থেমে থেমে সুযোগ বুঝে ব্লগার, মুক্তমনা লেখক ও বিশিষ্ট নাগরিকদের ওপর হামলা ও হত্যার ঘটনা ঘটলেও থেমে ছিল না হত্যার হুমকি। বছরজুড়েই প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও শিক্ষক, লেখক, আইনজীবী, বিচারপতি, রাজনীতিবিদ, পেশাজীবী ও কবি-সাহিত্যিকদের মতো শতাধিক বিশিষ্ট নাগরিককে হত্যার হুমকি দেয়া হয় । ইসলামের বিরুদ্ধাচারণ ও অন্ধ হয়ে সরকারের লেজুড়বৃত্তির অভিযোগ তুলে হুমকি দেয় হুমকিদাতারা। কখনো ফেসবুকে, কখনো ই-মেইলে আবার কখনো বা চিঠিতে। হত্যার হুমকির কারণে জিডিও করা হয়েছে অনেক। তবুও থেমে ছিল না হুমকিদাতারা। এর কয়েকটি ঘটনায় মাত্র হুমকিদাতাকে সনাক্ত করা সম্ভব হলেও অধিকাংশরাই রয়ে গেছেন আড়ালে। ঘটনার চেয়ে হুমকি দেয়ার ঘটনায় গ্রেফতারের সংখ্যা কমই। তবে সম্প্রতি কয়েকজনকে গ্রেফতার করেছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, গত ৩০ নভেম্বর পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, রাজশাহীর আওয়ামী লীগ নেতা এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান, কথাশিল্পী হাসান আজিজুল হক ও রাজশাহীর দৈনিক সানশাইনের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ইউনুস আলীসহ বিশিষ্ট ৮ ব্যক্তিকে হত্যার হুমকি দেয়া হয়। আনসার আল ইসলাম (আল-কায়দা ভারতীয় উপমহাদেশ) নামের সংগঠনটির প্যাডে এ হত্যার হুমকি দেয়া হয়। সানশাইন পত্রিকার কার্যালয়ে পৌঁছে এমনি হুমকির চিঠি। চিঠিতে রাজশাহী রেঞ্জের ডিআইজি ইকবাল বাহার, রাজশাহী শিক্ষাবোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আবুল হায়াত ও রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকারকে হত্যার হুমকি দেয়া হয়। চিঠিতে লেখা হয়, বাংলাদেশ শাখার উপশাখা রাজশাহী অঞ্চলে আমাদের কার্যক্রম করেছে আনসার আল ইসলাম। এরই ধারাবাহিকতায় রাজশাহী অঞ্চলে আল্লাহ, রাসূল ও মুসলমানের নিকৃষ্টতম দুশমনদের একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা তৈরি করেছি। আল্লাহ ও রাসূলের দ্বীন প্রতিষ্ঠায় এদের প্রত্যেককে হত্যা করা হবে। গত ৮ এপ্রিল আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মণ্ডলীর সদস্য ও দফতরবিহীন মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছে। হত্যার হুমকির পরিপ্রেক্ষিতে রাজধানীর হাজারীবাগ থানায় একটি জিডি (সাধারণ ডায়েরি) দায়ের করেছেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। জিডি নম্বর ২৯৯। এরপর ১২ এপ্রিল মোবাইল ফোনে মেসেজ পাঠিয়ে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এবং তার পরিবারের সদস্যদের হত্যার হুমকি দেয়া হয়। পরে তিনি রাজধানীর রমনা থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন (জিডি নম্বর ৮১৭)। গত ১৪ এপ্রিল আইনমন্ত্রী আনিসুল হককেও হত্যার হুমকি দেয়া হয়। ছাত্রশিবিরের প্রবাসী এক নেতা এ হুমকি দিয়েছেন বলে জানায় পুলিশ। ২১ মে ‘ইসলাম বিরোধী’ আখ্যা দিয়ে বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং রাজনীতিবিদ এইচটি ইমামসহ ১০ জনকে হত্যার হুমকি দিয়ে চিঠি দেয়া হয়। চিঠির নিচে প্রেরকের নাম দেয়া আছে ‘আল-কায়েদা আনসারউল্লাহ বাংলা ১৩’। চিঠিতে প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচটি ইমাম, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুহাম্মদ জাফর ইকবাল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, সাংবাদিকতার অধ্যাপক কাবেরী গায়েন, জগন্নাথ হলের প্রভোস্ট অসীম সরকার, টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম, সাংসদ ইকবালুর রহিম ও গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকারের নাম উল্লেখ করা হয়। গত ২ জুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী, অভিনেত্রী শমী কায়সারসহ ৭ জনকে হত্যার হুমকি দিয়ে চিঠি পাঠায় আল-কায়েদা, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম-১৩। ১৬ জুন ও তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুসহ আবারও ঢাবি উপাচার্যসহ ২৫ বিশিষ্ট নাগরিককে হত্যার হুমকি দেয়া হয়। চিঠিটি আনসারুল্লাহ বাংলা টিম-১৩-এর প্যাডে লেখা। ঢাবি উপাচার্যের চিঠিটি নিজ কার্যালয়ে পৌঁছানোর পরেই শাহবাগ থানায় একটি জিডি হয়। চিঠিতে তথ্যমন্ত্রী ও ঢাবি উপাচার্য ছাড়াও শিক্ষক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মুহম্মদ জাফর ইকবাল, বৈশাখী টেলিভিশনের সিইও মনজুরুল আহসান বুলবুল, দৈনিক ইত্তেফাকের নির্বাহী সম্পাদক শাহীন রেজা নূর, সাংবাদিক আবেদ খান, মুন্নী সাহা, অঞ্জন রায়, দৈনিক ভোরের কাগজের সম্পাদক শ্যামল দত্ত, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক, নাট্যব্যক্তিত্ব নাসিরুদ্দীন ইউসুফ, রামেন্দু মজুমদার, সৈয়দ হাসান ইমাম, মঞ্চের কর্মী মাহমুদুল হক মুন্সী, গণজাগরণ মঞ্চের আরেক অংশের প্রতিনিধি কামাল পাশা চৌধুরী, টেলিভিশন উপস্থাপক নবনীতা চৌধুরী, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম, ছাত্র মৈত্রীর সাবেক সভাপতি বাপ্পাদিত্য বসু, আকলিমা সুলতানা, এস এম শাহীন, ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষক মোহাম্মদ এ আরাফাত ও সঙ্গীতা ইমামকে হত্যার হুমকি দেয়া হয়। গত ৩ আগস্ট ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের উত্তরের মেয়র আনিসুল হককে হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছে। হুমকির অভিযোগে এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে র্যাব। এছাড়াও হুমকিতে বাদ যায়নি প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ও ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়। হুমকির ঘটনায় জাসাসের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি মোহাম্মদ উল্লাহ মামুনসহ বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে পল্টন থানায় মামলা করে ডিবি পরিদর্শক ফজলুর রহমান।গত ৮ আগস্ট গ্রামীণফোন অপারেটরের ০১৭৩৯-৩০১১২৯ নম্বর থেকে হত্যার মুক্তিযোদ্ধা ও ভাস্কর্য শিল্পী ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীকে হত্যার হুমকি দেয়া হয়। রাতেই ধানমন্ডি থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। হুমকিতে প্রিয়ভাষিণীকে বলা হয়, ‘প্রস্তুত হও। তোমার পরিনতিও ব্লগার নিলয়ের মতো হবে।’ টক শো’তে ব্লগার নিলয়সহ ব্লগারদের ওপর কারা বার বার হামলা চালায় সে প্রশ্ন রেখে উগ্রপন্থীদের কঠোর সমালোচনা করেন তিনি। একারণেই হুমকি দেয়া হয়েছে বলে ধারণা পুলিশের। গত ৩ নভেম্বর রম্য লেখক আহসান কবির নিরাপত্তা চেয়ে রাজধানীর বনানী থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন। আনসাল আল ইসলাম নামে একটি জঙ্গ সংগঠনের টু্ইট বার্তায় পরবর্তী টার্গেটকৃত ব্যক্তিদের মধ্যে রম্য আহসান কবিরের নাম আসে বলে জানান গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মোস্তাক আহমেদ। এরপর গত ১০ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে কুপিয়ে হত্যার হুমকি দেয় অজ্ঞাত দুর্বৃত্তরা। এরপর নিরাপত্তা চেয়ে রাতেই গুলশান থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন আনিসুজ্জামান। জিডি নং-৬৯৮। গত ১৩ সেপ্টেম্বর রেডিও ধ্বনি এফএমের প্রধান বার্তা সমন্বয়কারী (সিএনসি) শরীফ মুজিবুর রহমানকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে। +৬৫৮৯৭৭২২৩ নম্বর থেকে তার মোবাইল নম্বরে ফোন দিয়ে এ হুমকি দেওয়া হয়। গত ৩১ অক্টোবর জঙ্গি হামলায় লালমাটিয়াস্থ সি ব্লকের ৮/১৩ নং পাঁচতলা বিশিষ্ট একটি ভবনের চারতলায় শুদ্ধস্বরের কার্যালয়ে শুদ্ধস্বরের কর্ণধার আহমেদুর রশীদ টুটুলসহ ৫ জনকে দুর্বৃত্তরা কুপিয়ে ও গুলি করে আহত করে। অথচ তিনিও জীবননাশের হুমকি-ধমকির কথা জানিয়ে থানায় সাধারণ ডায়েরি(জিডি) করেছিলেন। জঙ্গিদের বিভৎস সব হামলায় মৃত্যু আতঙ্কের কথা লিখেও রক্ষা পাননি তিনি। স্ত্রী শামীম রুনা সাংবাদিকদের বলেন, অনেক দিন ধরে আহমেদুরকে অনুসরণ করা হচ্ছিল। হুমকি-ধমকি দেওয়া হচ্ছিল। এ কারণে চলতি বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি তিনি মোহাম্মদপুর থানায় একটি জিডি করেছিলেন। এছাড়া গত ৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমকে হত্যার হুমকি দিয়ে ই-মেইল করা হয়। ‘মিশন জিহাদ’র নায়েবে আমির পরিচয়দানকারী জনৈক নিজাম উদ্দিন ই-মেইলে (uddinnizam456@yahoo.com.au) হত্যার হুমকি দেয়া হয়। সিপিবি’র পক্ষ থেকে পাঠানো দলীয় সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এমনটাই জানানো হয়, ৪ ডিসেম্বর দিবাগত রাত ১২টা ২৮ মিনিটে ই-মেইলটি আসে। সঙ্গে একটি মোবাইল নম্বরও (০১৭৪৭২৩৩০৭০) ছিলো। এব্যাপারে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম জাগো নিউজকে বলেন, যে উদ্দেশ্য নিয়ে আমরা স্বাধীনতার যুদ্ধ করেছিলাম তা আজ ভুলুন্ঠিত। আর সে কারণেই এ ধরনের হত্যার হুমকি আসছে। যা পরিস্থিতির আলোকেই হচ্ছে। এ বিষয়ে সাধারণ ডায়েরি করেন বলে জানান তিনি। এসব ব্যাপারে ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (ডিবি) মনিরুল ইসলাম বলেন, আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেটস (আইএস) এবং আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের নাম ব্যবহার করে দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের হত্যার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, বিশিষ্ট নাগরিকদের হত্যার হুমকি, কয়েকটি হত্যাকাণ্ড এবং এর দায় স্বীকার করে আইএসের নামে বিবৃতি দেওয়ার ঘটনায় সরাসরি জামায়াত-শিবির জড়িত। তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কয়েকটি জঙ্গী সংগঠন। মানবতাবিরোধীদের বিচার নিয়ে পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া এই প্রক্রিয়ারই অংশ। আন্তর্জাতিকভাবে সরকারকে চাপে রাখতে এবং মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে পরিকল্পিতভাবে এমন অপতৎপরতা চালানো হচ্ছে। পৃথক একটি ঘটনায় বাড্ডা থেকে নাহিদ হোসেন ও আব্দুল হক নামে দুজনকে গ্রেফতারের পর এমনই দাবি করেন তিনি।জেইউ/জেডএইচ/এআরএস/পিআর
Advertisement