একটা সময় ঘাস (পাতি) দিয়ে তৈরি মাদুরের ব্যাপক কদর ছিল। পাতির তৈরি মাদুরের টেকশই এবং দামও বেশি। গত পাঁচ বছর থেকে নওগাঁয় পাতির মাদুরের চাহিদা কমতে থাকায় প্লাস্টিকের পাইপ দিয়ে তৈরি মাদুর জায়গা করে নিয়েছে। গ্রাম-গঞ্জে, শহর-বন্দরে এ মাদুরের কদর বেড়েছে।
Advertisement
মাদুরকে বাহারি রঙে, ডিজাইনে, ফুলের আদলে আরও আকর্ষণীয় করা হচ্ছে। প্লাস্টিকের মাদুর মেশিনের সাহায্যে নিখোঁতভাবে তৈরি করা হয়। ছড়িয়ে পড়ছে সমগ্র দেশে। এজন্য সম্ভাবনাময় হয়ে ওঠেছে প্লাস্টিকের মাদুর। তবে এ খাতে সরকারের সহযোগিতা পেলে আরও একধাপ এগিয়ে যাবে বলে মনে করছে কারখানার মালিক।
জানা গেছে, নওগাঁ সদর উপজেলার মাদারমোল্লা, শিমুলিয়া, ইলশাবাড়ি, খিদিরপর, চক, বলিরঘাট, শৈলগাছী, ত্রিমোহনী, চুন্ডিপুর, চুনিয়াগাড়ী, গাংজোয়ার, জেলার রানীনগর উপজেলার ছয়বাড়িয়া, কুবিড়াতলি, করচগ্রাম, কাশিমপুর, বোদলা, বাহাদুরপুর, হরিশপুর, চকমুনু, মিরাট, আতাইকুলা, হামিদপুর, কুজাইল এবং আত্রাই উপজেলার ভবানিপুর, তিলাবাদুড়ী, জামগ্রাম, নলদিঘীসহ প্রায় ৫০ গ্রামের প্রায় পাঁচ হাজার স্বল্প আয়ের দরিদ্র পরিবারের লোকজন পাতির মাদুর তৈরি করতেন। এ কাজের সঙ্গে অধিকাংশই নারীরা জড়িত। পার্শ্ববর্তী বগুড়া জেলার আদমদীঘি উপজেলার সান্তাহার ইউনিয়নে ঐতিহ্যবাহী হেলালিয়া হাট মাদুরের হাট নামে পরিচিত পেয়েছে। সপ্তাহের দু’দিন (বৃহস্পতি ও রবি) হাটবার। ওইসব গ্রাম থেকে হেলালিয়া হাটে মাদুর বিক্রি করতে আসেন। বর্তমানে প্রতি হাটে প্রায় ১০ লাখ টাকার পাতি থেকে মাদুর বেচাকেনা হয়। প্লাস্টিকের মাদুর বিক্রির জন্য হাটের দিনের অপেক্ষা করতে হয় না।
প্লাস্টিকের মাদুর প্রতি দিন সর্বনিন্ম ১৫ লাখ টাকা বেচাকেনা হয় বলে জানান ব্যবসায়ীরা। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে পাতি থেকে তৈরি মাদুর কষ্টসাধ্য ও উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়ায় কারিগররা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। পাতি দিয়ে তৈরির কারিগর খুঁজে পাওয়া দায়। তারা এখন পেশা পরিবর্তন করেছেন।
Advertisement
পাতির মাদুরের স্থানে প্লাস্টিকের মাদুর জায়গা করে নিচ্ছে। এ মাদুর নরম। ব্যবহারেও আরামদায়ক। সদর উপজেলা চন্ডিপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় প্লাস্টিকের মাদুরের ১৭টি কারখানা গড়ে ওঠেছে। কারখানায় বর্জ ও বিভিন্ন প্লাস্টিক থেকে প্লাস্টিকের পাইপ তৈরি করে।
পাইপ দিয়ে তৈরি হয় হরেক রকমের প্লাস্টিকের মাদুর। আর এসব কারখানায় প্রায় তিন শতাধিক শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়েছে। আর প্রতিদিন প্রায় ১৫ লাখ থেকে ২০ লাখ টাকার প্লাস্টিকের মাদুর উৎপাদন হয়। এসব প্লাস্টিকের মাদুর চলে যায় ঢাকা, খুলনা, বরিশাল, রংপুর, লালমনিরহাট ও যশোরসহ বিভিন্ন জেলায়।
ব্যবসায়ীরা জানান, প্লাস্টিকের মাদুর পাইকারি ৬ বাই ৭ ফুট মোটা ৩৩০ টাকা ও পাতলা ২০০ টাকা, ৫ বাই ৭ ফুট মোটা ২৩০ টাকা ও পাতলা ১৩৫ টাকা, ৪ বাই ৬ ফুট মোটা ১৪৫ টাকা ও পাতলা ১০৫ টাকা, ৩ বাই ৬ ফুট মোটা ১৩০ টাকা ও পাতলা ৭৫ টাকা এবং জায়নামাজ মোটা ৭৫ টাকা ও পাতলা ৪৫ টাকা। প্রতিদিন প্রায় ১৫ লাখ থেকে ২০ লাখ টাকার প্লাস্টিকের মাদুর উৎপাদন হয়। পাইকারি দরে কিনে খুচরা ব্যবসায়ীরা প্রকারভেদে ৫০ থেকে ১০০ টাকা লাভে বিক্রি করে থাকেন।
মাদুর তৈরির প্রধান কাঁচামাল প্লাস্টিকের গুটি (ছোট দানা) বর্তমানে প্রতি কেজি প্রকারভেদে ৭৫ টাকা ৮০ টাকা। যা গত এক বছর আগে ছিল ৫২ টাকা থেকে ৫৬ টাকা। এছাড়া প্রতি কেজি রং প্রকারভেদে ৮০০ টাকা থেকে ৯০০ টাকা। যা পূর্বে ছিল ৩৫০ টাকা থেকে ৪৫০ টাকা কেজি। গত পাঁচ বছর আগে কাঁচামালের দাম কম থাকায় এ ব্যবসায় বেশ লাভজনক ছিল। বর্তমানে কাঁচামালের দাম বেশি হওয়ায় লাভের পরিমাণ কমে গেছে। আর এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে প্লাস্টিকের মাদুর ব্যবসায় ধ্বস নামার সম্ভাবনা আছে।
Advertisement
শিমুলিয়া গ্রামের হিন্দুপাড়ার বাসিন্দা পাতি মাদুর তৈরির কারিগর অজিত দেবনাথ বলেন, গত ৪৫ বছর থেকে হাতে মাদুর তৈরি করছি। আগে আমার পাড়ার ৬২ ঘর মাদুর তৈরির করত। এখন তিন ঘর তৈরি করছে। যাদের অন্যকোনো পেশা নেই তারাই এখন হাতে মাদুর তৈরি করছে। প্লাস্টিক আসার পর গত পাঁচ বছর থেকে আমাদের মাদুরের গুরুত্ব কমে গেছে।
স্বামী-স্ত্রী মিলে ২ বাই ৫ হাত আকারে মাদুর দিনে ২ থেকে ৩ টা তৈরি করতে পারি। হাটে পাইকারি দরে ১৩০ টাকা দরে বিক্রি হয়। যেখানে খরচ হয় ৮০ টাকা থেকে ৯০ টাকা। লাভ খুবই সীমিত। তবে আগে মাদুর তৈরীর উপকরণের দাম কম ছিল এবং লাভ ভালো ছিল।
হেলালিয়া হাটের ব্যবসায়ী আমিনুল ইসলাম বলেন, তার মতো এ হাটে ২০ জন পাইকারি ব্যবসায়ী আছে। সপ্তাহের দু’দিন (বৃহস্পতি ও রবি) হাটবার। পাতি থেকে তৈরি মাদুরের জন্য ঐতিহ্যবাহী হাট হিসেবে পরিচিত। প্রতি হাটে প্রায় ১০ লাখ টাকার পাতি থেকে তৈরি মাদুর বেচাকেনা হয়।
এছাড়া প্লাস্টিকের মাদুর প্রতিদিন সর্বনিন্ম দিনে ১৫ লাখ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৫০ লাখ টাকার বেচাকেনা হয়। হাটের জন্য প্লাস্টিকের মাদুর বিক্রিতে অপেক্ষায় থাকতে হয়না। ঢাকা, ময়মনসিংহ, খুলনা, রংপুর, বরিশাল থেকে ব্যবসায়ীরা এসে কারখানা থেকে নিয়ে যান।
মাদারমোল্লা গ্রামে এসএস পাবনা ম্যাটস কারখানার কাটিং মাস্টার মুরশেদ বিশ্বাস বলেন, গত এক বছর থেকে এ কারখানায় ১৫ হাজার টাকা বেতনে কাজ করছেন। প্রতিদিন এ কারখানা থেকে ছোট-বড় ৩০০ পিস প্লাস্টিকের মাদুর তৈরি হয়। যেখানে গড় হিসেবে ৮০ হাজার টাকার মাদুর তৈরি হয়।
শিমুলিয়া গ্রামের ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ী খলিল বলেন, গত চার বছর ধরে প্লাস্টিকের মাদুরের ব্যবসা করছি। যেসব মাদুর কিছুটা নষ্ট থাকে সেগুলো স্বল্পদামে কিনে গ্রামে গ্রামে ফেরি করে বিক্রি করি। রিজেক্ট মাদুর দাম কিছুটা কম এবং গ্রামের মানুষের কাছে চাহিদা আছে। এর আগে পাতি দিয়ে তৈরির মাদুরের ব্যবসা করতাম।
তিনি বলেন, পাতির মাদুরের দাম বেশি হওয়ায় ক্রেতাদের কাছে চাহিদা কম। এক প্যাকেটে ৮০ হাজার থেকে ৯০ হাজার টাকার প্লাস্টিকের মাদুর কেনা হয়। বিক্রি করতে এক থেকে দেড় মাস সময় লাগে। তিনজন মিলে বিভিন্ন গ্রামে বিক্রি করে মাসে প্রায় ১৫ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা লাভ থাকে। এ আয় থেকে সংসার চলে।
সদর উপজেলার খিদিরপর গ্রামের মেসার্স এইচআরএম এর প্রোপ্রাইটর হারুন রশিদ বলেন, গত পাঁচ বছর আগে একটি চাউল কলের চাতাল মাসে ৭ হাজার টাকা ভাড়া নিয়ে চারটি মেশিন দিয়ে কারখানা শুরু করি। লাভজনক হওয়ায় ব্যবসার পরিধি বাড়াতে থাকি। বর্তমানে কারখানায় ১৬টি মেশিন আছে।
যেখানে কাজ করছে ২০ জন শ্রমিক। প্রতি মাসে শ্রমিকদের প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার টাকা বেতন দিতে হয়। প্রতিদিন প্রায় লক্ষাধিক টাকার মাদুর উৎপাদন হয়। আগে প্লাস্টিক মাদুরের চাহিদা ভালো ছিল ব্যবসাও লাভজনক ছিল। বর্তমানে কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়া লাভের পরিমাণ কমে গেছে। এভাবে চলতে থাকলে হয়ত ব্যবসার ধ্বস নামতে পারে।
শিমুলিয়া আনন্দ বাজার প্লাস্টিক মাদুর মালিক সমিতির সভাপতি আহসান হাবিব বলেন, এক সময় নওগাঁ সদর ও পার্শ্ববর্তী আদমদীঘি উপজেলা মিলে এ সমিতির আওতায় ২১টি কারখানা ছিল। আদমদীঘি আলাদা হওয়ায় বর্তমানে নওগাঁ সদর ১৭টি কারখানা চালু আছে। এসব কারখানায় প্রায় তিন শতাধিক শ্রমিক কাজ করে। প্লাস্টিকের মাদুর দেশের বিভিন্ন জেলায় চলে যায়। চাহিদাও রয়েছে ব্যাপক।
তিনি বলেন, আমরা যারা প্লাস্টিক মাদুরের ব্যবসা করছি সবাই জায়গা ভাড়া নিয়ে কারখানা দিয়েছে। কোনো ব্যাংক আমাদের ঋণ দিতে চাই না। বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসা করতে হয়। সরকার যদি আমাদের এ শিল্পের জন্য সহায়তার হাত বাড়ায় আমরা আরও এগিয়ে যেতে পারবো।
এমআরএম/জিকেএস