হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম জীবনের শেষ প্রান্তে এসে নিজ বংশ থেকে একজন রাসুল পাঠাতে আল্লাহর কাছে এভাবে দোয়া করলেন-
Advertisement
رَبَّنَا وَابْعَثْ فِيْهِمْ رَسُوْلًا مِّنْهُمْ يَتْلُوْا عَلَيْهِمْ اٰيٰتِكَ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتٰبَ وَالْحِكْمَةَ وَيُزَكِّيْهِمْ ؕ اِنَّكَ اَنْتَ الْعَزِيْزُ الْحَكِيْمُ
‘হে আমাদের রব! আর তাদের মধ্য থেকে তাদের কাছে এক রসূল প্রেরণ কর। যে তোমার আয়াতসমূহ তাদের কাছে পাঠ করবে; তাদেরকে কিতাব (ধর্মগ্রন্থ কোরআন) ও হিকমত (কোরআনের জ্ঞান ও প্রজ্ঞা) শেখাবে এবং তাদেরকে (শিরক থেকে) পবিত্র করবে। নিশ্চয়ই তুমি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।’
এটি ছিল হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামের জীবনের শেষ দোয়া। আল্লাহ তাআলা তাঁর এ দোয়া কবুল করে নিজ সন্তান ইসমাইলের বংশে রেসালাতের দায়িত্ব দিয়ে হজরত মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দুনিয়ায় প্রেরণ করেন। এ দোয়া প্রসঙ্গে নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘোষণা করেন-
Advertisement
‘আমি হলাম আমার পিতা ইবরাহিম আলাইহিস সালামের দোয়া, ঈসা আলাইহিস সালামের সুসংবাদ এবং আমার জননীর (আমিনার) স্বপ্ন।’ (ফাতহুর রাব্বানি)
প্রশ্ন হলো- দুনিয়াতে নবি-রাসুল পাঠানোর প্রয়োজনীয়তা কী ছিল?
আল্লাহ তাআলা শুধু আসমানি গ্রন্থ পাঠালেই তো যথেষ্ট ছিল। তাহলে নবি-রাসুল পাঠানোর দরকার কী ছিল? সত্য কিতাবসহ নবি-রাসুল কেন পাঠালেন? হ্যাঁ, আসমানি কিতাবসহ এ মর্মার্থ বুঝানোর জন্য শিক্ষক ও পথপ্রদর্শক হিসেবে নবি ও রাসুলদের পাঠানো হয়েছে। যাতে আসমানি কিতাবে নাজিলকৃত বিষয়ের সঠিক তিলাওয়াত ও ব্যাখ্যা দিতে পারেন।
আর তা দুনিয়াতে নবি-রাসুলদের আগমনের ঘোষণা ও তাদের কর্মপদ্ধতির বর্ণনা থেকেই প্রমাণিত হয় যে, সত্যিই দুনিয়াতে নবি-রাসুল পাঠানোর প্রয়োজনীয়তা ছিল। এ কারণেই কোরআনুল কারিমের একাধিক আয়াতে এ সম্পর্কে সুস্পষ্ট বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন-
Advertisement
هُوَ الَّذِیۡۤ اَرۡسَلَ رَسُوۡلَهٗ بِالۡهُدٰی وَ دِیۡنِ الۡحَقِّ لِیُظۡهِرَهٗ عَلَی الدِّیۡنِ کُلِّهٖ ۙ وَ لَوۡ کَرِهَ الۡمُشۡرِکُوۡنَ
তিনিই পথনির্দেশ (কুরআন) এবং সত্য জীবন ব্যবস্থাসহ নিজ রাসুল পাঠিয়েছেন, যাতে তাকে সব ধর্মের উপর বিজয়ী করতে পারেন। যদিও (এটিকে) অংশীবাদীরা অপ্রীতিকর মনে করে।’ (সুরা তাওবাহ : আয়াত ৩৩)
কোরআনের বর্ণনায় নবি-রাসুল পাঠানোর প্রয়োজনীয়তা
১. رَبَّنَا وَابْعَثْ فِيْهِمْ رَسُوْلًا مِّنْهُمْ يَتْلُوْا عَلَيْهِمْ اٰيٰتِكَ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتٰبَ وَالْحِكْمَةَ وَيُزَكِّيْهِمْ ؕ اِنَّكَ اَنْتَ الْعَزِيْزُ الْحَكِيْمُ
‘হে আমাদের রব! আর তাদের মধ্য থেকে তাদের কাছে এক রসূল প্রেরণ কর। যে তোমার আয়াতসমূহ তাদের কাছে পাঠ করবে; তাদেরকে কিতাব (ধর্মগ্রন্থ কোরআন) ও হিকমত (কোরআনের জ্ঞান ও প্রজ্ঞা) শেখাবে এবং তাদেরকে (শিরক থেকে) পবিত্র করবে। নিশ্চয়ই তুমি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।’
এ আয়াতে মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে পাঠানের তিনটি উদ্দেশ্য ওঠে এসেছে-
> আল্লাহর আয়াতসমূহ তেলাওয়াত করা। আর তেলাওয়াতের প্রকৃত অর্থ- অনুসরণ করা। কুরআন ও হাদিসের পরিভাষায় এ শব্দটি কুরআন ও অন্যান্য আসমানি কিতাব পড়ার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কারণ, যারা এসব কালাম পাঠ করে; তাদের এর অনুসরণ করাও তার একান্ত কর্তব্য। আসমানি গ্রন্থে ঠিক যেভাবে আল্লাহর পক্ষ থেকে নাজিল হয়; তা হুবহু তেমনিভাবে পাঠ করা ও আমল করাই জরুরি। কোনোভাবেই এতে নিজের পক্ষ থেকে কোনো শব্দ অথবা স্বরচিহ্নটিও পরিবর্তন পরিবর্ধন করার অনুমতি নেই।
> আল্লাহর কিতাব ও হিকমতের শিক্ষা দান। এখানে কিতাব বলে কোরআনকে বুঝানো হয়েছে। ‘হিকমত’ শব্দটি ‘সত্যে উপনীত হওয়া, ন্যায় ও সুবিচার, জ্ঞান ও প্রজ্ঞা ইত্যাদি বোঝানো হয়েছে।
> পরিশুদ্ধি ও পবিত্রকরণ করা। এ আয়াতে উল্লেখিত يُزَكِّيهِمْ শব্দটি زكاة শব্দ থেকে উদ্ভুত। এর অর্থ পবিত্রতা। বাহ্যিক ও আত্মিক সব ধরনের পবিত্রতার অর্থেই এ শব্দটি ব্যবহৃত হয়।
২. كَمَاۤ اَرْسَلْنَا فِيْكُمْ رَسُوْلًا مِّنْكُمْ يَتْلُوْا عَلَيْكُمْ اٰيٰتِنَا وَيُزَكِّيْكُمْ وَيُعَلِّمُكُمُ الْكِتٰبَ وَالْحِكْمَةَ وَيُعَلِّمُكُمْ مَّا لَمْ تَكُوْنُوْا تَعْلَمُوْنَ
যেভাবে আমি তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদেরই একজনকে রাসুল করে পাঠিয়েছি; যে আমার আয়াত (বাক্য)সমূহ তোমাদের কাছে পাঠ করার মাধ্যমে তোমাদেরকে (শিরক থেকে) পবিত্র করে এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষা দেয়। আর তোমাদেরকে শিক্ষা দেয় এমন কিছু যা তোমরা জানতে না।’
এ আয়াতে كَمَا (যেভাবে) এর সম্পর্ক আগের বক্তব্যের সঙ্গে। যেখানে আল্লাহকে স্মরণ করার কথা আছে। আল্লাহর অনুগ্রহের পরিপূর্ণতা এবং হেদায়াতের তওফিক তোমরা ঐভাবেই পেয়েছ, যেভাবে এর আগে তোমাদের মধ্য থেকে একজন রাসুল পাঠানো হয়েছে। যে তোমাদেরকে শিরক-কুফরি থেকে পবিত্র করে, তোমাদেরকে কিতাব ও প্রজ্ঞা শিক্ষা দেয় এবং এমন বিষয়ও শিক্ষা দেয় যা তোমরা জানতে না।
৩. মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মতের জন্য অবশ্যই এক মহা অনুগ্রহ। আল্লাহর পক্ষ থেকে উম্মতের জন্য সেরা উপহার। মহান আল্লাহ বলেন-
لَقَدۡ مَنَّ اللّٰهُ عَلَی الۡمُؤۡمِنِیۡنَ اِذۡ بَعَثَ فِیۡهِمۡ رَسُوۡلًا مِّنۡ اَنۡفُسِهِمۡ یَتۡلُوۡا عَلَیۡهِمۡ اٰیٰتِهٖ وَ یُزَکِّیۡهِمۡ وَ یُعَلِّمُهُمُ الۡکِتٰبَ وَ الۡحِکۡمَۃَ ۚ وَ اِنۡ کَانُوۡا مِنۡ قَبۡلُ لَفِیۡ ضَلٰلٍ مُّبِیۡنٍ
‘আল্লাহ অবশ্যই বিশ্বাসীদের প্রতি তাদের নিজেদের মধ্যে থেকে (একজন) রাসুল পাঠিয়ে তাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। সে (নবি) তার (নাজিলকৃত আসমানি কিতাব কোরআনের) আয়াতগুলো তাদের কাছে তেলাওয়াত করে তাদেরকে (শিরক ও গোমরাহির অন্ধকার থেকে) পরিশুদ্ধ করে এবং তাদেরকে গ্রন্থ ও প্রজ্ঞা শিক্ষা দেয়। আর অবশ্যই তারা আগে সুস্পষ্ট বিভ্রান্তিতে ছিল।’ (সুরা আল-ইমরান : আয়াত ১৬৪)
এ আয়াতটি প্রসঙ্গে আলোচ্য বিষয় হলো-
কোরআনুল কারিমের বিশ্লেষণ অনুযায়ী নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হচ্ছেন সমগ্র বিশ্বের জন্য সবচেয়ে বড় নেয়ামত ও মহাঅনুগ্রহ। কিন্তু এই আয়াতে শুধুমাত্র মুমিনদের জন্য অনুগ্রহ বলে নির্দিষ্ট করাটা কুরআনের অন্যান্য আয়াতের মাধ্যমে কুরআন সমগ্র বিশ্বের জন্য হেদায়াত হওয়ার বিষয়টি প্রমাণিত থাকা সত্ত্বেও (هُدًى لِلْمُتَّقِينَ) বা ‘মুত্তাকিদের জন্য হেদায়াত” বলারই অনুরূপ যে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাকে মুত্তাকিদের জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে।
কারণ, উভয় ক্ষেত্রেই এক। তাহলো যদিও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অস্তিত্ব মুমিন-কাফের নির্বিশেষে পুরো জগতের জন্যই মহানেয়ামত এবং বিরাট অনুগ্রহ; তেমনিভাবে কোরআনুল কারিমও সমগ্র বিশ্ব-মানবের জন্য হেদায়াত। যেহেতু কোরআনের হেদায়াত ও নেয়ামতের ফল শুধু মুমিন-মুত্তাকিরাই উপভোগ করছে, সেহেতু কোনো কোনো স্থানে একে তাদেরই সাথে সম্পৃক্ত করে বর্ণনা করা হয়েছে।
মনে রাখা জরুরি
মহান আল্লাহ যেমন দুনিয়াতে ঈমান ও ঈমানহীন সবাইকে আলো-বাতাস-জীবিকা সমানতালে দিয়ে যাচ্ছেন; নবি-রাসুলগণও সবার জন্য রহমত। তবে যারা ঈমানের স্বাদ গ্রহণ করেছে, তাদের জন্য বিশেষ রহমত ও অনুগ্রহ।
ঈমানদার বান্দাই নবি-রাসুলদের মাধ্যমে তাদের আনীত জবিন বিধান আসমানি গ্রন্থ থেকে উপকৃত হয়েছেন। নবি-রাসুলদের কাছেই পেয়েছেন সঠিক কোরআনের দিকনির্দেশনা। সঠিক দিকনির্দেশনা দেওয়াই ছিল নবি-রাসুলদের কাজ।
সুতরাং মুমিন মুসলমানের এ বিষয়টি অনুধাবন করা জরুরি যে, নবি মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন উম্মতের জন্য বিশেষ অনুগ্রহ। যিনি উম্মতকে সঠিক পথের দিশা দেওয়ার জন্য পেয়েছেন মহাগ্রন্থ আল-কোরআন। যার আলোয় আলোকিত পুরো বিশ্ব।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে কোরআন-সুন্নাহর আলোকে নিজেদের জীবন আলোকিত করার তাওফিক দান করুন। কোরআনকে জীবন ব্যবস্থা হিসেবে গ্রহণ করার তাওফিক দান করুন। মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রেসালাতের সঠিক বার্তা গ্রহণ করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
এমএমএস/জিকেএস