ডা. মাহাবুবা রহমান
Advertisement
ছোটবেলা থেকে আমাদের পরিবার, সমাজ এটা শেখায় যে, জীবনে যদি সুখী হতে চাও; তবে বড় কিছু করো। যদি বড় কিছু করতে চাও তাহলে কিছু লক্ষ্য পূরণ করো। এমনকি স্কুলে থাকতে যখন রচনা লিখতে হতো; তখন ‘এইম ইন লাইফ’ বা ‘জীবনের লক্ষ্য’ রচনা লেখেননি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না।
অথচ সুখী হওয়ার জন্য কি কেবল লক্ষ্যে পৌঁছানোই যথেষ্ট? কিংবা সত্যিকারের সুখী হতে গেলে সব সময় লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারা কি আদৌ প্রয়োজন? এটা বুঝতে গেলে আগে বুঝতে হবে লক্ষ্য কী?
লক্ষ্য বা গোল হলো ভবিষ্যতের কোনো একটি পরিণতি, যেটাকে সফল করার স্বার্থে বর্তমানে নানা রকম পরিকল্পনা করি এবং সেই মোতাবেক কাজ করি। কিছু স্টেরিওটাইপড লক্ষ্য কিন্তু অলরেডি সমাজে তৈরিই আছে। যেমন জ্ঞান-বুদ্ধি হওয়ার পরপরই ভালো একটি স্কুলে ভর্তি হওয়া, ভালো রেজাল্ট করা, ভালো ক্যারিয়ার করা, ভালো ইনকাম করা, সবশেষে একটি ভালো বিয়ে করা। আজকাল তো আবার বিয়ের পরেও নতুন নতুন লক্ষ্য তৈরি হচ্ছে—ছেলেমেয়েদের ভালো স্কুলে পড়ানো, মাসে একদিন ব্যুফে ডিনার কিংবা বছরে একটি ট্যুর।
Advertisement
সে যা-ই হোক, ধরে নেই যে জীবনের এই লক্ষ্য বা গোলস, এগুলো যে যত বেশি অর্জন করতে পারে; সে তার জীবনে তত বেশি সুখী। কিন্তু আসলে কি তাই? এটা ঠিক যে, একটা লক্ষ্যে পৌঁছতে পারলে তার পরবর্তী কিছুদিন ভীষণ আনন্দ কাজ করে, জীবনটাকে স্বার্থক মনে হয়। কিন্তু সেই সময়টা যখন শেষ হয়ে যায়, তখন? তখন কিন্তু আবার নতুন আরেকটা লক্ষ্যে পৌঁছানোর চেষ্টা, সেটা নিয়ে চিন্তা-দুশ্চিন্তা, স্ট্রেস ইত্যাদি।
অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, জীবনের যে কোনো দুটি লক্ষ্যের মধ্যবর্তী সময়টা আসলে খুব ভালো কাটছে না। আমরা শুধু ছুটছি আর ছুটছি—এক লক্ষ্য থেকে অন্য লক্ষ্যে, সেখান থেকে আবার আরেক লক্ষ্যে। এসএসসিতে জিপিএ ফাইভ পেয়ে আনন্দের রেশ কাটতে না কাটতেই এইচএসসির রেজাল্ট নিয়ে চিন্তা, আবার সেই রেজাল্টের খুশি শেষ হতে না হতেই ভালো ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার টার্গেট। এরমধ্যে কোনো একটা টার্গেট যদি মিস হয়ে যায়, তাহলে তো কথাই নেই! জীবনটাকেই তখন অর্থহীন মনে হয়, তীব্র হতাশায় ডুবে যাই।
এবার তাহলে নিজেকে প্রশ্ন করুন, শুধু লক্ষ্য অর্জনের পিছে দৌড়ে কিংবা লক্ষ্য অর্জন করতে পেরে আপনি কি আসলেই সুখী হতে পেরেছেন? তাহলে সুখী হওয়ার মূলমন্ত্র কী? মহাপুরুষদের ন্যায় জাগতিক সব মায়া ত্যাগ করে ধ্যানমগ্ন হয়ে থাকা? হ্যাঁ, কেউ যদি সেভাবে সুখী হতে চায় আপত্তি নেই। তবে সুখী হওয়ার জন্য সেটা বাধ্যতামূলক নয়। চাইলে জীবনের সব বস্তুগত চাহিদার মাঝেও সুখী হতে পারেন। সেটার জন্য আপনাকে বুঝতে হবে মূল্যবোধ।
মূল্যবোধ বা ভ্যালুস হচ্ছে সেইসব বিষয়, যেগুলো জীবনের ছোট ছোট বিষয়গুলোকে উপভোগ করতে শেখায়। দুটি লক্ষ্য অর্জনের মধ্যবর্তী সময়টাকেও সুন্দর করতে পারে। একটি খুব সহজ গল্প দিয়ে বিষয়টি বোঝানো যাক—
Advertisement
ধরুন, আপনার এক বন্ধুর সঙ্গে একটি ট্যুরিস্ট স্পটে বেড়াতে যাচ্ছেন। মানুষ হিসেবে আপনি একজন গোল ফোকাসড এবং আপনার বন্ধুটি একজন ভ্যালু ফোকাসড মানুষ। যাত্রাপথে সারাটা রাস্তা ধরে আপনি কেবল এটাই ভাবছেন, কতক্ষণে ট্যুরিস্ট স্পটে পৌঁছবেন। বারবার ঘড়ি দেখছেন, উসখুস করছেন, উঁচু-নিচু রাস্তার জন্য গাড়ির গতি একটু স্লো হলেই বিরক্ত হচ্ছেন। অন্যদিকে বন্ধুটিও আপনার মতোই কাঙ্ক্ষিত জায়গায় যাওয়ার জন্য উদগ্রীব। সেইসাথে যাত্রাপথের সবকিছুর প্রতি সে আগ্রহী। সরু পথ, পথের দুধারে বড় বড় গাছ, গাছের পাতার ফাঁক গলে বেরিয়ে আসা সূর্যের আলো কিংবা উঁচু-নিচু পথের ঝাঁকুনি—সবই তার কাছে ভীষণ উপভোগ্য।
অবশেষে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে যখন গন্তব্যে পৌঁছলেন; তখন দুজনই বেশ খুশি। নতুন জায়গায় দুজনে খুব ঘুরলেন। সারাদিন শেষে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্যে যখন রওনা হলেন; তখন ঘটল নতুন বিপত্তি। কিছুদূর যেতেই গাড়ি আর চলে না। বন্ধুটি চলতি পথের একটি পিকআপ ট্রাকের কাছে সাহায্য চাইল, যেন সেটি আপনাদের বাড়ি পৌঁছতে সাহায্য করে এবং চালক রাজি হয়ে গেল। এরপর আপনি এবং আপনার বন্ধু সেই ট্রাকের পেছনে চড়ে বসলেন।
পুরো ঘটনায় আপনি প্রচণ্ড বিরক্ত, হতাশ এবং রাগান্বিত। কারণ পিকআপ ট্রাক যে পথে যাবে, সেই পথ ধরে আগালে আপনাদের গন্তব্যে পৌঁছতে বেশ দেরি হবে। এটা ভেবে আশেপাশের কিছুই আপনার ভালো লাগছে না। মাথায় শুধু ঘুরছে, কতক্ষণে বাসায় পৌঁছবেন। অন্যদিকে আপনার বন্ধুটির কাছে ট্রাক জার্নি জীবনে একেবারেই নতুন একটি অভিজ্ঞতা। খোলা ট্রাকের পেছনে বসে খোলা আকাশ দেখার অনুভুতি তার কাছে খুবই উপভোগ্য। তার মানসিকতা এই, বাসায় তো যাওয়া হবেই কোনো না কোনোভাবে। হয়তো কিছুটা দেরি হবে। কিন্তু এরকম অভিজ্ঞতা হয়তো জীবনে দ্বিতীয়বার আসবে না। এসব ভেবে পুরো যাত্রাপথটাই তার কাটল বেশ ভালো।
গল্পটি থেকে কিছু বোঝা যাচ্ছে? এ গল্পে আপনি এবং আপনার বন্ধুর গন্তব্য কিন্তু এক। গন্তব্যে পৌঁছতে পেরে দুজনই সমান খুশি। কিন্তু এ গন্তব্যে পৌঁছানোর যে দীর্ঘ পথ, সেই পথটি আক্ষরিক অর্থে এক হলেও মানসিকভাবে দুজনের জন্য একই রকম ছিল না। এখানে গন্তব্য যদি হয় গোল আর পথ যদি হয় জার্নি টুওয়ার্ডস গোল, তাহলে সহজ ইংরেজিতে বলা যায়, you & your friend both achieved the goal right but you had a frustrated journey all through the time whereas, your friend had a journey of fulfillment. এটাই গোল ফোকাসড এবং ভ্যালু ফোকাসড লাইফের পার্থক্য।
এতক্ষণ আমি যা লিখলাম, সেগুলো Acceptance & Commitment Therapy বা সংক্ষেপে ACT সাইকোথেরাপির খুব সামান্য একটি অংশ। যেটি আমাদের লক্ষ্যকেন্দ্রিক জীবনে মূল্যবোধের গুরুত্ব বোঝায়। জীবনে লক্ষ্য থাকার প্রয়োজন আছে, অবশ্যই আছে। কিন্তু আপনি যদি সারাক্ষণ শুধু লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য মুখিয়ে থাকেন তাহলে কখনোই জীবনের আসল স্বাদ পাবেন না। জীবনকে নিয়ে কখনো সন্তুষ্ট হতে পারবেন না। অফিসের অ্যাসাইনমেন্টের ডেডলাইন নিয়ে ভাবতে ভাবতে আপনার মনোযোগ হয়তো ল্যাপটপের স্ক্রিনেই আটকে থাকবে। ওদিকে আপনার দুই বছরের শিশুটি আপনার পাশে বসেই না জানি কী কঠিন একটি বাংলা শব্দ উচ্চারণ করে ফেলবে, আপনি জানবেনও না!
তাই জীবনে যখন যেখানে আছেন; তখন সেই সময়টাকেই উপভোগ করুন। সেই সময়ের জিনিসগুলোকে মূল্যায়ন করুন। ব্যর্থতাগুলোকে লক্ষ্যপূরণের ব্যর্থতা হিসেবে না দেখে মূল্যবোধের দৃষ্টিতে দেখুন। তবেই আর হতাশা গ্রাস করবে না। জীবন তো একটাই। বাঁচার সুযোগও একবারই। এই এক জীবনের প্রতিটি মুহূর্তেই নতুনভাবে বাঁচুন।
লেখক: রেসিডেন্ট চিকিৎসক, ডিপার্টমেন্ট অব চাইল্ড অ্যান্ড এডোলেসেন্ট সাইকিয়াট্রি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়। ওয়েবসাইট- http://www.drmahabuba.com।
এসইউ/এএসএম