শিক্ষকতা একটি মহান ব্রত। একটি শিক্ষিত জাতি গঠনের মূল কারিগর হিসেবে শিক্ষকরা দায়িত্ব পালন করেন। একটি মানুষের জীবনের সকল ক্ষেত্রে এবং পথচলায় শিক্ষকদের ভূমিকা অনস্বীকার্য, যদিও সময়ের পরিক্রমায় তাদের নিরন্তর অবদান খুবই কম স্বীকৃতি পায়।
Advertisement
বাংলাদেশে শিক্ষকদের নিরলস পরিশ্রমকে স্বীকৃতি দেয়ার আনুষ্ঠানিকতা নেই বললেই চলে। অথচ বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে শিক্ষকদের সম্মানিত করার পাশাপাশি তাদের নানা ধরণের সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা হয়।
শিক্ষকদের অবদানকে স্বীকৃতি দিতে ইউনেস্কোর উদ্যোগে ১৯৯৪ সাল থেকে প্রতি বছরের ৫ অক্টোবর বিশ্বব্যাপী পালিত হয় বিশ্ব শিক্ষক দিবস। বাংলাদেশে এতোদিন দিবসটি পালনে চোখে পড়ার মতো কোনো আনুষ্ঠানিকতা না দেখা গেলেও এবছর একটি আয়োজন দেশের শিক্ষক সমাজকে বেশ নাড়া দিয়েছে।
ক্লাসটিউন নামের দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি লার্নিং ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠান ‘স্যালুটিং দ্য নেশন বিল্ডারস’ শীর্ষক মাসব্যাপী এই আয়োজন করেছিলো।
Advertisement
আয়োজকরা জানান, দেশের শতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের সম্মাননা স্মারক ও উপহার হস্তান্তরের মাধ্যমে আয়োজনের শুভ সূচনা করে ক্লাসটিউন। পাশাপাশি শিক্ষকতার মতো মহান ব্রত পালনের অবদানকে স্মরণ করে ফুলেল শুভেচ্ছায় শিক্ষকদেরকে অভিনন্দন জানানো হয়। এর আগে অনলাইনে প্রিয় শিক্ষকদের গল্প আহ্বান করে ক্লাসটিউন। সেখান থেকে নির্বাচিত সেরা গল্পের শিক্ষকদেরও এই সম্মাননা জানানো হয়। আকষ্মিক এই শুভেচ্ছায় অনেকেই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। তারাও তাদের শিক্ষকতা জীবনের স্মৃতি রোমন্থন করেন এবং ক্লাসটিউনকে এই সুন্দর আয়োজনের জন্য কৃতজ্ঞতা জানান।
এই আয়োজনে দেশের বিভিন্ন পেশায় স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিবর্গ তাদের শিক্ষকদের স্মৃতিচারণ করে ভিডিও বার্তা প্রদান করেছেন। সাবেক তত্বাবধায়ক সরকারের শিল্প উপদেষ্টা গীতি আরা সাফিয়া চৌধুরী, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, সাবেক ক্রিকেটার ও সংসদ সদস্য নাইমুর রহমান দুর্জয়, গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব শাইখ সিরাজ, গ্রামীণফোনের সিইও ইয়াসির আজমান, সঙ্গীত শিল্পী পার্থ বড়ুয়া, এসবিকে টেক ভেঞ্চারস এবং এসবিকে ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সোনিয়া বশির কবির ও কর্পোরেট আইকন ওরাকল বাংলাদেশের কান্ট্রি ম্যানেজিং ডিরেক্টর রুবাবা দৌলা তাদের ব্যক্তি ও কর্মজীবনে প্রিয় শিক্ষকদের ভূমিকা তুলে ধরেছেন।
অক্টোবর মাসজুড়ে ক্লাসটিউনের ফেসবুক পেজে https://www.facebook.com/classtune এসব ভিডিও প্রকাশ করা হচ্ছে। ভিডিওগুলো সমাজের সকল স্তরের মানুষের কাছে সাদরে গৃহীত হয়েছে।
আয়োজনের ‘স্যালুটিং দ্য নেশন বিল্ডারস’ নামকরণও বেশ গ্রহণযোগ্য। সর্বোপরি এই আয়োজনের জন্য ক্লাসটিউনকে সাধুবাদ জানাচ্ছেন সবাই।
Advertisement
আয়োজনে অংশ নেয়া অতিথিরা আলোচনায় আনেন শিক্ষা ও শিক্ষক সংশ্লিষ্ট নানা বিষয়। তারা বলেন, শ্রেণিকক্ষে বিভিন্ন কঠোর শাষন ও শাস্তি থাকলেও বাইরে পারষ্পরিক সম্পর্কগুলো খুবই আত্মিক। সেখানে অভিভাবকদের সম্পর্ক খুবই কম বা নেই বললেই চলে। গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটল বলেছিলেন, ‘যারা শিশুদের শিক্ষাদানে ব্রতী তারা অভিভাবকদের থেকেও অধিক সম্মানীয়।’
তবে বর্তমানে আমরা ভিন্নরূপ দেখতে পারছি। এখন শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের মধ্যে সম্পর্ক খুবই আনুষ্ঠানিক হয়ে যাচ্ছে। এই পারষ্পরিক সম্পর্কগুলোতে ভিন্নরূপে পরিবর্তন আসলেও শিক্ষকদের প্রতি মূল্যবোধ এবং অনুভূতি এখনও আগের মতোই আছে।
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে, সকল শিক্ষকরা শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের জন্য সমান সুযোগ-সুবিধা পান না। ভাসমান নৌকা, গাছের নিচে, খোলা আকাশের নিচে কিংবা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষ যেখানেই পাঠদান করেন না কেনো, শিক্ষার্থীদের অনুপ্রেরণা যোগাতে শিক্ষকরা কোনো ছাড় দেন না। স্মার্টবোর্ড কিংবা চক ও স্লেটের মধ্যে যতোই পার্থক্য থাকুক না কেনো আমাদের প্রতি শিক্ষকদের শিক্ষা, শিক্ষার মান এবং জীবনমুখী শিক্ষাদান সবসময়ই সমান থাকে। তারা আমাদের জীবনের কঠিনতম সময়ে দিকনির্দেশনা দেন অথবা নতুন উচ্চতায় পৌঁছাতে সহায়তা করেন।
শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড হলে, শিক্ষকরা হলেন শিক্ষার মেরুদণ্ড। শিক্ষকরা সমস্যায় থাকলে শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করা কঠিন হবে। তাই শিক্ষকদের পাশাপাশি শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষা খাতে যেসকল সমস্যা, প্রতিবন্ধকতা ও অসামঞ্জস্যতা রয়েছে সেগুলো দূর করতে হবে। একটি দীর্ঘমেয়াদী ও পরিকল্পিত শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে।
তাই শিক্ষকদের প্রাপ্য সম্মানটুকু নিশ্চিত করা জরুরি। উন্নত বিশ্বের আদলে তাদের পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা, শিক্ষকদের দক্ষতা উন্নয়নের জন্য যুগোপযোগী ও বিশ্বমানের প্রশিক্ষণ, সিম্পোজিয়াম ও কর্মশালার ব্যবস্থা করা, তাদের খোঁজখবর নেয়াও জরুরি। তবেই বজায় থাকবে শিক্ষকদের আবদানকে স্বীকৃতি দেয়ার রীতি।
এলএ/এএসএম