বাষ্পীয় ইঞ্জিনের উদ্ভাবক জেমস ওয়াটের জন্মভূমি স্কটল্যান্ডে ২০৩০ সালের মধ্যে বন উজাড় বন্ধের প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলেন বিশ্বনেতারা। সংখ্যায় তারা শতাধিক। এবারের জলবায়ু সম্মেলনে চাঞ্চল্যকর এবং বড় বোঝাপড়ার সমঝোতা চুক্তি এটি। দেশ-বিদেশের পরিবেশবিষয়ক বিশেষজ্ঞদের কাছে এটি দশ কাজের এক কাজ। এর আগে, ২০১৪ সালে বন উজাড় নিয়ে করা চুক্তির দশা স্মরণ না করে পারা যায় না। এবার বাস্তবে কী হবে, প্রতিশ্রুতি কদ্দূর ফলবে- সেটা অপেক্ষার বিষয়।
Advertisement
স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে বহুপ্রতীক্ষিত ২৬তম জলবায়ু সম্মেলনে নেয়া সমঝোতা চুক্তি নিয়ে শঙ্কা-সন্দেহ থাকলেও আপাতত আশাবাদী হতে সমস্যা নেই। বন উজাড় বন্ধের চুক্তির সাফল্য সুস্থ মানুষ মাত্রই কাম্য। এবার আশাবাদী হওয়ার বেশ কিছু কারণ রয়েছে। ২৮টি দেশের সরকার পামতেল, সয়া ও কোকোর মতো খাদ্য ও অন্যান্য কৃষিপণ্যের বৈশ্বিক বাণিজ্যের প্রতিযোগিতা করে। এ ধরনের কৃষিপণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো পশুচারণ ও শস্য উৎপাদনের জন্য গাছ কেটে উজাড় করে। এবার তারাও গাছ কাটা ও বন উজাড় বন্ধে একমত হয়েছে। বিশ্বের বড় ৩০টির বেশি প্রতিষ্ঠান বন উজাড়ে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিনিয়োগ বন্ধের ওয়াদা করেছে তারাও।
ঐতিহাসিক দূষণকারী দেশের তালিকায় রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, কানাডা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা ইইউভুক্ত ২৭টি দেশ। চীন বর্তমানে সর্বাধিক কার্বন নিঃসরণকারী দেশ (প্রায় ২৮ শতাংশ)। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ, রাশিয়া ও জাপানের মিলিত নিঃসরিত কার্বনের পরিমাণ প্রায় ৩৪ শতাংশ এবং ভারত ২ দশমিক ৬২ শতাংশ। তবে জনপ্রতি হিসাবে এখনো ঐতিহাসিক দূষণকারীরা শীর্ষে। বড়দের যথেচ্ছাচারে বেশি ক্ষতির শিকার বাংলাদেশের মতো ছোট দেশগুলো। গত ৩০ বছরে সমুদ্রস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধি ঘটেছে দ্বিগুণ। সমুদ্রের পানিও আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি উত্তপ্ত।
জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত আন্তসরকার প্যানেলের ষষ্ঠ প্রতিবেদনেও এ সংক্রান্ত তথ্য রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশসহ বিশ্বের ১১টি দেশে আগামী দিনে বৃষ্টিপাতের পাশাপাশি ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস ও বন্যার ঘটনা বাড়বে। পরিস্থিতি এখন ক্রমে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। পৃথিবীর কার্বন পরিসর ফুরিয়ে আসছে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোকে কার্বন নিঃসরণ কমাতে ছোট দেশ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আহ্বান বরাবরই উল্লেখ করবার মতো। কপ-২৬ নামের গ্লাসকো সম্মেলনেও জোরের সঙ্গে আহ্বানের পুণুরুল্লেখ করেন তিনি। কার্বন প্রশ্নে গাছ-গাছালি, বন-বাদাড়সহ পরিবেশ অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।
Advertisement
বিশ্বব্যাপী গাছ কেটে ফেলা ও বন উজাড় করা জলবায়ু পরিবর্তনের বড় ফ্যাক্টর। কার্বন নিঃসরণ কমাতে গাছের ভূমিকা সবার মুখস্থ। কিন্তু, মুখস্ত বিদ্যাটির খেলাপ দেশে-দেশে। সেটা গাছ কেটে আমাজান বন সাবাড় করা ব্রাজিলও জানে। ব্রাজিল চুক্তিতে সই করা অন্যতম দেশ। রয়েছে কানাডা, রাশিয়া, ইন্দোনেশিয়াও। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন জলবায়ু সম্মেলনের আয়োজক। বনাঞ্চল রক্ষায় ঐতিহাসিক চুক্তির আহ্বায়ক তিনি। বন উজাড় বন্ধে তহবিল পর্যাপ্ত। বাংলাদেশেও ব্যতিক্রম নয়। আবার ঝুঁকিও ব্যাপক।
দেশের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় থেকে তৈরি করা কার্বন নিঃসরণ কমানোর পরিকল্পনা জাতিসংঘের জলবায়ু বিষয়ক সংস্থার কাছে জমা দেওয়া আছে। পরিকল্পনায় বাংলাদেশ নিজস্ব অর্থায়নে কার্বন নিঃসরণ ৬ দশমিক ৭৩ শতাংশ কমাবে বলে জানিয়েছে। বাকি ১৫ দশমিক ১২ শতাংশ উন্নত দেশ বা আর্ন্তজাতিক সংস্থাগুলোর কাছ থেকে সহায়তা পাওয়া সাপেক্ষে কমানো হবে। এ সহায়তা শুধু আর্থিক নয়, প্রযুক্তিগতও । এর আগে ২০১৫ সালে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার বৈশ্বিক চুক্তির অংশ হিসেবে কার্বন নিঃসরণ ১৫ শতাংশ কমানোর অঙ্গীকার রয়েছে বাংলাদেশের। যার ৫ শতাংশ নিজেদের অর্থায়নে এবং ১০ শতাংশ সহায়তা সাপেক্ষ ছিল।
বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় এখন বছরে ১০০ কোটি ডলার বা সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করছে। কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র নিরুৎসাহিত করা, নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়ানো, উপকূলীয় এলাকাসহ সারা দেশে বৃক্ষরোপণ, ইটভাটার আধুনিকায়ন ইত্যাদি নানা উদ্যোগের কথাও তুলে ধরা হয়। কিন্তু, কার্যকারিতার ফলো আপ নেই। ২০১৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত কী পরিমাণে কার্বন নিঃসরণ কমেছে এর হিসাব নেই।
গ্লাসগোতে বিশ্বনেতারা হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আর সময় নষ্ট করা চলে না। গোটা বিশ্বকে সুরক্ষায় আর কোনো সময়ক্ষেপণ নয় বলে জোরালো অঙ্গীকার রয়েছে চুক্তিতে। শুরু হওয়া জলবায়ু সম্মেলনের তাৎপর্য বা শিল্পায়নের সূচনার প্রতি ইঙ্গিত করে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এখান থেকেই টাইমবোমা সচল হয়েছে। তিনি সম্মেলনস্থলের বাইরে বিক্ষোভকারীদের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘তরুণেরা ক্ষুব্ধ। আমরা এখানে সব ষাটোর্ধ্ব যদি তাদের ভবিষ্যৎ নিরাপদ করতে ব্যর্থ হই, তাহলে তা তাদের আরও ক্ষুব্ধ করবে।’ সম্মেলন, অঙ্গীকার, চুক্তি সব মিলিয়ে আশাবাদ জাগিয়েছে। বাদবাকিটা ভবিষ্যত।
Advertisement
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।
এইচআর/এমএস