স্নেহ, মমতা ও সম্মান মহান আল্লাহর দান। দয়া মমতা ও সম্মানহীন অন্তর আল্লাহর বিশেষ রহমত থেকে বঞ্চিত। যার অন্তরে মায়া-মমতা কিংবা সম্মানবোধ থাকবে না মহান প্রভুর দরবারে তার কোনো মূল্যয়ন হবে না। তারপরও প্রশ্ন থেকে যায়- মানুষ কেন ছোটদের স্নেহ করবে আর বড়দের করবে সম্মান?
Advertisement
ছোটদের স্নেহ করা আর বড়দের সম্মান করা প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশ ও অন্যতম সুন্নাত আমল। যদি কেউ এ সুন্নাত আমল থেকে বিরত থাকে; তাদের সঙ্গে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই মর্মে ঘোষণা করেছেন স্বয়ং বিশ্বনবি-
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনু আমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমাদের ছোটদেরকে স্নেহ করে না এবং আমাদের বড়দেরকে সম্মান করে না সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়।’ (আবু দাউদ, আদাবুল মুফরাদ, বুখারি; মুসনাদে আহমাদ)
সুন্দর ও হৃদ্যতাপূর্ণ সমাজ ব্যবস্থা বিনির্মাণে স্নেহ-মমতা-ভালোবাসা ও সম্মানবোধের বিকল্প নেই। হাদিসের একাধিক বর্ণনা থেকে তা প্রমাণিত-
Advertisement
১. হজরত আব্দুল্লাহ ইবনু আমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর বর্ণনায় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘দয়াশীলদের উপর করুণাময় আল্লাহ দয়া করেন। তোমরা দুনিয়াবাসীকে দয়া করো, তাহলে যিনি আসমানে আছেন তিনি তোমাদেরকে দয়া করবেন।’ (আবু দাউদ, তিরমিজি, মুসনাদে আহমাদ)
কত সুন্দর কথা ও আল্লাহর রহমতের ঘোষণা এসেছে এ হাদিসে। দুনিয়ায় যারা পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা, দয়া ও সম্মানবোধ বজায় রাখবে, আসমানের মালিক মহান আল্লাহ তাদের প্রতি দয়া করবেন। এর চেয়ে উত্তম ঘোষণা আর কি হতে পারে!
২. হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, আমি সত্যবাদী ও সত্যবাদী বলে স্বীকৃত এই হুজরার মালিক আবুল কাসিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, হতভাগা ছাড়া অন্য কারো থেকে দয়ামায়া উঠিয়ে নেওয়া হয় না।’ (আবু দাউদ, বুখারি, তিরমিজি, মুসনাদে আহমাদ, আদাবুল মুফরাদ)
দয়া-মায়া-মমতা ও শ্রদ্ধাবোধ মহান আল্লাহর বিশেষ দান ও অনুগ্রহ। মায়া-মমতা ও শ্রদ্ধাবোধশূন্য অন্তর মহান আল্লাহর অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত থাকে। তাই যারা ছোটদের স্নেহ মমতা ও ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ রাখবে এবং বড়দের প্রতি সম্মান রাখবে আল্লাহর দরবারে তারা ততবেশি সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী হবে। তাদের প্রতি থাকবে মহান আল্লাহর বিশেষ দয়া-মমতা ও ভালোবাসা। এর ব্যতিক্রম হলেই আল্লাহ কাউকে দয়া দেখাবেন না মর্মে ঘোষণা করেছেন স্বয়ং বিশ্বনবি-
Advertisement
হজরত জারির ইবনে আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘‘যে ব্যক্তি মানুষের প্রতি দয়া করে না; আল্লাহ তাআলাও ওই ব্যক্তি প্রতি দয়া করে না।’ (বুখারি ও মুসলিম)
কোনো মুমিন ব্যক্তি নির্দয় হতে পারে না। বরং হাদিসের মুমিনের পরিচয় দিতে গিয়ে প্রিয় নবি ঘোষণা করেন-
হজরত নুমান ইবনে বাশির রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তুমি মুমিনদের পারস্পরিক দয়া, স্নেহ-মমতা, ভালোবাসা ও সমবেদনার দিক থেকে এমন অবস্থায় পাবে; যেমন- দেহের অঙ্গগুলোর একটি অসুস্থ হলে সারা দেহ বিনিদ্রা এবং জ্বরে আক্রান্ত হয়। (বুখারি)
হাদিসের বর্ণনা অনুযায়ী কোনো মুমিন দুঃখিত বা ব্যথিত হলে সব মুমিনের হৃদয় জ্বলবে। ব্যথিত হবে। তার প্রতি দয়া-মায়া-মমতা ও ভালোবাসা বেড়ে যাবে।
ছোটদের স্নেহ করা প্রসঙ্গে প্রিয় নবি...
একবার রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক শিশুকে আদর করে চুমু খেলেন এবং বললেন, নিশ্চয়ই তোমরা (তোমাদের ভালোবাসা) মা-বাবাকে ভিতু এবং কৃপণ বানিয়ে ফেল। এরপর এক সাহাবি কথা প্রসঙ্গে বলে উঠলেন, হে আল্লাহর রাসুল! সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম; আমার তো ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে রয়েছে, অথচ আমি কখনো তাদের আদর করে একটি চুমুও দিই না। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘একমাত্র হতভাগা লোকদের থেকেই দয়া-মায়া ছিনিয়ে নেওয়া হয়।’ (তিরমিজি)
মনে রাখতে হবে
ছোটদের অধিকার স্নেহ-ভালোবাসা পাওয়া আর বড়দের অধিকার শ্রদ্ধা ও সম্মান পাওয়া। এ কারণেই প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শিশুদের মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসতেন। যে কোনো শিশুকে তিনি নিজের সন্তানের ন্যায় আদর-সোহাগ করতেন। শিশুদের কোনো ধরনের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন না করে তাদের সঙ্গে সব সময় ভালো ব্যবহারের মাধ্যমে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা দানের কথা বলেছেন। সে কারণেই প্রিয় নবি বলেছেন-
‘যে ব্যক্তি আমাদের ছোটদের প্রতি স্নেহ করে না এবং বড়দের সম্মান প্রদর্শন করে না, সে আমাদের কেউ নয়।’ (আবু দাউদ, তিরমিজি)
হজরত আকরা ইবনে হাবিস রাদিয়াল্লাহু আনহু একবর রাসুলুল্লাহর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে দেখতে পেলেন, তিনি তাঁর দুই নাতি ইমাম হাসান ও হুসাইনকে চুমু দিচ্ছেন। তখন তিনি নবিজীকে বললেন, আপনি আপনার মেয়ের ছেলেদের চুমু দিচ্ছেন? আল্লাহর শপথ! আমার দশ দশটি সন্তান রয়েছে, এদের কাউকেই আমি কোনো দিন চুমু দেইনি। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বললেন, ‘আল্লাহ তোমার অন্তর থেকে রহমত ছিনিয়ে নিয়েছেন, তাতে আমার কী দোষ?’ (বুখারি)
প্রিয় নবি শিশুদের কতবেশি ভালোবাসতেন; তার প্রমাণ মিলে মক্কা বিজয়ের সময়। তিনি যখন মক্কায় প্রবেশ করেন তখনও তার সাওয়ারিতে একজন শিশু ও একজন কিশোর ছিল। শিশুটি ছিল প্রিয় নবির বড় জয়নবের শিশুছেলে আলি আর কিশোরটি ছিল উসামা।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শিশুদের এতবেশি ভালোবাসতেন যে, যখন তিনি নামাজে দাঁড়াতেন আর তখন কোনো শিশুর কান্নার শব্দ শুনলেই তিনি নামাজ সংক্ষিপ্ত করতেন। হতে পারে শিশুর মা নামাজে আছেন। যাতে মা তার সন্তানকে স্নেহ-ভালোবাসায় শান্ত করতে পারে এ জন্যই তিনি নামাজ সংক্ষিপ্ত করতেন।
শুধু তা-ই নয়
প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুসলিম কি অমুসলিম; সব শিশুকেই জড়িয়ে ধরতেন। আদর-স্নেহ করতেন এবং ভালোবাসতেন। কেননা তিনি হাদিসে বর্ণনা করেন-
‘প্রতিটি নবজাতকই জন্মলাভ করে ফিতরাতের উপর। এরপর তার মা-বাপ তাকে ইয়াহুদি বা খ্রিস্টান বা অগ্নিপূজারি রূপে গড়ে তোলে।’ (বুখারি)
অনুরূপ বড়দের প্রতি সম্মানবোধ ও মর্যাদার ব্যাপারে প্রিয় নবি ছিলেন সজাগ ও উদার। তাই বড়দের করণীয় হলো ছোটদের স্নেহ করা আর বড়দের শ্রদ্ধা সম্মান করা।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে ছোটদের স্নেহ ও বড়দের সম্মান করার তাওফিক দান করুন। হাদিসের উপর যথাযথ আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
এমএমএস/জিকেএস