পূর্বঘোষণা অনুযায়ী গত ১ অক্টোবর থেকে আইন মেনে বিদেশি চ্যানেলগুলোর বিজ্ঞাপনমুক্ত (ক্লিন ফিড) সম্প্রচার কার্যকর হয়। সেদিন থেকেই ক্লিন ফিড ছাড়া বাংলাদেশে কোনো বিদেশি চ্যানেল দেখা যাচ্ছে না।
Advertisement
অন্যদিকে আগামী ৩০ নভেম্বরের পর থেকে ঢাকা ও চট্টগ্রামের ক্যাবল নেটওয়ার্কিং সিস্টেম কেউ অ্যানালগভাবে চালাতে পারবে না, সবাইকে ডিজিটাল বক্সে চালাতে সময় বেঁধে দিয়েছে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়। সরকারের এমন কঠোর অবস্থানে চাপের মুখে রয়েছেন ক্যাবল অপারেটর ব্যবসায়ীরা।
জানা গেছে, সরকারি নির্দেশনা মেনে গত ১ অক্টোবর থেকে সব বিদেশি টেলিভিশন চ্যানেলের সম্প্রচার বন্ধ রাখেন বাংলাদেশের ক্যাবল অপারেটররা। পরে গত ৫ অক্টোবর সব চ্যানেল বন্ধ না রেখে বিজ্ঞাপনমুক্ত (ক্লিন ফিড) বিদেশি টিভি চ্যানেল বা অনুষ্ঠান সম্প্রচারের নির্দেশ দেয় তথ্য মন্ত্রণালয়। ডিডব্লিউ, এনএইচকে ওয়ার্ল্ড, বিবিসি ওয়ার্ল্ড, ভয়েস অব আমেরিকা, আল জাজিরা, সৌদি কোরআন, সৌদি অ্যারাবিয়া, সিজিটিএন, রাশিয়া টুডে, ফ্রান্স টুয়েন্টিফোর, কেবিএস ওয়ার্ল্ড, সিএনএন, লোটাস ম্যাকাও, ট্রাভেলএক্সপি এইচডি, সিনেমা অ্যাকশন, সিনেমাসি কমেডি, আরিরাং, টিভিফাইভ মন্ডে, নাইনএক্সএম চ্যানেলগুলো ক্লিন ফিড বাস্তবায়ন করায় এসব চ্যানেল চালানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়।
আইন অনুযায়ী যাদের মাধ্যমে দর্শক বিদেশি চ্যানেল দেখছেন, তারাই ওই বিদেশি চ্যানেলগুলো বিজ্ঞাপন ছাড়া সম্প্রচার করবে। ক্লিন ফিড হচ্ছে বিদেশি চ্যানেলের অনুষ্ঠানের মধ্যে কোনো ধরনের বিজ্ঞাপন দেখানো যাবে না। কিন্তু বাংলাদেশে সম্প্রচার হওয়া বিদেশি চ্যানেলগুলো সেটি মানছিল না। অনুষ্ঠানের মধ্যে তারা বিজ্ঞাপন প্রচার করে আসছিল। ভারত-পাকিস্তানসহ পার্শ্ববর্তী দেশেও ক্লিন ফিড বা বিজ্ঞাপন ছাড়া বিদেশি চ্যানেলের সম্প্রচার হয়। তবে ১ অক্টোবরের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশে এটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছিল না।
Advertisement
ক্যাবল অপারেটররা জানিয়েছেন, ক্লিন ফিড বাস্তবায়নের পর অন্যান্য দেশের চ্যানেলের মতো ভারতীয় প্রায় সব চ্যানেল বন্ধ ছিল। জি বাংলা, স্টার জলসা, কালার বাংলা, জলসা মুভি, জিটিভির মতো চ্যানেলগুলোর সিরিয়ালের জনপ্রিয়তা বাংলাদেশে অনেক বেশি। ফলে এসব চ্যানেল বন্ধ থাকায় বেশি চাপে পড়েন ক্যাবল অপারেটররা। সম্প্রতি এসব চ্যানেলের ক্লিন ফিড সম্প্রচার শুরু হয়েছে। ক্লিন ফিডে চ্যানেল চালানো সম্ভব নয়—অপারেটরদের এমন বক্তব্যের পরও কীভাবে সেটি সম্ভব হলো সে বিষয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলেছে জাগো নিউজ।
ফিরোজ ফরাজি নামের এক ক্যাবল অপারেটর জাগো নিউজকে বলেন, সরাসরি ক্লিন ফিড আমরা এখনো পাইনি। তবে মূলত জি বাংলা ও স্টার জলসার মতো কয়েকটি জনপ্রিয় চ্যানেল কেউ কেউ চালাচ্ছেন। সবাই সেটি চালাতে পারছেন না, কারণ এটি মূলত ভিন্নভাবে সম্প্রচার করা হচ্ছে। এসব চ্যানেলের অনুষ্ঠানের মধ্যে বিজ্ঞাপন চলার সময় আমরা ওপরে একটি ব্যানার ব্যবহার করছি, এতে সেই বিজ্ঞাপনটি দেখা যাচ্ছে না। তবে এটি করা খুবই কঠিন। কারণ এজন্য এসব চ্যানেল মেইনটেইনের জন্য আলাদা লোক প্রয়োজন হচ্ছে। সবসময় সেটি সম্ভবও হয় না। কিন্তু দর্শকদের চাহিদার কথা মাথায় রেখে এটি করা হচ্ছে। এতে সরকারের সিদ্ধান্তের বাস্তবায়নও হচ্ছে, আবার দর্শকরাও চ্যানেলগুলো দেখতে পাচ্ছেন।
ক্লিন ফিড বাস্তবায়নের বিষয়ে অ্যাটকোর সদস্য ও ডিবিসি নিউজের চেয়ারম্যান ইকবাল সোবহান চৌধুরী বলেন, ক্যাবল অপারেটর নীতিমালায় ক্লিন ফিড দিয়েই কিন্তু বিদেশি চ্যানেল চালানোর কথা। সেভাবে না চালিয়ে তারা এতদিন এভাবেই চালিয়েছেন। এরপর সরকারের পক্ষ থেকে বেশ কয়েকবার তাদের বাস্তবায়নের তাগিদ দেওয়া হয়েছে। সেই সময়ের মধ্যে তারা সেটি করেননি। সরকার এখন আইন বাস্তবায়নের জন্য একটা চূড়ান্ত পক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু তারা (ক্যাবল অপারেটর) বরং আইন ভঙ্গ করছেন। তারা আইনও মানছেন না। সরকার তার আইন বাস্তবায়নের জন্য যে পদক্ষেপ নিয়েছে সে বিষয়ে তারা কঠোর থাকবেন বলে আশা করি। অন্তত আইন ভঙ্গ করে বিদেশি চ্যানেল সম্প্রচার বন্ধ হয়ে যাবে।
এদিকে আগামী ৩০ নভেম্বরের পর থেকে ঢাকা ও চট্টগ্রামের ক্যাবল নেটওয়ার্কিং সিস্টেম কেউ অ্যানালগভাবে চালাতে পারবে না। সবাইকে ডিজিটাল বক্সে চালাতে সময় বেঁধে দিয়েছে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়। একই সঙ্গে কুমিল্লা, বগুড়া, কুষ্টিয়া, রাঙ্গামাটি, কক্সবাজার শহরে এ কার্যক্রম ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে ডিজিটালাইজড করতে বলা হয়েছে। আগে ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরে ক্যাবল নেটওয়ার্কিং সিস্টেম ডিজিটালাইজড করার সিদ্ধান্ত থাকলেও করোনার কারণে সে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা যায়নি। তাই আগামী ৩০ নভেম্বরের মধ্যে ক্যাবল নেটওয়ার্কিং সিস্টেম ডিজিটালাইজড করার নির্দেশনা দিয়ে পরিপত্র জারি করা হয়েছে।
Advertisement
ক্যাবল অপারেটররা বলছেন, গত ১ অক্টোবর থেকে বিদেশি চ্যানেলের মধ্যে বিশেষ করে ভারতীয় চ্যানেলগুলো বন্ধ থাকায় দর্শকরা ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। একদিকে ক্লিন ফিড বাস্তবায়ন অন্যদিকে দর্শকের চাহিদা, সবমিলে দ্বিমুখী চাপ রয়েছে। এর মধ্যে ৩০ নভেম্বরের মধ্যে ক্যাবল নেটওয়ার্কিং সিস্টেম ডিজিটালাইজড করার নির্দেশনা নতুন করে সংকট তৈরি করেছে। সার্বিকভাবে ডিজিটালাইজড করার জন্য প্রস্তুতি থাকলেও কিছু বাধ্যবাধকতায় এটি করা কঠিন হবে। কারণ এটি বাস্তবায়নে যে সেটবক্স লাগবে সেটির খরচ বহন করা অনেক অপারেটরের জন্য কঠিন বলে দাবি ব্যবসায়ীদের।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ক্যাবল অপারেটর ব্যবসায়ী বলেন, ডিজিটালাইজড হলেও মূলত ক্যাবল যেভাবে বিস্তার করা আছে ঠিক একইভাবে থাকবে। বর্তমানে গ্রাহক টিভিতে সরাসরি একটি ক্যাবল লাইন লাগিয়ে চ্যানেলগুলো দেখতে পারছেন। কিন্তু ডিজিটাল করা হলে এ ক্যাবল টিভিতে সরাসরি লাগালে সেটি আর দেখা যাবে না। টিভিতে ডিজিটাল অপশনে দেখতে হলে ক্যাবল লাইনটি লাগাতে হবে সেট টপ বক্সে। সেই বক্সের লাইনটি টিভিতে যুক্ত করলেই সব চ্যানেল দেখা যাবে। এতে একটি কন্ট্রোলে ২৫০ থেকে ৩০০ চ্যানেল দেখা যাবে।
তিনি বলেন, নিয়ম অনুযায়ী একটি বক্সের দাম দুই হাজার টাকা হলে অর্ধেক খরচ বহন করবে কন্ট্রোল রুম, বাকি অর্ধেক গ্রাহককে দিতে হবে। এসব বক্স যেই কন্ট্রোল রুমের আওতায় কিনে চালানো হবে, তার সীমার মধ্যেই থাকবে। এর বাইরে এটি চলবে না। কারণ এক কন্ট্রোল রুমের সফটওয়্যারের সঙ্গে অন্য কন্ট্রোল রুমের সফটওয়্যার মিলবে না। এটি দুটি সিস্টেমের হয়ে থাকে, একটি ডিটিএইচ, আরেকটি এইচটিটিএইচ। বর্তমানে আকাশ ডিটিএইচের যা কাজ, ডিজিটালাইজড হলে এইচটিটিএইচেরও কাজ হবে একই। এটি বাস্তবায়ন হলে টিভির ছবি দেখা যাবে ঝকঝকে।
জানা গেছে, ক্যাবল নেটওয়ার্কিং সিস্টেম ডিজিলাইজড না হওয়ায় সরকার হাজার হাজার কোটি টাকা রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। দুই লাখ গ্রাহক থাকলেও দুই হাজার দেখিয়ে সেটার ওপর ভ্যাট দেন ক্যাবল অপারেটররা। ডিজিটালাইজড হলে কোনো অপারেটরের অধীনে কত গ্রাহক রয়েছেন সে তথ্য জানা যাবে। ফলে ভ্যাট ফাঁকি দেওয়া সম্ভব হবে না। একই সঙ্গে দর্শকও একই টাকায় বাড়তি অনেক চ্যানেল দেখতে পারবেন।
এ বিষয়ে ক্যাবল অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (কোয়াব) সভাপতি এস এম আনোয়ার পারভেজ জাগো নিউজকে বলেন, ক্যাবল অপারেটরদের সিস্টেম ডিজিটালাইজড করার জন্য আমরা তো রেডি আছি। কিন্তু সেট টপ বক্স ছাড়া এটি অ্যাপ্লাই করা কঠিন। বাংলাদেশে যদি এক কোটি সেট টপ বক্সও প্রয়োজন হয় তাহলে ১০ মিলিয়ন, আর দুই কোটি হলে ২০ মিলিয়ন বক্স লাগবে। একেকটা বক্সের দাম দুই হাজার টাকা করে হলেও চার হাজার কোটি টাকার প্রয়োজন। এ পরিমাণ টাকার সংস্থান তো হয়নি। মন্ত্রী বলেছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলবেন। আমার মনে হয় বক্স অ্যাপ্লাই করার আগ পর্যন্ত সম্ভব হবে না। কিন্তু ডিজিটাল নেটওয়ার্ক রেডি হয়ে গেছে সব জায়গায়। বাস্তবায়ন না হলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার কথা বলা হচ্ছে, ব্যবসা তো এমনিতেই বন্ধ হয়ে গেছে, বাকিটুকুও বন্ধ হয়ে যাবে। চ্যানেল এভাবে বন্ধ করে ডিজিটালাইজেশন করেও কাজ হবে না।
ক্লিন ফিড প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ক্লিন ফিড বাস্তবায়নের পর যেমন ছিল সেরকমই আছে। এখন যে চ্যানেল ক্লিন ফিডের কথা বলে প্রচার হচ্ছে সেটা ম্যানুয়ালি, শত শত চ্যানেল এভাবে সম্প্রচার করা সম্ভব নয়। ক্যাবল অপারেটরদের ব্যবসা থাকবে কি না সে ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। একটা সেক্টর যদি ধ্বংস হয়ে যায়, এর সঙ্গে চার-পাঁচ লাখ লোক জড়িত। এটা সরকার অবশ্যই উপলব্ধি করবে বা বুঝবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত আমরা কোনো আশার আলো দেখছি না। ক্লিন ফিড দিয়ে এখন কোনো চ্যানেলই চলছে না। বাংলাদেশের ৩৫টি চ্যানেল এবং সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী সিএনএনসহ ১৯টি চ্যানেল চলছে। আমাদের গ্রাহক এখন সুইচ করে ইউটিউবসহ অন্যান্য মাধ্যমে যাবে, সেখানে সব বিজ্ঞাপনও আছে। আমরা এখন ধ্বংসের শেষ পর্যায়ে।
ডিজিটালাইজেশন নিয়ে কোয়াব যে দাবি করেছে সে প্রসঙ্গে তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ জাগো নিউজকে বলেন, ডিজিটালাইজেশনের জন্য যে বক্সটি লাগে সেটি এক হাজার ২০০ টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো ফান্ডের কথা বলিনি। তারা প্রত্যেকটা বিষয়ে উছিলা (অজুহাত) খোঁজেন। ক্লিন ফিডের বেলায় আরও দুই বছর সময় লাগবে বলেছিল, সেটি তো এখন হয়ে গেছে। যথাসময়ে এটি বাস্তবায়ন করতে হবে।
ক্লিন ফিড প্রসঙ্গে সম্প্রচারমন্ত্রী বলেন, আমরা ক্লিন ফিড কার্যকর করতে অনড় অবস্থানে আছি। বিদেশি চ্যানেলগুলো ক্লিন ফিড করে পাঠানো শুরু করেছে। কেউ ক্লিন ফিড করে আমাদের এখানে পাঠালে সম্প্রচারে কোনো বাধা নেই। কিন্তু ক্লিন ফিড ছাড়া পাঠালে সেটি সম্প্রচার করা সম্ভব হবে না।
আইএইচআর/ইএ/এইচএ/এএসএম