মন্দা গেছে। চলতি বছরের শুরুতেও এর প্রভাব ছিল। তবে মাস দুয়েক আগে থেকে নতুন প্রাণ পেয়েছে পর্যটন ব্যবসা।থার্টি ফাস্ট নাইট উপলক্ষে তা আরো গতিশীল হবে উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, বিগত সময়ের মতো এবারো পৃথক দুটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করছে হোটেল কর্তৃপক্ষ। নিচে বল রুমে ও উপরের ছাদে এসব অনুষ্ঠান হবে জানিয়ে তিনি বলেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকলে বাকি শীত মৌসুমটা ব্যবসা ভালো যাবে বলে মনে হচ্ছে।কলাতলী গেস্ট হাউস জোনের সি-নাইট রিসোর্টের ব্যবস্থাপক মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘গেস্ট হাউসগুলো টানা কয়েক বছর ব্যবসায় মার খেয়েছে। তাই এবার বিপুল সংখ্যক পর্যটকের আগমনে প্রাণ ফিরেছে এ ব্যবসায়। এতে পর্যটন সংশ্লিষ্ট সবাই বেশ খুশি।’কক্সবাজার হোটেল-মোটেল-গেস্ট হাউস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল কাসেম সিকদার জানান, কক্সবাজারে ছোট-বড় চার শতাধিক হোটেল-মোটেল ও গেস্ট হাউসে দৈনিক প্রায় এক লাখ লোকের থাকার ব্যবস্থা আছে। এছাড়া এসবের বাইরেও এক লাখ মানুষ এপার্টমেন্টসহ বিভিন্নভাবে কক্সবাজারে অবস্থান করেন। ইতোমধ্যেই কক্সবাজারের হোটেল-মোটেলগুলোর প্রায় সব কক্ষই বুকিং হয়ে গেছে।কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন বলেন, ‘সরকার ২০১৬ সালকে ঘোষণা করেছে পর্যটন বর্ষ। এ ঘোষণার মধ্যদিয়ে সবুজের ছোঁয়া নিতে শান্তিময় স্থান হিসেবে বাংলাদেশকে তুলে ধরার প্রক্রিয়া চলছে। বিশ্বের দীর্ঘতম ১২০ কিলোমিটার অখণ্ড সমুদ্র সৈকতকে এ যাত্রার প্রথম হাতিয়ার হিসেবে ধরে নিয়ে এখানেই প্রথমবারের মতো আয়োজন করা হচ্ছে আন্তর্জাতিক বিচ কার্নিভাল। আগামী ৩১ ডিসেম্বর শুরু হয়ে জমজমাট অনুষ্ঠানে এটি শেষ হবে পর্যটন বর্ষের দ্বিতীয় দিন ২ জানুয়ারি। সৈকতে তিন দিনব্যাপি আন্তর্জাতিক মেগা বিচ কার্নিভালের এই বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানে রয়েছে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মানের নানা আয়োজন।’বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড ও কক্সবাজার বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির যৌথ উদ্যোগে এ কার্নিভাল অনুষ্ঠিত হচ্ছে জানিয়ে ডিসি আরো বলেন, দেশের প্রথম এই মেগা বিচ কার্নিভালে প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছে ৫ কোটি টাকা। ইতোমধ্যে বিশাল ওই আয়োজনের জন্য সমঝোতা স্মারক চুক্তিও সম্পন্ন হয়েছে। বিচ কার্নিভাল অনুষ্ঠানের জন্য ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি গ্রে-অ্যাডভার্টাইজিং বাংলাদেশ লিমিটেড নামে একটি কম্পানির সঙ্গে এই চুক্তি সম্পাদন করে সরকার।এছাড়া দেশি-বিদেশি স্বনামধন্য শিল্পীদের অংশগ্রহণে থার্টিফার্স্ট নাইটসহ তিনদিনই ওপেন কনসার্ট হওয়ার কথা রয়েছে। এর মধ্যে সমুদ্র সৈকতের লাবণী পয়েন্টে মিউজিক্যাল কনসার্টটি সরাসরি সম্প্রচার করবে এসএ টিভি। গাইবেন নগর বাউল জেম্স, ব্যান্ড লালন, কার্নিয়া, টিনা, ঐশী, নদী ও বাংলাদেশি আইডলের মং, আরিফ, মন্টি প্রমুখ। বাকি দুদিন দেশ-বিদেশের তারকা শিল্পীদের গান পরিবেশনের কথা রয়েছে।এ বিষয়ে গ্রে অ্যাডভার্টাইজিং বাংলাদেশের হেড অব ইভেন্ট সাইফুল আজিম বলেন, ‘মনোমুগ্ধকর নানা বৈচিত্র্যপূর্ণ আয়োজনে সাজানো হচ্ছে এই মেগা বিচ কার্নিভাল। থাকছে দেশীয় ঐতিহ্যবাহী নানা খেলাধুলা ও আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন নানান ওয়াটার স্পোর্টসের ব্যবস্থা।’এদিকে থার্টি ফাস্ট নাইট ছাড়াও কক্সবাজারে বিপুল সংখ্যক পর্যটকের নিরাপত্তায় বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছে জেলা পুলিশ, ট্যুরিস্ট পুলিশ ও র‌্যাব।কক্সবাজারের পুলিশ সুপার শ্যামল কুমার নাথ জানিয়েছেন, কক্সবাজারে আগত পর্যটকদের নিরাপত্তায় পুলিশ বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। পর্যটন স্পটগুলোতে পুলিশের নজরদারিও বাড়ানো হয়েছে। এছাড়া কক্সবাজার  সমুদ্র সৈকত থেকে সেন্টমার্টিন পর্যন্ত এলাকায় পর্যটকদের নিরাপত্তায় ট্যুরিস্ট পুলিশ সার্বক্ষণিক কাজ করছে বলে জানিয়েছেন কক্সবাজার ট্যুরিস্ট পুলিশের সহকারী পুলিশ সুপার।সায়ীদ আলমগীর/বিএ

Advertisement