স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে নগরায়ণের পরিমাণ ছিল মাত্র ৮ শতাংশ। বিভিন্ন সংস্থার তথ্যমতে এ নগরায়ণের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ৩০ শতাংশের বেশি। দেশের জনসংখ্যা এখন ১৬ কোটির বেশি। এর এক-তৃতীয়াংশ নগরবাসী। দ্রুতগতিতে জনসংখ্যা বাড়ার কারণে নগরায়ণও পেয়েছে গতি। ফলে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জেলা শহর। তাতে বাড়ছে জলাবদ্ধতা, গণপরিবহন ও আবাসন সংকট। এসব সংকট নিরসনে ও মানুষের জীবনমান উন্নয়নে নেওয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা-ড্যাপ প্রণয়ন করা হয়েছে। নগরায়ণের সংকট ও সমাধানে জাগো নিউজকে সুচিন্তিত মতামত জানিয়েছেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাধারণ সম্পাদক নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মোহাম্মদ খান। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাইফুল হক মিঠু।
Advertisement
জাগো নিউজ: দ্রুত নগরায়ণ বাড়ার কারণ কী বলে আপনি মনে করেন?
ড. আদিল মোহাম্মদ খান: শিক্ষা, চিকিৎসাসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার কারণে শহরে নগরায়ণ বাড়ে। রুর্যাল এরিয়ায় বিভিন্ন ফ্যাসিলিটি দিয়ে মানুষকে শহরমুখী না করা, এ উদ্যোগটা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তুলনামূলকভাবে কম। সরকারও ভাবে কনসেন্ট্রেশন অব পপুলেশন থাকলে তার জন্য সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা সহজ হবে। একটি দেশের পলিসি ঠিক করে নগর কিংবা গ্রামীণ এলাকার বাসস্থান পরিকল্পনা কেমন হবে। নগরায়ণ জনসংখ্যার সঙ্গে সম্পৃক্ত। জনসংখ্যা বাড়লে নগরে মানুষের আধিক্যও বাড়ে। আমাদের এখানে মানুষ শহরমুখী হচ্ছে মূলত কর্মসংস্থানের জন্য। আর শিক্ষা, চিকিৎসার জন্য শহরমুখিতার প্রবণতাও আছে।
জাগো নিউজ: সরকার গ্রামকে শহরে পরিণত করার কথা বলছে। তাহলে বাংলাদেশ কি দ্রুত নগরায়িত দেশে পরিণত হবে? গ্রামে যদি নগরায়ণ হয় সেটা কীভাবে হওয়া উচিত?
Advertisement
ড. আদিল মোহাম্মদ খান: গ্রামে নাগরিক সুবিধা পৌঁছাতে সরকারের পরিকল্পনা রয়েছে। এ ভিশনটা যখন সরকার প্রকাশ করলো তখন একটা বিষয় প্রচার হলো যে, গ্রামগুলো শহর হবে। সরকার কিন্তু তারপর স্পষ্ট করে ব্যাখ্যা দিলো যে, গ্রামগুলো শহর হবে না। গ্রামে নাগরিক সুবিধা পৌঁছে দেওয়া হবে। ‘আমার গ্রাম, আমার শহর’ এটা সরকারের প্ল্যান। আমাদের গ্রামে যে পপুলেশন আছে, তা বিশ্বের অনেক দেশেই নেই। এ জনসংখ্যার জন্য সুযোগ-সুবিধার অভাব আছে। এ কারণেই মানুষ শহরের দিকে ধাবিত হচ্ছে। এমন বাস্তবতায় ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ এর প্রয়োজন আছে। গ্রামে নাগরিক যেসব সুবিধা পৌঁছানো দরকার সেগুলোর একটা রোডম্যাপ দরকার। গ্রামকে শহরে কনভার্ট করার সুযোগ নেই। গ্রাম থাকবে তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অবিরত ফসলি জমি নিয়ে। কিন্তু সেখানে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। একই সঙ্গে গ্রামে নাগরিক সুবিধা পৌঁছে দিতে হবে। শুধু নাগরিক সুবিধা দিলে হবে না, এসব সুবিধার গুণগত মান বাড়াতে হবে। গ্রামে শিল্পায়ন করলে কনসেনট্রেটেড জোনে করা উচিত। তার জন্য সমন্বিত পরিকল্পনা প্রয়োজন। জাগো নিউজ: কৃষিজমি দখল বা ব্যবহার করে শিল্পায়ন হচ্ছে। এর বিকল্প কী হতে পারে?
ড. আদিল মোহাম্মদ খান: শিল্পায়ন আমাদের দরকার আছে। যেকোনো দেশেই শিল্পায়ন হয় কোনো কনসেনট্রেটেড জোনে। আমাদের দেশে কৃষিজমির ওপর সরকারের কন্ট্রোল নেই। এ কারণে যে কেউ কৃষিজমিতে ইন্ডাস্ট্রি করতে পারে। এই শিল্পায়ন হচ্ছে বিচ্ছিন্নভাবে। কৃষিজমি সুরক্ষা আইন করছে সরকার। এটার খসড়া এরই মধ্যে তৈরি হয়েছে। পরিবেশ সুরক্ষা আইন আছে। তবে এসব ক্ষেত্রে তদারকির অভাব আছে। আমাদের জেলা প্রশাসন, পরিবেশ অধিদপ্তর তাদেরও সক্ষমতা আসলে নেই। কোনো ক্ষেত্রে তাদের পদক্ষেপ কম্প্রোমাইজিং, কোনো ক্ষেত্রে দুর্বল। প্রভাবশালীরা আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে কৃষিজমিকে কনভার্ট করছে। আইন তো আইনের জায়গায় থাকছে, কিন্তু সেটা বাস্তবায়ন প্রয়োজন। নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা ও প্রশাসনকে আইন প্রয়োগে কঠোর হতে হবে।
জাগো নিউজ: স্বাধীনতার পর মাঠ, উদ্যান হয়নি নগরীতে। নাগরিকের সুস্বাস্থ্য নগর পরিকল্পনায় গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে কি?
ড. আদিল মোহাম্মদ খান: স্বাধীনতার পর সে অর্থে আসলে বড় পার্ক, উদ্যান নির্মাণ করা হয়নি। ছোট ছোট কিছু পার্ক, উদ্যান হয়েছে। জনস্বাস্থ্য রক্ষায় পরিবেশের যে গুরুত্ব তা আসলে কাগজেই আছে। বড় আকারে মাঠ, পার্ক তৈরি করা বেসরকারি উদ্যোগে সম্ভব নয়। সরকারকেই এই উদ্যোগ নিতে হবে। এজন্য ভূমি অধিগ্রহণ ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রয়োজন।
Advertisement
জাগো নিউজ: নগরায়ণে প্রধান সমস্যা কী?
ড. আদিল মোহাম্মদ খান: আমাদের নগরগুলো অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠছে। কেন্দ্রীয় কিছু এলাকায় পরিকল্পনার ছোঁয়া লাগলেও, রাজধানীর এক্সটেন্ড (বর্ধিত) অংশে পরিকল্পনাহীনভাবে গড়ে উঠছে। এছাড়া সামাজিক দূরত্ব, স্বাস্থ্যগত দূরত্ব বা পরিবেশগত দূরত্ব আমরা আমলে নেই না। আমাদের ধারণা, উন্নয়ন মানে অবকাঠামো নির্মাণ বা শিল্পায়ন। এর বাইরে যে স্বাস্থ্য সুরক্ষা, মানবসম্পদ উন্নয়ন হতে পারে সে বিষয়টা এখনো আমাদের এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। স্বাস্থ্য সুরক্ষার কথা বললে এখানে হাসপাতাল তৈরি করাকে বোঝানো হয়। পার্ক, উদ্যানের মতো স্বাস্থ্য সুরক্ষার অবকাঠামো তৈরি করা সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সেজন্য দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য দরকার। নাগরিকের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে এলাকাভিত্তিক পার্ক, উদ্যান নির্মাণে সরকারকে প্রমোটিং ভূমিকা পালন করতে হবে। জমি অধিগ্রহণ ছাড়াও খাসজমি ব্যবহার ও ভূমির পুনরায় উন্নয়ন করে সরকার এ ধরনের নাগরিক সুবিধা মানুষকে দিতে পারে। বেসরকারিভাবে যে স্যাটেলাইট সিটি বা অন্যান্য শহর গড়ে উঠেছে সেখানেও যেন পার্ক, উদ্যানের মতো নাগরিক সুবিধা থাকে, সে ব্যাপারেও সরকারকে কঠোর হতে হবে।
জাগো নিউজ: রাজধানীর সবুজায়ন বাড়াতে কী কী করা যেতে পারে?
ড. আদিল মোহাম্মদ খান: সবুজায়ন বাড়াতে দুটি পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। একটি হচ্ছে বড় স্কেলে পার্ক বা উদ্যান নির্মাণ করা, আরেকটি এলাকাগুলোতে ছোট ছোট ব্লকের মাধ্যমে পার্ক নির্মাণ করা। আমাদের নগরীর দুর্ভাগ্য হচ্ছে আমরা বড় স্কেলে পার্ক তৈরি করতে পারিনি। ছোট ছোট প্লটের ৮০ থেকে ৯০ ভাগই কংক্রিটে আচ্ছাদিত করে ফেলেছি। কিন্তু প্রতিটি প্লটে ৪০ ভাগ সবুজ এলাকা রাখার কথা ছিল। আমাদের যে রেগুলেশন আছে সেটার সংস্কারের প্রয়োজন আছে। আমাদের ইমারত নির্মাণ বিধিমালার আমূল পরিবর্তন দরকার। এর সঙ্গে কমিউনিটিভিত্তিক সবুজ এলাকা তৈরি করতে ল্যান্ড অ্যাকুয়ার (অধিগ্রহণ) করাও দরকার। ল্যান্ড অ্যাকুয়ার ও খাসজমি ব্যবহার করে সবুজায়ন না করতে পারলে আমাদের শিশুদের মানসিক বিকাশ ব্যাহত হবে। বায়ু ও শব্দদূষণ কোনোভাবেই কন্ট্রোল করতে পারবো না। ব্যক্তি পর্যায়ে যারা ভবন নির্মাণ করছে তাদের সবুজায়নের জন্য নির্দিষ্ট জায়গা রাখতে বাধ্য করতে হবে। এটা করতে হলে ইমারত বিধিমালা সংশোধন করেই করতে হবে। সেইসঙ্গে সিটি লেভেলে উদ্যান, প্লে গ্রাউন্ড তৈরি করতে হবে।
জাগো নিউজ: আবাসন সংকট ও গণপরিবহনের নৈরাজ্য নিয়ে আপনার মতামত কী?
ড. আদিল মুহাম্মদ খান: নগর এলাকার ৭০ ভাগ মানুষই নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির। এদের জন্য ফর্মাল হাউজিংয়ের ব্যবস্থা রাষ্ট্র করে। কিন্তু বাংলাদেশে এ ধরনের সুযোগ না থাকায় নগর এলাকায় বস্তি তৈরি হয়। এর বাইরে মানুষ যেভাবে থাকে সেগুলোকেও কোয়ালিটি হাউজিং বলা যায় না। এর মূল কারণ হচ্ছে ল্যান্ডের ওপর সরকারের কন্ট্রোল নেই। ল্যান্ড ম্যানেজমেন্টে সরকার কিছু করতে পারছে না। পুরোটাই বেসরকারি খাত নিয়ন্ত্রণ করছে। ক্ষেত্রবিশেষে সরকার যা করছে নাগরিকের জন্য তা পর্যাপ্ত নয়। ল্যান্ডের ব্যবস্থা করে সরকার বেসরকারিখাতে হাউজিংকে দিতে পারে। তাতে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের আবাসন সংকটের একটা গতি হতে পারে। আবার ল্যান্ডের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ না থাকায় বাজারে এক ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। রিয়েল স্টেট শুধু হাইএন্ডে প্লটের ব্যবস্থা করতে পারছে। এজন্য সরকারের পলিসিগত ভূমিকা প্রয়োজন।
গণপরিবহনে নৈরাজ্য কমাতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। মেট্রোরেলের ফলে আরবান এলাকার ১৫ থেকে ২০ মানুষ ডেইলি ট্রান্সপোর্ট সুবিধা পাবে। তার মানে বাসরুট র্যাশনালাইজেশন বাস্তবায়ন করতে হবে। উন্নত বাস সার্ভিসের ব্যবস্থা ও পথচারীবান্ধব ফুটপাত নির্মাণ করতে হবে। মেট্রোরেলের পাশাপাশি মাল্টিমোড ট্রান্সপোর্টের ব্যবস্থা করতে হবে। সে ক্ষেত্রে ঢাকার আশপাশের নদী ও রেল ব্যবহার করতে হবে।
জাগো নিউজ: রাজউক, ওয়াসা ও অন্যান্য সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব দেখা যায়। এটা কেন?
ড. আদিল মুহাম্মদ খান: সমন্বয় করার জন্য কোনো অথরিটি গড়ে ওঠেনি। বিশ্বের উন্নত দেশে নাগরিক উন্নয়ন কেন্দ্রীয় সরকার বা নগর সরকারের মাধ্যমে হয়। আবার অনেক দেশেই সিটি করপোরেশনের মাধ্যমে হয়। আমাদের সিটি করপোরেশনগুলো আইনের প্রয়োগ করতে পারছে না। আবার তারা স্বাধীনভাবে কাজ করতে চায়। এর ফলে ওয়াসা, তিতাসসহ অন্যান্য সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের অভাব দেখা দিয়েছে। বর্তমানে সিটি করপোরেশন একটা উদ্যোগ নিয়েছে সংস্থাগুলোর সঙ্গে একীভূত হয়ে কাজ করতে। সিটি করপোরেশন অন্য সংস্থাগুলোর বার্ষিক পরিকল্পনা চেয়েছে। বাস্তবতা হচ্ছে এসব সংস্থার খুব আগ্রহ দেখা মিলছে না। এটা আমাদের কালচারে যেহেতু নেই, তাই হয়তো সংস্থাগুলো আগ্রহ দেখাচ্ছে না। তাই সিটি করপোরেশনকে কঠোর হতে হবে, আইনের প্রয়োগ বাড়াতে হবে। কোনো সংস্থা যদি সিটি করপোরেশনকে না জানিয়ে উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেয় তাহলে তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। এটা হলে অথরিটি বুঝতে পারবে যে, সিটি করপোরেশনকে বাইপাস করে কোনো উন্নয়ন পরিকল্পনা নেওয়া যাবে না। তাহলেই সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের সংস্কৃতি গড়ে উঠবে।
এসএম/ইএ/এসএইচএস/এমএস