দেশজুড়ে

ভ্যানেই তাদের সংসার

মাগুরার শালিখা উপজেলার ছয়ঘরিয়া গ্রামের হাজাম পাড়া। নোংরা পতিত জায়গা। খোলা আকাশের নিচে কাঠের খাটের ওপর কয়েকটি কাপড় আর পলিথিনের পুটলি। পাশে ঘুমিয়ে আছেন ৭০ বছরের বৃদ্ধা রাবিয়া বেগম। রাবিয়া বেগম প্যারালাইসিসের রোগী। আর খলিল শেখের হার্টের সমস্যা।

Advertisement

তাদের ওষুধের কথা জিজ্ঞেস করতেই পোটলার ভেতর থেকে স্ত্রীর জন্য হোমিওপ্যাথিকের কয়েকটি শিশি আর নিজের জন্য গ্যাস্ট্রিকের সিরাপের একটি বোতল বের করে দেখান।

কথার ফাঁকে হাসি তামাশার ছলে খলিল শেখ বললেন, ‘যেখানে রাত, সেখানেই কাত।’ কথাটা তামাশার শুনালেও বাস্তবেই খোলা আকাশের নিচে, কখনো রাস্তার পাশে, কখনো আবার গাছের নিচেই রাত্রী যাপন করছেন এই বৃদ্ধ দম্পতি। একটা নির্দিষ্ট আয় আর বাসস্থানের অভাবে ভ্যানের ওপর সংসার সাজিয়ে ঘুরছেন খলিল শেখ আর তার স্ত্রী রাবিয়া বেগম।

মাগুরার শালিখা উপজেলার ছয়ঘড়িয়া গ্রামের হাজাম পাড়ায় কথা হয় এই আশ্রয়হীন বৃদ্ধ দম্পতির সঙ্গে।

Advertisement

খলিল শেখ ও রাবিয়া দম্পতির সংসারে আসবাব বলতে আছে একটি কাঠের খাট, যা সপ্তাহ খানেক আগে ৭৩০ টাকা দিয়ে কিনেছেন। আর আছে একটি ভ্যান। ভ্যানটি তাদের আয়ের একমাত্র উৎস। ভ্যানে করে কাপড় বিক্রি করেন তারা। কিন্তু এতে যা আয় হয় তাতে জোটে না এক বেলার খাবারও।

অশ্রুসিক্ত চোখে বৃদ্ধ খলিল শেখ বলেন, নিজের বাবা-মার খবর জানা ছিল না তার। খুব ছোটকালে কেউ হয়তো তাকে ফেলে রেখে যায় বা সে হারিয়ে যায় বাগেরহাটের রামপালের ছায়রাবাদ গ্রামের হাটের মাঝে। তাকে কাঁদতে দেখে ঝিনাইদাহের বেথুলী গ্রামের মনছুর বিশ্বাস কুড়িয়ে এনে নিজের সন্তানের মতো লালন পালন করেন। পালক বাবা মনছুর বিশ্বাসের মৃত্যুর পর রুটিরুজির সন্ধানে বেরিয়ে পড়েন। সেই থেকে তার ছিন্নমূল জীবন। লোকমুখে শুনে এক সময় নিজের বাবা মার খোঁজে বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার ছায়রাবাদ গ্রামে যান। সেখানে খোঁজ পান বাবা ইছাহাক শেখ ও মা বড় বিবির। কিন্তু তাদের খুঁজে পেলেও কোনো লাভ হয়নি। তাদের কাছে তখন তিনি অপরিচিত।

পালিত বাবা মনছুর শেখের একমাত্র মেয়ের বিয়ে হয় মাগুরার শালিখা উপজেলার ছয়ঘরিয়া গ্রামের হাজাম পাড়ায়। সেই সূত্রেই খলিল শেখের মাগুরায় আনাগোনা। তার ভাষায়, এখানে রয়েছে তার ভাগ্নেরা। ভাগ্নেদের বাড়ির আশেপাশে একটু আশ্রয় হলেই তার পরম সুখ।

খলিল শেখ জানান, মাস ৬ আগে অস্থায়ীভাবে বাগেরহাটের ফকিরাহাটে ৪০ ঘর আশ্রয়ন কেন্দ্রে তার ঠাঁই হয়েছিল। তবে আয়ের কোনো পথ না থাকায় তিনি কাজের সন্ধানে মাগুরায় আত্মীয় স্বজনদের কাছে আসেন। প্যারালাইসিসে আক্রান্ত স্ত্রীকে নিয়ে ওই আশ্রয়নে আর ফিরে যাওয়া সম্ভব না বয়সের ভারে নুইয়ে পড়া খলিল শেখের। ঝিনাইদাহের কালিগঞ্জের মহেশ্বরচাঁদ গ্রামের ঠিকানায় তিনি পেয়েছিলেন একটি বয়স্ক ভাতার কার্ডও। কিন্তু মোবাইল ব্যাংকিংয়ে ভাতা পরিশোধের মাধ্যম হওয়ায় এখন তার মোবাইলে ভাতার টাকা আসে কিনা জানেন না তিনি।

Advertisement

৮৪ বছর বয়সে এসেও আত্মসম্মানে অটুট খলিল শেখের ইচ্ছা ভিক্ষা নয়, কাজ করে খেতে চান। তার ভ্যানের জন্য একটা ইঞ্জিন আর থাকার জন্য একটু আশ্রয় পেলেই খুশি তিনি।

ফেরার সময় বৃদ্ধ খলিল শেখ বলে উঠলেন, ‘শেখের বিটির সরকার সগলিরে দলিল করে ঘর দিচ্ছে, আমারে মাগুরাতে যদি একটা ব্যবস্থা করে দিত আমি প্রাণ খুলে দোয়া করতাম।’

এফএ/এমএস