ভ্রমণ

আজও লোকচক্ষুর আড়ালে যে পাহাড়!

ড. মোঃ জিয়াউল ইসলাম মজুমদার

Advertisement

ছাত্রজীবন থেকেই পাহাড়ে ঘুরতে ভালো লাগতো। এরপর চাকরিতে প্রবেশের পর বিভিন্ন ছুটিতে সুযোগ পেলেই পাহাড় ট্র্যাকিং করতে যেতাম। সবচেয়ে বেশি ঘুরেছি বান্দরবানে। দেশের সৌন্দর্য সবার কাছে তুলে ধরতে বরাবরই খুব ভালো লাগে।

বান্দরবানে বেশি ঘুরলেও খাগড়াছড়ি-রাঙ্গামাটিতেও ঘুরেছি অনেক। সেই ২০০৭ সালে রাঙ্গামাটির সুবলং ঘুরতে গিয়েছিলাম। মনে হয়েছে, পার্বত্য চট্টগ্রামের আসল সৌন্দর্য রাঙ্গামাটিতেই লুকায়িত। রাঙ্গামাটি আর কালো পাথরের সুউচ্চ পাহাড়, সুবিস্তৃত স্বচ্ছ লেক ও অসংখ্য ঝরনার মিলিত সৌন্দর্য বিশ্বের খুব কম স্থানেই দেখা যায়।

আমরা ভাগ্যবান যে, রাঙ্গামাটির মতো একটি প্রাকৃতিক ভূ-স্বর্গ পেয়েছি। বিশ্বে যে ক’টি স্বাদু পানির লেক আছে তার মধ্যে সৌন্দর্য ও আয়তনে আমাদের কাপ্তাই লেক অন্যতম। গত ২০২০ সালের নভেম্বরে চাকরির সুবাদে রাঙ্গামাটি শহর হতে লংগদু উপজেলায় আসি।

Advertisement

আসার পথে সুভলং ছোট-বড় ঝরনার পাশ দিয়ে স্পিড বোটে কাট্টলী বিল পাড়ি দিতেই চোখে পড়লো বিস্তৃত পাহাড় ও তার মাঝের সবুজাভ পানি। এই দৃশ্য দেখে বিমোহিত হয়ে পড়ি। বিস্তৃত কাট্টলী বিলে জেলেদের মাছ ধরার দৃশ্য আর দু’পাশের সবুজ পাহাড়সারি যে কারো মন কাড়বে।

কাট্টলী বিল পাড়ি দেওয়ার সময় দক্ষিণ-পূর্বদিকে ত্রিভূজাকৃতির সুউচ্চ একটি পাহাড় আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, এটা গুরুসতাং পাহাড়। এটি এ অঞ্চলের অন্যতম সুউচ্চ পাহাড়।

বরাবরের মতোই পুরো উপজেলা সম্পর্কে ধারণা নিতে পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিদর্শন করতে থাকি। দীর্ঘদিন ধরে পাহাড়ে ঘুরতে ঘুরতে পার্বত্য এলাকার উন্নয়নে নিজের মধ্যে বেশ আন্তরিকতা ও আগ্রহ অনুভব করি।

সে কারণেই পুরা উদ্যোমে সাইট দেখা, পাহাড়-লেকের সৌন্দর্য দেখা আর সড়ক নেটওয়ার্কের পরিকল্পনা করতে থাকি। লংগদুর ৭টি ইউনিয়নের মধ্যে সর্বশেষে গুলশাখালী ইউনিয়ন পরিদর্শনে যাই। প্রথম পরিদর্শনেই বুঝতে পারি, নানা কারণেই লংগদু উপজেলার সবচেয়ে সম্ভাবনাময় এলাকা হচ্ছে গুলশাখালী ইউনিয়ন।

Advertisement

আমার পর্যবেক্ষণ মতে, গুলশাখালীর সম্ভাবনাময়তার একটি বড় কারণ গুরুসতাং পাহাড় চূড়া। দেশি-বিদেশি পর্যটকদেরকে চুম্বকের মতো টেনে আনার সব সৌন্দর্যগুণই আছে এই পাহাড়ের। তবে আজও লোকচক্ষুর আড়ালেই রয়ে গেছে পাহাড়টি।

গুরুসতাং পাহাড়ের চূড়া জয় এতোটা কষ্টসাধ্য ও দুর্গম হবে সেটা প্রথমে বুঝতে পারিনি। অফিসের সহকর্মী ও ঠিকাদারদের সঙ্গে আলোচনার পর জানতে পারি, এটি লংগদু উপজেলার গুলশাখালী ইউনিয়নে বিজিবি ক্যাম্পের কাছে অবস্থিত। কেউ কেউ বলেছিলেন, দু-তিন ঘণ্টা হাঁটলেই এর চূড়ায় যাওয়া সম্ভব!

গুলশাখালীতে প্রথমদিন এসেই চৌমুহনী বাজার থেকে কার্যসহকারী সাদ্দাম ও মাসুমকে নিয়ে দুটি হোন্ডায় গুরুসতাং দর্শনে যাত্রা শুরু করি। উদ্দেশ্য ছিল যতদূর সম্ভব বিজিবি ক্যাম্প পর্যন্ত গিয়ে একটু ঘুরে আসা।

হোন্ডার ড্রাইভার বলেছিলেন, আধা ঘণ্টা হোন্ডায় গিয়ে আরো আধা ঘণ্টা হাঁটলেই গুরুসতাং বিজিবি ক্যাম্পের কাছে যাওয়া যাবে! সম্ভবত তখন মে মাস। গরম ও বৃষ্টির আনাগোনা ছিলো। সাহস করে কোনো প্রকার পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়াই বেলা ১২টার সময় রওনা দিলাম।

পথিমধ্যে রাঙ্গামাটি জেলা পরিষদ সদস্য আব্দুর রহিম সাহেবের আম বাগান পার হলঅম। এরপর সামনে এগুতেই পথের নির্জনতা ও মেঘের ডাক মনে ভয় ঢুকিয়ে দিলো। ফিরে এলাম।

পরের অভিজ্ঞতায় বুঝতে পারি, সেদিন এগিয়ে গেলে গুরুসতাং বিজিবি ক্যাম্প পর্যন্ত যাওয়া তো দূরের কথা, বৃষ্টির পর ওই রাস্তা ধরে ফিরে আসাটাই কষ্টসাধ্য হতো! আসলে ওই দিন পূর্বপ্রস্তুতি না নিয়ে গুরুসতাং বিজিবি ক্যাম্প পর্যন্ত যাওয়ার চিন্তা বোকামিই ছিলো।

আসল কথা হলো, বান্দরবানের কেওকাড়াডং আর তাজিনডংসহ গহীন বনে ঘুরে গুরুসতাংকে তুচ্ছ ভেবে বেশি সাহসীই হয়ে গিয়েছিলাম! যাই হোক, মনে মনে গুরুসতাং জয়ের পন্থা খুঁজতে থাকি। সঙ্গে উদ্যোগী তেমন কাউকেও পাচ্ছিলাম না।

একদিন অফিসে উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম ঝান্টু ভাইর সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করি। তিনি বললেন, গুরুসতাং বিজিবি ক্যাম্পের নিকট পাংখু পাড়ার কথা। সেখানকার বাসিন্দারা পানির জন্য বেশ কষ্ট করছে। তারা পানি সরবরাহের প্রকল্পের জন্য দীর্ঘদিন দাবি জানিয়ে আসছে।

পাংখু হেডম্যান ওনার পরিচিত ও ঘনিষ্ঠ। ঝান্টু ভাই সেখানে আমাকে নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নিলেন। আমি উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ মাইনুল আবেদীন ও উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল বারেক সরকার মহোদয়ের সঙ্গে আলোচনা করে পাংখু পাড়ায় পানি সরবরাহের সম্ভাব্যতা সরেজমিন দেখতে গুরুসতাং পাংখু পাড়ায় যাওয়ার পরিকল্পনা করি।

সম্ভবত সেদিনের তারিখ ছিল ১২ জুন ২০২১। আমি, ঝান্টু ভাই, উপজেলা সহকারী প্রকৌশলী শহীদুল ইসলাম ও জাইকার ফ্যাসিলেটেটর টিংকু চাকমা গুরুসতাং পাংখু পাড়া উদ্দেশ্যে সকাল ৯টায় রওনা করি। আনুমানিক দুপুর বারোটায় পাংখু পাড়ায় পৌঁছায়।

সেদিন গুরুসতাং চূড়ায় না যেতে পারলেও পাংখুপাড়া পর্যন্ত এসে গুরুসতাং পাহাড়ের যে সৌন্দর্য উপভোগ করি। দ্বিতীয়বার গুলশাখালীর কতিপয় উৎসাহী তরুণ ও জনপ্রতিনিধিদের আগ্রহে পুনরায় গুরুসতাং অভিযানে যাই ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২১।

এবারও পাংখু পাড়া হয়ে বিজিবি ক্যাম্প পর্যন্ত এসে অভিযান শেষ হয়। চূড়া জয়ের আক্ষেপ থেকেই গেল! দেশের অন্যতম সেরা সম্ভাবনাময় পর্যটন স্থান হতে পারে এখন পর্যন্ত লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকা এই গুরুসতাং হিল রেঞ্জ।

দেশের ১১টি হিলরেঞ্জের মধ্যে বরকল হিলরেঞ্জের অন্তর্গত জুরাছড়ি। বরকল উপজেলা হেড কোয়ার্টার হয়ে লংগদু উপজেলার গুরুসতাং ও সাজেক পার হয়ে ভারতের ত্রিপুরা ও মিজোরাম সীমান্তের সুউচ্চ বেটলিন পাহাড় পর্যন্ত এই হিলরেঞ্জের অবস্থান।

এই রেঞ্জে সাজেকের কংলাক পাহাড় চূড়া প্রায় ২৪০০ ফুট উঁচু। স্থানীয় বিজিবি জোনের তথ্য মতে, তার পরই গুরুসতাং পাহাড় চূড়া, যার উচ্চতা প্রায় ২০০০ ফুট। সাজেকের কংলাক চূড়া জয় করা গেলেও গুরুসতাং চূড়া এখনো অজেয়।

অনেক চড়াই উৎরাই পার হয়ে এর চূড়ায় উঠতে হয়। তাই তেমন কেউই এর চূড়ায় রিস্ক নিয়ে উঠেনি। এখন পর্যন্ত স্থানীয় কিছু পাহাড়ি না কি গুরুসতাংয়ের চূড়ায় উঠেছেন। এছাড়া কোনো এক সময় রাজনগর বিজিবি জোনের এক মেজর মহোদয় উঠার চেষ্টা করেছিলেন বলেও শোনা যায়।

সাজেকের সঙ্গে এই গুরুসতাংয়ের পার্থক্য হচ্ছে- সাজেকে শুধু পাহাড় আর তার গা-ঘেঁষে উড়ে বেড়ানো মেঘ দেখা যায়। তবে এর উপরিভাগ মাত্র দেড়-দুই কিলোমিটার বিস্তৃত ও সরু চূড়া। অন্যদিকে গুলশাখালী ইউনিয়ন বিজিবি জোন বা বাজার থেকে মাত্র ১২ কিলোমিটার দূরত্বেই গুরুসতাং পাহাড়ের অবস্থান।

এর উপরিভাগ প্রায় ৫-৬ কিলোমিটার। অনেক প্রশস্ততা নিয়ে বিস্তৃত। নিচের বিস্তৃত রাঙ্গামাটির লেক ভিউ, কাট্টলী বিল, পাহাড়ের কোলের মেঘ, ওপারের কর্ণফুলী নদীর উৎস ভারতের মিজোরামের সুউচ্চ লুসাই পাহাড় ভিউয়ের সৌন্দর্য অপরূপ।

আরও আছে কর্ণফুলী রিভার ভিউ, পাদদেশের ছড়ায় অনেক সুন্দর ট্রেইল, ঝরনা, পাদদেশের পাংখুপাড়া, চাকমা পাড়া, সর্বোপরি গুলশাখালী হতে পাহাড় চূড়ার এই ১২ কিলোমিটার একটি ভয়ংকর সুন্দর ট্র্যাকিং রুট, যা পর্যটকসহ হিল ট্র্যাকারদের সহজেই আকৃষ্ট করবে।

এর চারপাশে ছড়িয়ে থাকা নানা প্রাকৃতিক উপাদান গুরুসতাং হিল রেঞ্জের সৌন্দর্য দ্বিগুণ বাড়িয়েছে। ভিন্নমাত্রায় বৈচিত্র্যময় ও দেশের অন্যতম সুন্দর একটি পর্যটন স্পটের কাতারে দাঁড় করিয়েছে। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এসব কিছুই এখনো লোকচক্ষুর অন্তরালে!

স্থানীয় কিছু অধিবাসী ও বিজিবি ক্যাম্পের লোকজন ছাড়া তেমন কেউই এখানে যান না। গুলশাখালী রাজনগর বাজার হতে হোন্ডায় শুকনো রাস্তায় চার-পাঁচ কিলোমিটার যাওয়া যায়, বাকী ছয়-সাত কিলোমিটার পথ যেতে হয় হেঁটে। এই ১২ কিলোমিটার রাস্তায় কোনো ব্রিজ-কালভার্ট প্রয়োজন নেই।

বর্তমানে ছয় চাকার ট্রলি শুষ্ক মৌসুমে প্রায় ছয়-সাত কিলোমিটার পর্যন্ত চলে যেতে পারে। বাকী পথটুকুতেও সুন্দর হাঁটার পথ বিদ্যমান। শুধু পেলোডার-এক্সকাভেটর দিয়ে কিছু প্রশস্ত করে ¯েøাপ মিলিয়ে আপাতত এইচবিবি করলেই পর্যটকদের জন্য এটি ব্যবহার উপযোগী হয়ে উঠবে।

পাশাপাশি স্থানীয় পাংখু পাড়া ও চাকমা পাড়ার বাসিন্দাদের জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থা হয়ে উঠবে সহজ ও সস্তির। ফলে তাদের উৎপাদিত ফসল বিক্রি যেমন সহজ হবে, তেমনি প্রয়োজনীয় জীবনোপকরণ সংগ্রহ করাও সহজ হবে। তাতে আর্থিক, সামাজিক জীবন-মানেরও অভাবনীয় উন্নতি হবে।

গুলশাখালী থেকে গুরুসতাং পর্যন্ত সড়কটি এলজিইডির ইনভেন্টরিতে একটি গ্রামীণ সড়ক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত। তবে গুরুসতাং পাহাড়ের অপর পাশের পাদদেশে সাজেকের রুইলুই হতে বরকলের ঠেগামুখ স্থলবন্দর পর্যন্ত ৫০-৬০ কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণাধীন আছে।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অধীনে নির্মাণাধীন বর্ডার রোডের সঙ্গে এই ১২ কিলোমিটার সড়ককে টেনে নিয়ে সংযোগ দিলেই (সহজেই সংযোগ সম্ভব) এই অঞ্চলের সড়ক যোগাযোগে আসবে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। ফলে গুরুত্ব ও ব্যবহার বৃদ্ধির পাশাপাশি সড়কটি আরও উন্নত রোড শ্রেণিতে চলে আসবে।

এতে আগামীতে লংগদু হয়ে ঠেগামুখ স্থলবন্দর স্বল্প দূরত্বে চলে আসবে। একই পথে খাগড়াছড়ি হয়ে ঢাকা বা চট্টগ্রাম বন্দর অথবা আগামীতে লংগদু হয়ে নানিয়ারচর দিয়ে রাঙ্গামাটি সদর, চট্টগ্রাম বন্দর পর্যন্ত সঙ্গে সংযুক্ত হবে।

এখন গুলশাখালী থেকে গুরুসতাং পর্যন্ত এই ১২ কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণই প্রথম কথা। এতে এখানকার পাহাড়িদের জীবনমানের অনেক উন্নতি সাধিত হবে। এছাড়াও স্থানীয় অর্থনীতির চাকাও সচল হবে।

পাশাপাশি দেশি-বিদেশি পর্যটকদের সামনে উন্মুক্ত হবে গুরুসতাং পাহাড়ের অদেখা সৌন্দর্যভাণ্ডার। এরই মধ্যে এলজিইডির দুটি প্রকল্পে রাস্তাটি এইচবিবি করার প্রস্তাব করেছি।

লেখক: উপজেলা প্রকৌশলী, এলজিইডি, লংগদু, রাঙ্গামাটি।

জেএমএস/জিকেএস