কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে একটু এগুতেই বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দক্ষিণ দিকের ফুটপাতে ভাতের হোটেল সাজিয়ে বসেছেন পঞ্চাশোর্ধ বৃদ্ধা আনোয়ারা ও আনুমানিক বিশ-বাইশ বছরের তরুণী মনি বেগম। মঙ্গলবার দুপুর একটার দিকে এ দৃশ্য দেখা্ যায়।হোটেল বলতে ফুটপাতের রাস্তায় তিনটি ছোটবড় আকারের পাতিল, মেলামাইনের কয়েকটা বাসন, তেল চিটচিটে একটি সাদা রংয়ের বড় প্লাস্টিকের গ্যালন, একটি বড় সাইজের চামচ ও একটি জাতীয় দৈনিকের ছেঁড়া পৃষ্ঠাতে একটু লবণ ও কয়েকটি কাঁচা বড়ই। কাঠের একটি পিঁড়িতে বসে মনি বেগম রাস্তা দিয়ে চলমান রিকশা, সিএনজিচালিত অটোরিকশা কিংবা ভ্যানগাড়ি ওয়ালা দেখলেই ডেকে উঠে বলছিলেন, কিরে ভাত খাবি, খাইলে আয়? ভাত মাংস ৪০ টাকা, ভাত ডিম ৩০ টাকা আর আর ভাত মুগডাল ২৫ টাকা। ক্রেতাদের ডাকার সময় ভয়ার্ত চোখে বার বার ডানেবামে তাকাচ্ছিলেন। তার কয়েকগজ দূরে একই ধরনের ভাতের হোটেল নিয়ে বসেছিলেন আনোয়ার নামের এক বৃদ্ধা। শরীর ও শক্তিতে না কুলানোর ফলে তিনি তরুণীর মতো হাকডাক না দিয়ে ভাত ও তরকারির পাতিল নিয়ে চুপচাপ বসেছিলেন। কৌতুহলবশত সামনে যেতেই ভয়ার্ত চোখে তাকালেন মনি ও আনোয়ারা বেগম। কি করছেন বলতেই কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললেন, ‘স্যার, আইজকা ভাত তরকারি ফেইলা দিয়েন না। কষ্ট কইরা ভাত বেচি, চুরি কইরা খাইনা।’জাগো নিউজের এ প্রতিবেদকের পরিচয় পেয়ে জানালেন, তারা সম্পর্কে মা ও মেয়ে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আশেপাশের ফুটপাতে তাদের বসবাস। দু’বেলা দুমুঠো ভাত পেটে দিতে তারা ভাসমান ভাতের হোটেল চালাচ্ছেন।কিন্তু ফুটপাতে দোকান বসালেই পুলিশ, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও মাস্তানরা বাধা দেয়। অনেক সময় ডেকচি তুলে রাস্তায় ফেলে দেয়। এসব বলেই একটি চ্যাপ্টা হওয়া ডেকচি দেখিয়ে বলেন, এইতো দুদিন আগে পুলিশ ভাতসহ ডেকচি উড়িয়ে ফেলে দিয়েছে। নিরাপত্তাহীনতার অজুহাত তুলে ফুটপাতে দোকান না বসাতে হুমকি দিয়েছে। জানা গেল, প্রতিদিন রাতে বাজার থেকে চাল, ডাল, সবজি মাছ, মাংস ও ডিম কিনে আনেন তারা। ভোর ৬টা থেকে রান্নাবান্না শুরু করেন। কেজি পাঁচেক চালের ভাত, দুই আড়াই কেজি সবজি (বেগুন, আলু, টমেটো, ফুলকপি, গাজর ইত্যাদি),আধা কেজি গরুর মাংস ও ডজনখানেক ডিমের ভুনা তরকারি রান্না করেন। দুপুর বেলা ফুটপাতে ভাতের হোটেল নিয়ে বসেন। নিম্ন আয়ের রিকশাচালক, ভ্যানচালক, পান সিগারেট বিক্রেতা ইত্যাদি শ্রেণির মানুষ তাদের ভাসমান এই হোটেলে খাওয়া দাওয়া করেন। যেদিন ভাল বিক্রি হয় সেদিন হাজার বারশ’ টাকা বিক্রি হয়। লাভ থাকে দুই তিনশ’ টাকা। কিন্তু যেদিন ফুটপাতে রান্না করা খাবার বিক্রি করতে পারেন না সেদিন খাবার থেকে যায়। ফলে লোকসান গুনতে হয়। এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে আনোয়ারা বেগম দাবি করেন তার স্বামী কানু খাঁ একজন মুক্তিযোদ্ধা। রংপুরের চিলমাড়ি এলাকায় যুদ্ধ করেছেন। তার কাছে নাকি প্রমাণও রয়েছে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী হিসেবে তিনি কিছুই পাননি।এক পর্যায়ে বললেন, প্রধানমন্ত্রীর কাছে যদি আমার কষ্টের কথাগুলো বলতে পারতাম তবে তিনি নিশ্চয়ই কিছু সাহায্য সহযোগিতা করতেন। মেয়ে মনিকে দেখিয়ে বলেন, ‘বিয়া অইছিল, চাঁদনি নামের দেড় বছরের একটা সন্তানও আছে, স্বামী তালাক দিয়া চইল্যা গেছে।’এখন ঢামেক হাসপাতালের ফুটপাতে ভাসমান অবস্থায় জীবন কাটছে। ভাসমান ভাতের হোটেল চলা না চলার ওপর নির্ভর করে তাদের মা, মেয়ে আর ছোট নাতনির জীবন। এমইউ/এসএইচএস/এমএস
Advertisement