মতামত

প্রশ্নগুলো সহজ আর উত্তরও তো জানা

স্বাধীনতার ৫০ বছরে সাম্প্রদায়িকতার সর্বপ্লাবী বিস্তার ঘটেছে। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়িয়ে পড়েছে। অথচ হওয়ার কথা ছিল উল্টো। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার আকাঙক্ষায়। কিন্তু ৭৫এর পর থেকেই বাংলাদেশের পেছনে হাঁটা শুরু। সামরিক শাসকেরা নিজেদের ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে বারবার ধর্মকে ব্যবহার করেছেন। স্বৈরাচারের পতন ঘটলেও বাংলাদেশের এই পেছনে হাঁটা আর থামেনি। এমনকি গত এক যুগেরও বেশি সময় যে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়, তারাও এই ধারা বদলানোর চেষ্টা করেনি। বরং ক্ষমতার হিসাব মেলাতে ব্যস্ত আওয়ামী লীগও স্রোতে গা ভাসিয়েছে। স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কাটা অনেক কঠিন। সেই ঝূঁকিতে আর যায়নি আওয়ামী লীগ। কিন্তু স্রোতে গা ভাসানোর সহজ কাজটা করতে গিয়ে বাংলাদেশেরই এখন হারিয়ে যাওয়ার দশা।

Advertisement

স্বাধীনতার পর ৭২ সালে প্রণীত সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি ছিল চারটি- জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দেন। আর এরশাদ আরেক ধাপ এগিয়ে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করেন।

আশির দশকে এরশাদ যখন ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করেন, তখন সর্বদলীয় প্রতিবাদ হয়েছিল। আওয়ামী লীগ তো প্রতিবাদ করেছিলই জোর প্রতিবাদ করেছিল বিএনপি-জামায়াতও। বেগম খালেদা বলেছিলেন, 'ধর্মের নামে জাতিকে বিভক্ত করার চেষ্টা হচ্ছে।' জামায়াত বলেছিল, 'ইসলামী আন্দোলন প্রতিহত করাই রাষ্ট্রধর্মের উদ্দেশ্য।' তখন রাজপথে আন্দোলন হয়েছে। স্লোগান উঠেছে, 'যার ধর্ম তার কাছে, রাষ্ট্রের কী করার আছে।' এরশাদ পতনের পর বিএনপি ক্ষমতায় এসেছে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে, বিএনপির লেজ ধরে জামায়াতও ক্ষমতার স্বাদ পেয়েছে। কিন্তু কেউই আর রাষ্ট্রধর্ম নিয়ে কথা বলেনি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে রাষ্ট্রধর্ম স্পর্শ না করলেও সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা ফিরিয়ে এনেছে। তাতে সংবিধানটা আরো বিদঘুটে হয়েছে- ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। এ যেন সোনার পাথরবাটি। কদিন আগে তথ্য প্রতিমন্ত্রী ডাঃ মুরাদ হাসান রাষ্ট্রধর্ম বাতিল করে ৭২এর সংবিধানে ফিরে যাওয়ার কথা বলে প্রবল সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন। এমনকি দলেও তিনি কোনো সমর্থন পাননি। বরং দলের কেউ কেউ 'এটা তার ব্যক্তিগত মত' বলে এড়িয়ে গেছে। আশির দশকে যে বাংলাদেশে রাষ্ট্রধর্মের বিরুদ্ধে সর্বদলীয় প্রতিবাদ হয়েছিল, সে বাংলাদেশে এখন রাষ্ট্রধর্ম নিয়ে কথা বলাও ঝুঁকিপূর্ণ। তখন যে আন্দোলন হয়েছিল, এটাই এখন অবিশ্বাস্য লাগে। গত তিন দশকে বাংলাদেশ এগোলো না পিছালো?

সাম্প্রদায়িকতার এই বিপুল বিস্তারের কুফল আমরা দেখতে পাই কখনো রামুতে, কখনো নাসিরনগরে, কখনো যশোরে, কখনো কুমিল্লায়, কখনো পীরগঞ্জে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনায়। এবার শারদীয় দুর্গোৎসবে কুমিল্লায় পবিত্র কোরআন অবমাননা এবং তার প্রতিক্রিয়ায় দেশের বিভিন্নস্থানে সাম্প্রদায়িক হামলার পর এখন আবার দেশজুড়ে রুখে দাঁড়ানোর ডাক এসেছে। দাবি উঠেছে, এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে ব্যবস্থা গ্রহণের। এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে কী করতে হবে, সেটা সবচেয়ে ভালো জানেন যার কাছে সবার দাবি, সেই শেখ হাসিনা। হামলার পরপরই শেখ হাসিনা স্পষ্ট করে বলেছেন, দায়ীদের চিহ্নিত করে এমন শাস্তি দিতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে আর কেউ এ ধরনের ঘটনা ঘটানোর সাহস না পায়। এটাই সবচেয়ে কার্যকর ও তাৎক্ষণিক সমাধান। কিন্তু শেখ হাসিনা যা ভাবেন, তার পারিষদের চিন্তা তার সাথে মেলে না। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এখন ব্যস্ত বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সাম্প্রদায়িক সহিংসতা কত সামান্য ঘটনা তা প্রমাণে। বাংলাদেশের গণমাধ্যম দায়িত্বশীলতার কারণে শুরুর দিকে ঘটনা কিছুটা চেপে রেখেছিল, যাতে সংঘাতের বিস্তার না ঘটে। বিস্তার পুরোপুরি ঠেকানো যায়নি বটে তবে এবার ১০ জায়গায় হামলা হয়েছে, গণমাধ্যম ব্যাপক প্রচার করলে ৪০ জায়গায় হামলা হতে পারতো। গণমাধ্যম দায়িত্বশীলতার জায়গা থেকে চেপে গেছে, তাই বলে মন্ত্রীরা অস্বীকার করবেন? পত্রিকায় ছাপা হয়নি বলেই, ঘটনা ঘটেনি বলার সুযোগ নেই। বলছিলাম বিচারের কথা। দৃষ্টান্তমূলক সাজাই পারে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করতে। কিন্তু সমস্যা হলো, দৃষ্টান্তমূলক শান্তি তো দূরের কথা, বিচারই হয় না। রামু, নাসিরনগর, যশোর, সুনামগঞ্জ- কোনো ঘটনারই বিচার হয়নি। গত ৩০ অক্টোবর ছিল নাসিরনগরে হামলার পাঁচবছর পূর্তি। সেদিন পত্রিকায় দেখলাম, এ ঘটনায় দায়ের করা ৮টি মামলার মধ্যে ১৩ মাস পর একটি মামলার চার্জশিট হয়েছে। বাকি ৭ মামলায় ৩০ বার তদন্তকারী কর্মকর্তা বদল হয়েছে, কিন্তু অভিযোগপত্র আর হয়নি। পাঁচ বছরে যদি চার্জশিটই না হয়, তবে সে মামলার আর বিচার হবে কবে? নাসিরনগরে হামলার অজুহাত বানানো হয়েছিল রসরাজ নামের একজনের ফেসবুক স্ট্যাটাসকে। অথচ পরে জানা গেল পেশায় জেলে রসরাজ ফেসবুক চালাতেই পারে না। নাসিরনগরের মূল মামলায় চার্জশিট না হলেও রসরাজের বিরুদ্ধে দায়ের করা তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের মিথ্যা মামলায় ১০২ বার তারিখ পড়েছে। এখন রসরাজ মাছ ধরবে না আদালতে হাজিরা দেবে। এভাবেই ঝুমন দাশেরা জেল খাটে, রসরাজেরা হয়রানির শিকার হয়; আর আসল অপরাধীরা হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেরায়। পরে বাতিল হলেও নাসিরনগরের ঘটনায় অভিযুক্ত একজন স্থানীয় সরকার নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছিল। এই যদি হয় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির হাল, তাহলে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধের চেষ্টা করে লাভ নেই।

Advertisement

সাম্প্রদায়িক সহিংসতার পুনরাবৃত্তি রোধের তাৎক্ষণিক উপায় হলো শাস্তি, আর দীর্ঘমেয়াদী উপায় হলো, জাতিকে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় গড়ে তোলা, এগিয়ে নেয়া। এ উপায়টাও বাতলেছেন শেখ হাসিনাই। গত ১৮ অক্টোবর ছোট ভাই শেখ রাসেলের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা বলেছেন, 'শিশুদের চেতনায় অসাম্প্রদায়িকতার চেতনা গেঁথে দিতে হবে, যাতে আগামীর বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে গড়ে উঠতে পারে।'

আসলে প্রশ্নগুলো সহজ, আর উত্তরও আমাদের সবার জানা। কিন্তু সমস্যা হলো সেই জানা উত্তরটাও আমরা পরীক্ষার খাতায় লেখার সাহস পাই না। তাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ গড়ার পরীক্ষায় বারবার ফেল করি। এবার সাম্প্রদায়িক হামলায় অংশগ্রহণকারীদের বয়স ১৮ থেকে ২৫। তারমানে এরা সবাই বেড়ে উঠেছে, আওয়ামী লীগের আমলে তাহলে এদের মাথায় অসাম্প্রদায়িকতার চেতনা গেঁথে দেয়া গেল না কেন? কেন এরা সুযোগ পেলেই হিন্দুদের বাড়িতে আগুন দেয়, কেন বুকে বোমা বেঁধে ঝাঁপ দেয়? ৭৫এর পর ২১ বছর বিকৃত ইতিহাস পড়ানো হয়েছে, রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার ঘটানো হয়েছে। কিন্তু গত একযুগ তো আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। তাহলে দায় দেবে কাকে? আসলে বাঘের ঘরেই ঘোগের বাসা। সরকার যখন হেফাজতের দাবি মেনে ভাস্কর্য সরায়, পাঠ্যপুস্তক বদলায়; তখন শিশুদের হৃদয়ে অসাম্প্রদিয়কতা নয়, সাম্প্রদায়িকতাই গেঁথে যায়।

শেখ হাসিনা সাম্প্রদায়িক হামলার পুনরাবৃত্তি রোধ এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বাংলাদেশ গড়ার তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘমেয়াদী সব উপায়ই জানেন। সব সাম্প্রদায়িক হামলায় দায়ীদের কঠোর শাস্তি দিতে হবে এবং শিশুদের মনে অসাম্প্রদিয়কতা গেঁথে দিতে হবে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের অসাম্প্রদায়িক সোনার বাংলা গড়ার কাজটা তাঁর কন্যাকেই করতে হবে। এখানে আপস বা কৌশলের কোনো সুযোগ নেই।

এইচআর/জেআইএম

Advertisement