খানিকটা দেরিতে হলেও, ছেলে চীনের টিকা-কার্যক্রমের আওতায় এসেছে। এখন নিয়মিত বিরতিতে তাকে বিভিন্ন ধরনের টিকা দিচ্ছে বেইজিংয়ের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। অবশ্যই বিনামূল্যে। গত ২২ অক্টোবর ছিল তার চিকেন পক্সের টিকা নেওয়ার দিন। কিন্তু টিকাকেন্দ্রে যাওয়ার পর নার্স বললেন: ’২৫ অক্টোবর স্কুলে বাচ্চাদের ফ্লুর টিকা দেওয়া হবে। আজ চিকেন পক্সের টিকা নিলে, এ বছর আর ফ্লুর টিকা নেওয়া যাবে না; এ টিকা বছরে নির্দিষ্ট দিনেই দেওয়া হয়, ডেট মিস করলে আর দেওয়া যায় না। আজ টিকা নেওয়ার দরকার নেই। আগে ছেলে ফ্লুর টিকা নিক। ফ্লুর টিকা নেওয়ার ১৪ দিন পর কেন্দ্রে এসে চিকেন পক্সের টিকা নিয়ে যাবে।’
Advertisement
যথাসময়ে টিকাকেন্দ্রের লোকজন স্কুলে এসে বাচ্চাদের টিকা দিল। বাদ গেল না আমার ছেলেও। তবে, এই টিকা দেওয়াটাও বাধ্যতামূলক নয়। যার ইচ্ছা টিকা নেবে, যার ইচ্ছা নেবে না। এর আগে ছেলে কখনই ফ্লুর টিকা নেয়নি। এবার নিল। এখন চিকেন পক্সের টিকার সম্ভাব্য তারিখ ৯ নভেম্বর। দু’তিন দিন দেরিতে গেলেও অবশ্য সমস্যা নেই।
এদিকে, এর মধ্যেই স্কুল থেকে নোটিশ এসেছে। ৩ থেকে ১১ বছর বয়সী শিশুদের কোভিডের টিকা দেওয়া হবে। অভিভাবকদের সম্মতিপত্র দরকার। কারণ, কোভিড টিকা নেওয়াও চীনে বাধ্যতামূলক নয়। যার ইচ্ছা নেবে, যার ইচ্ছা নেবে না। আমি সম্মতিপত্রে স্বাক্ষর করে দিলাম। নিজে দু’ডোজ টিকা নিয়েছি। তেমন কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অনুভব করিনি। তাই ছেলের ক্ষেত্রেও মনে সাহস পাচ্ছি। এখন অপেক্ষার পালা। অবশ্য, ৯ নভেম্বরের আগে টিকা নেওয়া যাবে না। কোনো টিকা নেওয়ার পর পরবর্তী টিকার জন্য অন্তত ১৪ দিন অপেক্ষা করতে হয়। এটাই নিয়ম। এখন দেখার বিষয়, কোন টিকা ছেলে আগে পাবে: কোভিড, নাকি চিকেন পক্স!
চীনের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ স্থানীয়ভাবে উৎপন্ন তিনটি কোভিড টিকা ৩ থেকে ১১ বছর বয়সী শিশু-কিশোরদের শরীরে জরুরি ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে সম্প্রতি। এর মধ্যে রয়েছে সিনোফার্মের তৈরি দুটি নিষ্ক্রিয় টিকা (inactivated vaccine) ও সিনোভ্যাক বায়োট্যাকের তৈরি একটি নিষ্ক্রিয় টিকা। চীনের রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ ব্যুরো জানিয়েছে, এই তিনটি টিকা শিশুদের জন্যও নিরাপদ ও কার্যকর বলে গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে।
Advertisement
ওদিকে, ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশু-কিশোরদের টিকা দেওয়ার কার্যক্রম শুরু হয়েছে আরও আগেই, গত জুলাই মাসে। এখন ৩ থেকে ১১ বছর বয়সীদের টিকার আওতায় আনা শুরু হলো। বেইজিং, শাংহাই, কুয়াংতুং, চিয়াংসু, চেচিয়াংসহ ডজনখানেক প্রাদেশিক পর্যায়ের এলাকার বিভিন্ন স্থানে ইতোমধ্যেই ৩ থেকে ১১ বছর বয়সীদের টিকা দেওয়া শুরু হয়েছে। খুব শিগগিরি আমার ছেলের মতো লক্ষ-কোটি শিশু-কিশোর কোভিড টিকা গ্রহণ করবে। প্রথম পর্যায়ের টিকাদান কার্যক্রম ২০ নভেম্বরের মধ্যে এবং দ্বিতীয় পর্যায়ের টিকাদান কার্যক্রম ২০ ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
শিশু-কিশোরদের কোভিড টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত যুক্তিসঙ্গত কারণেই। চীনের রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের প্রধান টিকা পরিকল্পনা বিশেষজ্ঞ ওয়াং হুয়াছিং বলেছেন, কোভিড ভাইরাসের বিরুদ্ধে জনগণের মধ্যে হার্ড ইমিউনিটি (herd immunity) গড়ে তোলার জন্য এটা জরুরি। বিশ্বজুড়েই এখন শিশু-কিশোরদের মধ্যে কোভিড সংক্রমণের হার বাড়ছে। কোনো কোনো দেশে তো এ হার বড়দের প্রায় কাছাকাছি। ফলে, শিশুদের জন্য কোভিড সংক্রমণের ঝুঁকি কম—এমন পুরাতন ধারণায় আর আস্থা রাখা যাচ্ছে না। আবার শিশু-কিশোররা যে-কোনো দেশের একটা বড় অংশ। তাদেরকে টিকা না-দিয়ে হার্ড ইমিউনিটি অর্জন করা যাবে না।
বিশ্বব্যাপীই কোভিড মহামারি পরিস্থিতি বর্তমানে ভালো না। নিউজিল্যান্ড শুরুর দিকে সংক্রমণ কমিয়ে আনার দিক দিয়ে অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছিল। সেদেশেও এখন নতুন নতুন জায়গায় নতুন করে লকডাউন দিতে হচ্ছে। সেখানেও এখন ‘জিরো সংক্রমণ’ ধারণা থেকে সরে এসে হার্ড ইমিউনিটি অর্জনের চেষ্টা করা হচ্ছে। এদিকে, চীনে একটা লম্বা সময় ধরে স্থানীয় সংক্রমণ ছিল না। বাইরে থেকে আক্রান্ত হয়ে যারা আসতেন, তাদের নিয়েই চীন তখন ব্যস্ত থাকতো। কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরে এখানেও পরিস্থিতি পাল্টেছে। প্রায় প্রতিদিনই স্থানীয়ভাবে সংক্রমিত রোগীর সন্ধান মিলছে চীনের বিভিন্ন স্থানে, যদিও সে সংখ্যা বড় না।
পরিস্থিতির খানিকটা অবনতি ঘটলেও, মহামারি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আছে বলেই দাবি চীনের রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের। এ দাবি অমূলকও নয়। চীনে মহামারী নিয়ন্ত্রণে ইতোমধ্যেই গড়ে উঠেছে একটি কার্যকর ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থা সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে বলা চলে। আর এ কারণেই চীনে কোভিডে আক্রান্তের সংখ্যা এখনও এক লাখ ছাড়ায়নি। মহামারিতে মৃতের সংখ্যাও ছাড়ায়নি ৫ হাজারের কোঠা। আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যার দিক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, ব্রাজিল, ব্রিটেনের ধারেকাছেও নেই চীন। কিন্তু মহামারীকে নিয়ন্ত্রণে রাখার ব্যাপারে চীনের কঠোর দৃষ্টিভঙ্গিতে এতটুকু শৈথিল্য দেখা যাচ্ছে না। ৩ থেকে ১১ বছর বয়সীদের টিকার আওতায় আনার সিদ্ধান্ত এর সর্বশেষ প্রমাণ।
Advertisement
চীনের লক্ষ্য চলতি বছর শেষ হবার আগেই হার্ড ইমিউনিটি অর্জন করা। আর এর জন্য চাই ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ নাগরিককে অন্তত দুই ডোজ করে টিকা দেওয়া। ইতোমধ্যেই দেশটিতে ২২৬ কোটি ডোজের বেশি টিকা নাগরিকদের শরীরে প্রয়োগ করা হয়েছে। এর মধ্যে ১০৭ কোটি নাগরিক পেয়েছে দুই ডোজ করে টিকা। চীনে বিশেষ বিশেষ গোষ্ঠীর সদস্যদের তৃতীয় ডোজ তথা বুস্টার ডোজ টিকাও দেওয়া হচ্ছে। শুরুর দিকে চিকিৎসা খাতের লোকজনকে বুস্টার ডোজ দেওয়া হয়েছে। কিছুদিন আগে আমার ছেলের স্কুলের শিক্ষকদের বুস্টার ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে। চীনা গবেষকরা বলছেন, দুই ডোজ টিকা নেওয়ার নির্ধারিত সময় পর যদি কেউ বুস্টার ডোজ টিকা গ্রহণ করে, তবে তার পুনরায় কোভিডে সংক্রমিত হবার আশঙ্কা ৫ গুণ হ্রাস পায়।
চীনে সম্ভাব্য সব উপায়ে মহামারীকে নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়েছে এবং হার্ড ইমিউনিটি অর্জনের প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। এই লক্ষ্য অর্জন করা চীনের জন্য নানান কারণেই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর একটি কারণ, ফেব্রুয়ারিতে বেইজিংয়ে বসতে যাচ্ছে শীতকালীন অলিম্পিকের আসর। অলিম্পিকের আগে এ লক্ষ্য অর্জন হবে চীনের জন্য একটা বড় সাফল্য। তবে, শুধু হার্ড ইমিউনিটির ওপর নির্ভর করে বসে নেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। অলিম্পিক চলাকালে কঠোর নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা থাকছে। অলিম্পিক গ্রাম ও অন্যান্য ভেন্যু ঘিরে থাকছে অদৃশ্য নিরাপত্তা বেষ্টনি।
অলিম্পিক চলাকালে অলিম্পিক গ্রাম থেকে কোনো ক্রীড়াবিদ-কোচ বা কর্মকর্তা-কর্মচারি বাইরে বেরুতে পারবেন না, বাইরের কেউও ভিতরে প্রবেশ করতে পারবেন না; সবাইকে মাস্ক পরতে হবে, মেনে চলতে হবে বিভিন্ন প্রতিরোধমূলক নিয়মবিধি। আবার এর মানে এই নয় যে, ক্রীড়াবিদরা ‘বন্দির’ মতো থাকবেন। নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে তাঁরা ঘোরাফেরা করতে পারবেন; বিশাল অলিম্পিক গ্রামে তাদের চিত্তবিনোদনের নানান ব্যবস্থা থাকছে। তবে, অলিম্পিক গ্রাম থেকে বিভিন্ন ভেন্যুতে যাওয়া-আসার জন্য তাদের জন্য থাকবে বিশেষ পরিবহনব্যবস্থা। বলা বাহুল্য, এসব পরিবহনযানেও মহামারী প্রতিরোধকব্যবস্থা কার্যকর থাকবে।
চীন সম্পর্কে একটি কথা দেশটির ছিদ্র্র অন্বেষণকারীরাও বলে থাকেন, আর কথাটি হচ্ছে: চীন কোনো লক্ষ্য নিয়ে সামনে এগুনো শুরু করলে, একসময় সেখানে ঠিকই পৌঁছে যায়। চীন এখন হার্ড ইমিউনিটি অর্জনের পথে এগুচ্ছে এবং আমার বিশ্বাস সেটা সময়মতো অর্জিতও হবে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এখন পর্যন্ত কোভিডকে আমরা যতটুকু চিনেছি, তাতে শুধু একটি বা কয়েকটি দেশে হার্ড ইমিউনিটি গড়ে ওঠা এই ভাইরাস থেকে পরিত্রাণ পাবার জন্য যথেষ্ট নয়। এই ভাইরাস থেকে চূড়ান্তভাবে রেহাই পেতে হলে সকল দেশেই হার্ড ইমিউনিটি গ্রো করা জরুরি। আর এ কারণেই চীন গোড়া থেকেই কোডিডের টিকাকে বিশ্বের ‘গণপণ্য’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। শুধু ঘোষণা করেই ক্ষান্ত থাকেনি; এখন পর্যন্ত ১৬০ কোটি ডোজ কোভিড টিকা বিভিন্ন দেশে সরবরাহ করেছে, যা একটা বড় অংশই উপহার।
দুঃখজনকভাবে উন্নত বিশ্ব এ ক্ষেত্রে চীনকে শুরু থেকে অনুসরণ করেনি। তারা বরং নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত থেকেছে এবং অনেক ক্ষেত্রে এখনও তা-ই আছে। আর সেকারণেই একদিকে যখন কোনো কোনো উন্নত দেশে অব্যবহৃত লক্ষ-কোটি টিকা নষ্ট হচ্ছে, তখন অন্যদিকে আফ্রিকার বহু দেশের ৯৮ শতাংশ লোকই টিকার আওতার বাইরে থেকে যাচ্ছে। এ অবস্থা মোকাবিলায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা চেষ্টা করছে, চীন চেষ্টা করছে, উন্নত দেশগুলোও এখন খানিকটা নড়াচড়া করছে। আশা করি, বিশ্বের সকল দেশের যৌথ প্রচেষ্টায়, মানবজাতি কোভিড মহামারীর বিরুদ্ধেও একসময় বিজয়ী হবে।
কোনো কোনো বিজ্ঞানী বলছেন, কোভিড-১৯ মানবজাতির সঙ্গী হিসেবেই থেকে যাবে, অনেকটা ফ্লুর মতো। এর সঙ্গে আমাদের সহাবস্থান করতে হবে; এটি আমাদের কখনও ছেড়ে যাবে না। সেক্ষেত্রে এখন যেমন প্রতিবছর বাচ্চাদের এক ডোজ ফ্লুর টিকা দেওয়া হয়, তেমনি হয়তো কোভিডের টিকাও প্রতিবছর নিতে হবে। হোক। তবুও মহামারির এই তাণ্ডব থামুক।
লেখক: বার্তা সম্পাদক, চায়না মিডিয়া গ্রুপ (সিএমজি)।alimulh@yahoo.com
এইচআর/এমএস