জামরুলকে নিয়ে জালাল মিয়ার আহ্লাদের শেষ নাই। আট মাসের জামরুল যখন কেবল আঃ আঃ করতে শিখেছে, তখনই তার মধ্যে প্রতিভার সন্ধান পেয়ে গেল জালাল। স্ত্রীকে ডেকে বলল, : জামরুলের মা! তোমার ছেলের কারবার দেইখা যাও!জরিতন রান্না করছিল। রান্নাঘর থেকে উঠানে এসে স্বামীর কাছে জানতে চাইল,: জামরুল কি আবার আপনের কাপড় ভিজাইয়া দিছে?: আরে না, এইসব কিছু না।: তাইলে?: বড়ই আচানক এক কারবার ঘটাইছে!: কী কারবার?: সে আকাশ চিইনা ফেলছে। এই দেখ, দুই হাত উপরের দিকে তুইলা সে কেমন আঃ আঃ করতেছে।: আপনের যত বুজরকি আলাপ। আঃ আঃ করলেই কেউ আকাশ চিইনা ফেলে ?: অবশ্যই ফেলে। যে বিড়াল ইঁদুর ধরে, অতি বাল্যকালেই তার ঘাড়ের লোম ফতফত করে। বিশ্বাস না হইলে আইনস্টাইন, গ্যালিলিও, নিউটন এদের জীবনী পইড়া দেখ; কী লেখা আছে সেইখানে। বুঝলা জামরুলের মা, লক্ষণ দেইখা মনে হইতেছে তোমার জামরুলও একদিন মস্তবড় সাইনটিস্ট হবে।কিনতু বড় হবার পর দেখা গেল, অংকে জামরুল একেবারেই কাঁচা। জামরুলের কাঁচা মাথা 'পাকা' করার জন্য জালাল একজন অংকের শিক্ষককে বাড়িতে লজিং রাখল। লজিং মাস্টার দিবা-রাত্রি সার্ভিস দিয়েও জামরুল সম্পর্কে হতাশা ব্যক্ত করার পর জালাল ভাবল, বিজ্ঞানী হওয়াটাই বাল্যকালে আকাশ চেনার একমাত্র পরিণতি নয়। কবি-সাহিত্যিকদের সঙ্গেও আকাশের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। অংকে দুর্বল হওয়ায় ছেলে সাইনটিস্ট হতে না পারলেও একজন বড় কবি কিংবা সাহিত্যিক যে হবে না, তা কে বলতে পারে?
Advertisement
এ প্রেক্ষিতে জালাল তার পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনল। জামরুলকে বিজ্ঞানবিষয়ক বইপত্র কিনে দেয়ার বদলে সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ক বইপত্র কিনে দিতে শুরু করল। কিছুদিন পর যখন সে শুনল, জামরুল তার ক্লাসের এক মেয়েকে প্রেম নিবেদন করে পত্র প্রদান করেছে, তখন সে বিন্দুমাত্র রাগান্বিত হলো না; বরং এই ভেবে খুশি হলো, ছেলে এবার সঠিক পথেই অগ্রসর হচ্ছে। কিন্তু পথের ভাবনা সবার একরকম হয় না। জালাল যে পথকে সঠিক মনে করল, জরিতন সেটাকে বেঠিক মনে করে স্বামীর উদ্দেশে বলল,: আপনে কি চক্ষে ঠুলি পড়ছেন? কানে তুলা দিছেন?: এই কথা কীজন্য বলতেছ!: বলতেছি খুশিতে ডগমগ হইয়া।: অত্যধিক খুশি হইলে তো বিপদ। তাল সামলাইতে না পারলে নায়িকাদের মতন নাচন শুরু কইরা দিবা। তখন বাধ্য হইয়া আমার নায়ক হওন লাগবে। : ঢঙের কথা রাখেন। : আইচ্ছা ঠিক আছে; বলো, কী জন্য তুমি এত খুশি হইছ?: চাইরদিক থেইকা একটার পর একটা সুখবর আসতেছে তো, তাই...: তুমি কি আমরার জামরুলের কথা বলতেছ?: আর কার কথা বলব? আমার কি আরও পাঁচ-দশটা সন্তান-সন্ততি আছে?: জামরুলের বিষয়ে চিন্তিত হওয়ার প্রয়োজন নাই। বুঝলা জামরুলের মা, মানুষ কচু গাছ কাটতে কাটতে যেমন একদিন মস্তবড় ডাকাত হইয়া যায়; তেমনি তোমার জামরুল টুকটাক প্রেমপত্র লিখতে লিখতে একদিন বিরাট বড় সাহিত্যিকে পরিণত হইব। আমাদের জামরুল যে একদিন বিখ্যাত লেখক হইব; তার প্রমাণ হচ্ছে এই বয়সেই প্রেমপত্র লেখার উসিলায় সাহিত্য রচনায় মনোনিবেশ করা। এইটাকেই বলে সিমটম। এই সিমটম বজায় থাকলে সাহিত্য রচনার জন্য সে একদিন নোবেলও জয় কইরা ফেলতে পারে।
: জামরুলের বাপ, সীমার মধ্যে থাকেন। সীমাহীন আহ্লাদ দেখানো ভালো না। আমাদের ক্রিকেট টিমরে লইয়াও মাঝেমধ্যেই এই ধরনের সীমাহীন আহ্লাদ দেখানো হয়। এর ফল দেখা যাইতেছে এইবার দুবাই খেলতে যাওয়ার পর। কোনো খেলায় একটু ভালো করলেই বাড়ি, গাড়ি, জমি দেওয়ার সিরিয়াল লাইগা যায়। ধুরা ধুরা পোলাপানের মনে বাড়ি-গাড়ির নেশা ঢুকাইয়া দিলে তাদের মন চইলা যায় বাড়ি সাজানো আর গাড়ি চালানোর দিকে; মন আর খেলার মাঠে থাকে না। জামরুলরেও একই দশায় পাইছে। তার মন আর পাঠ্যপুস্তকে নাই। তার মন পইড়া থাকে পুকুরঘাটে আর বাঁশঝাড়ের চিপার মধ্যে।: আজাইরা প্যাচাল বন্ধ করো। ধমক খেয়ে জরিতন চুপ হলেও স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষার রেজাল্ট বের হওয়ার পর তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল। স্বামীর উদ্দেশে বলল, : এইবার কেমন হইল? ছেলে তো আপনের ছয় সাবজেক্টে ডাব্বা মারছে!: তাতে হইছেটা কী?: এখন হয় নাই, তবে পরে হইব। আপনের এই ছেলে জীবনেও ম্যাট্রিক পাস করতে পারবে না।জরিতনের কথা শুনে জালালকে মোটেই চিন্তিত মনে হলো না; বরং খুশিমাখা গলায় সে বলে উঠল, : জামরুলের ম্যাট্রিক পাসের চিন্তায় তুমি কীজন্য বেহুশ হইতেছ? রবীন্দ্র-নজরুল যে ম্যাট্রিক পাস করে নাই, সেই চিন্তায় কে কবে বেহুশ হইছিল, কও আমারে? বুঝলা জামরুলের মা, তোমার জামরুল যদি ম্যাট্রিক পাস করতে না পারে, তাহলে বুঝবা, 'সিমটম' ঠিক আছে; রবীন্দ্র-নজরুলের পথ অনুসরণ কইরা সে সঠিক পথেই অগ্রসর হইতেছে...
লেখক : সাংবাদিক, রম্যলেখক। mokamia@hotmail.com
Advertisement
এইচআর/জিকেএস