মতামত

কোন দিকে যাচ্ছে বাংলাদেশ?

বাংলাদেশ কি মৌলবাদের দিকে ঝুঁকছে? গত কয়েক দিনে এ প্রশ্ন অনেকেই করেছেন। পত্রিকার কলাম, টেলিভিশনের টক শো, সামাজিক মাধ্যমে এমন আলোচনার ঝড় এখন প্রতিদিনের। কুমিল্লার সাম্প্রদায়িক ঘটনায় প্রগতিশীল সমাজ যখন চিন্তায় ভ্রুকুঞ্চন করছেন তখন তা রীতিমত দুশ্চিন্তায় পর্যবেসিত হয় চাঁদপুরসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পরা ধর্মীয় উগ্রবাদের ঘটনায়। খোদ কুমিল্লার প্রবীণ, বিশিষ্টজনেরাই বলছেন, ৪৭ এর দেশ ভাগের পর যখন ভারত – পাকিস্তানের নানা প্রান্তে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংগঠিত হয়েছে তখনও কুমিল্লা ছিল শান্ত। একটু পেছন দিক থেকেই শুরু করা যাক।

Advertisement

দেশভাগের পরের কথা। এরপর বুড়িগঙ্গার জল অনেকদূর গড়িয়েছে। অল্প দিনেই স্বরূপে আবির্ভূত হয় রাওয়ালপিন্ডি ভিত্তিক পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী। এদের দুঃশাসনে পূর্ব পাকিস্তানের বাংলাভাষীদের যখন ত্রাহি অবস্থা তখনই প্রতিবাদে ফেটে পড়েন প্রগতিশীল সমাজ। এদের মধ্যে সুশীল সমাজ থেকে ছাত্র, রাজনীতিবিদ –সবাই ছিলেন। দ্রুতই বোঝা গেল ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে অনেকগুলো হাতিয়ারের মধ্যে শাসকগোষ্ঠীর একটি পছন্দের হাতিয়ার ধর্মীয় কূপমন্ডুকতা। ভাষা, দৈনন্দিন জীবনাচার, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য –সবক্ষেত্রেই ধর্মের বেড়াজাল টেনে দেবার চেষ্টা চালায় শাসকগোষ্ঠী ও তার দোসরেরা।

এক পর্যায়ে ৫২ সালে মাতৃভাষার জন্য প্রাণ দেবার ঘটনাও ঘটে। আর ৭১ সালে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের আত্মপ্রকাশ ঘটে যার মূলনীতির একটি হল ধর্মনিরপেক্ষতা। অর্থাৎ বলা চলে ব্রিটিশ হাতে পরাধীন থাকার সময় থেকে শুরু করে ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হওয়া রাষ্ট্রের দুঃস্বপ্ন থেকে বেরিয়ে এসে একটি সম্পূর্ণ আধুনিক, মানবিক জনপদের ভাবনাকে জন্ম দেয়া হল। যেই জনপদের ভাবনার একেবারে গোড়ার সূত্রগুলোর একটিই হল অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গঠন। যে বাংলাদেশে আইন কোন নির্দিষ্ট ধর্মের উপর নির্ভরশীল থাকবে না। যদিও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে ধর্মীয় স্বাধীনতাকে গুরুত্ব দেওয়া হবে। ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার – এই হবে দেশের মূলমন্ত্র। সংবিধানও লেখা হল সেই মতে। যদিও যে ভাবনাকে নিয়ে একটি রাষ্ট্র কাঠামোর জন্ম তা ভেঙে চুরমার না হলেও আঘাত সইতে হয়েছে বারবার।

৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু মেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে শুরু হয় এক নতুন অপশাসনের। এবার আর বিদেশি কেউ নন, ভিলেনের ভূমিকায় নিজ দেশের ভাই-বোনেরই মেধার অপতৎরতা দেখাতে শুরু করলেন। আবার বাংলা শব্দভাণ্ডার নিয়ে গন্ডগোল, পরিধানের কাপড় কি হবে, রবি ঠাকুরের গান-কবিতা কতটা দেখানো যাবে, শোনানো যাবে তা নিয়ে নানা আওয়াজ ইত্যাদি।

Advertisement

দেশের ক্ষমতায় আসা দ্বিতীয় সামরিক শাসক ধর্মকে রীতিমত রাষ্ট্র ধর্মে পরিণত করলেন। অর্থাৎ যে চিন্তা, চেতনার ওপর তাঁর নিজের দেশটি দাঁড়িয়ে, রাষ্ট্রটির জন্ম –সব কিছুকেই বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কাজটি করলেন তিনি কেবল ক্ষমতায় টিকে থাকা আর দেশের বহিঃশত্রুদের খুশি রাখার জন্য। কিন্তু ফলাফল খুব পক্ষে যায়নি তার। নয় বছরের মধ্যে স্বৈরশাসক আর চরিত্রহীনের তকমা নিয়ে ক্ষমতার মসনদ ছাড়তে হয় তাকে।

এর পরের সময়গুলোও ছিল সুযোগসন্ধানীদের হুংকার আর আলোর দিশারীদের পাল্টা জবাবে প্রগতির ঝান্ডা উড়াবার ধারাবাহিক পর্ব। কিন্তু ‘আমরা সবাই তালেবান, বাংলা হবে আফগান’ স্লোগানে যেমন বাংলাদেশের জনগণ তালেবান হয়ে যাননি তেমনি সিরিজ বোমা হামলা, হলি আর্টিজানের ঘটনা কিংবা যত্রতত্র বোমা বানাতে গিয়ে নিজেরাই মৃত্যুবরণের উদাহরণগুলোর কোনোটিই বাংলাদেশকে ‘মৌলবাদী’ তকমা দিতে পারেনি। কেন পারেনি?

এই ভূখণ্ডে বিশেষ করে ইসলাম ধর্মের প্রসারে ওলী আউলিয়াদের এবটি বড় ভূমিকা ইতিহাস স্বীকৃত। গায়ের জোরে তাঁরা ধর্ম চাপিয়ে দেননি। ইসলামের প্রসারে দেশে অন্যান্য ধর্মের চর্চায় বাধা বা ছেদ পড়েছে তেমনটিও নয়। বরং সুখে-দুঃখে ভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষেরা একসাথে যার যার স্বাধীনতা নিয়ে বসবাস করে গেছেন এই বাংলার মাটিতে। আর এখানেই আশপাশের নানা দেশ থকে বাংলাদেশের মানুষের মনস্তত্বের পার্থক্য। এদেশের মানুষ বিকৃত ওয়াজ শোনেন, উগ্রবাদী আদর্শের কথা শোনেন আবার তার পার্থক্যও নির্ণয় করতে পারেন। আর এখানেই মুক্তচিন্তার বিকাশে অজান্তেই গড়ে ওঠা প্রগতিশীল চেতনাকে নিরন্তর শান দিয়ে যান বাংলাদেশের মানুষেরা।

সবশেষে একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত খবরের অংশ বিশেষের উদ্ধৃতি দেই - ‘কুমিল্লার হিংসাত্মক ঘটনার পরও শান্ত-স্থির হাটহাজারী প্রাঙ্গণ। শুক্রবার হাটহাজারী বাজারের সীতাকালী মন্দিরে দুপুর ১২টা ২৫ মিনিটে প্রবেশ করেন মন্দিরের পুরোহিত ষাটোর্ধ্ব ভানু প্রসাদ ভট্টাচার্য। ব্যস্ত কিনা জানতে চাইলে পুরোহিত জানালেন, ‘মন্দিরে পূজা দিতে হবে; তাই প্রস্তুতিতে ব্যস্ত’। এর মধ্যে মিনিট পাঁচেক পরে পুরোহিত মন্দিরে পূজা দিতে শুরু করলেন। ঠিক একই সময়ে মন্দিরের সঙ্গে লাগোয়া হাটহাজারী মাদ্রাসার বড় মসজিদের মুয়াজ্জিন মাওলানা কারি রবিউল জুমার নামাজের আজানের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।

Advertisement

প্রায় শত বছরের পুরোনো এ মন্দিরে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন দীর্ঘ সময় ধরে পূজা-অর্চনা করে এলেও এ নিয়ে কারও মধ্যে কোনো বৈরি অবস্থা তৈরি হয়নি। দেয়ালের একদিকে পুরোহিত, আর অন্যদিকে মুয়াজ্জিন একই সময় ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের আরাধনার কাজ সম্পন্ন করলেও কেউ কারও জন্য অন্তরায় হননি।

কথা হয় সীতাকালী মন্দির পরিচালনা কমিটির যুগ্ম সম্পাদক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগের সভাপতি ড. শিপক কৃষ্ণ দেবনাথের সঙ্গে। তিনি বলেন, বহির্বিশ্বে এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর অপ্রীতিকর ও অনাকাঙ্ক্ষিত হামলার ঘটনা ঘটলেও আমাদের হাটহাজারী উপজেলার চিত্র বরাবরই ব্যতিক্রম। তিনি বলেন, শুনেছি, হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার সময়ও এখানে একে-অপরের ওপর হামলা তো দূরে থাক, উলটো মাদ্রাসার ছাত্ররাই পাহারা দিয়ে মন্দিরকে রক্ষা করেছেন। শত বছর ধরে হিন্দু-মুসলিম যার যার অবস্থানে থেকে শান্তিপূর্ণভাবে ধর্মীয় কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছেন। তবে বিগত সময়ে কখনো কখনো তুচ্ছ ঘটনার রেশ ধরে অপ্রীতিকর ঘটনার অবতারণা হলেও মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ ও উপজেলা প্রশাসনের হস্তক্ষেপে আজ অবদি অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো ঘটনা ঘটেনি।

এদিকে, হাটহাজারী মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিগত ১১৯ বছরের ইতিহাসে হিন্দু সম্প্রদায় ও মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার ইতিহাস নেই। এমন দাবি করে হাটহাজারী মাদ্রাসার সিনিয়র মুহাদ্দিস মুফতি জসিম উদ্দিন জানান, শত বছর আগে প্রতিষ্ঠিত এ মাদ্রাসার সীমানা দেয়ালের সঙ্গে গড়ে উঠেছে হিন্দুদের কালীমন্দির। মন্দিরটি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই দুই ধর্মের অনুসারীরা সহাবস্থানে থেকে যার যার মতো করে ধর্মীর আচার-অনুষ্ঠান পালন করছেন।’

বাংলাদেশে মৌলবাদের চর্চা নতুন নয়। কিন্তু গত কয়েকশ‘ বছরের ইতিহাস এবং সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় এ চর্চা হয়তো বা আরও বহুকাল অবধি থাকবে কিন্তু প্রতিষ্ঠা পাবে না, পাওয়ার মত কোনো যুক্তিগ্রাহ্য কারণও নেই।

লেখক, সাংবাদিক, বিশ্লেষক।

এইচআর/জিকেএস