মতামত

অস্থির রোহিঙ্গা ক্যাম্প ও আমাদের নিরাপত্তা

ইয়াহিয়া নয়ন

Advertisement

ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে মিয়ানমার থেকে প্রাণভয়ে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের শিবিরগুলো। বাংলাদেশ পিস অবজারভেটরির (বিপিও) ‘রোহিঙ্গা শিবিরে নিরাপত্তা: সহিংসতার মাত্রা’ শীর্ষক প্রতিবেদনের সর্বশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত গত চার বছরের টেকনাফ ও উখিয়ার শিবিরগুলোতে ১০৮ জন নিহত হয়েছেন। আততায়ীদের গুলিতে রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহর নিহত হওয়ার তথ্য এতে যুক্ত হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ ‘পার্টনারশিপস ফর আ টলারেন্ট অ্যান্ড ইনক্লুসিভ বাংলাদেশ’ নামের একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। সেই প্রকল্পের একটি অংশ বিপিও।

বিপিওর প্রতিবেদন অনুযায়ী, নিহত ১০৮ জনের মধ্যে ৭৮ জনকে অতর্কিতভাবে দুর্বৃত্তরা খুন করে গেছে। বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ ও গোলাগুলিতে প্রাণ হারান ২২ জন। অপহরণের পর হত্যা করা হয় দুজনকে। এ ছাড়া বিভিন্ন ঘটনায় খুন হন ৬ জন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এক হিসাব থেকে জানা গেছে, প্রথম তিন বছরে প্রায় ১২ ধরনের অপরাধে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ৭৩১টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় অনেকে জেলও খেটেছেন।

পুলিশ ও শিবিরসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র জানাচ্ছে, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারা এ দেশে আসা শুরু করে। পরবর্তী সময়ে আশ্রয়শিবিরগুলোতে নানা রকম অপরাধ কর্মকান্ড শুরু হয়। শুরুর দিকে বেশ কটি খুনের ঘটনা ছিল রাখাইনে পূর্বশত্রুতার জের ধরে। এরপর শিবিরগুলোতে আধিপত্য বিস্তার এবং বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিয়ে দ্বন্দ্ব-সংঘাত হয়। ডাকাতি, অপহরণ, মাদক ও মানব পাচারের মতো ঘটনার জেরেও কিছু খুন হয়েছে। পারিবারিক কারণেও কিছু ঘটনা ঘটেছে।

Advertisement

সম্প্রতি আলোচনায় এসেছে প্রত্যাবাসনের পক্ষে বিপক্ষের বিরোধ। মিয়ানমারে ফিরে যাওয়া না যাওয়ার বিষয়ে দুটি পক্ষ তৈরি হয়েছে। এই দ্বন্দ্ব-সংঘাকেই প্রাণ হারিয়েছেন রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ। সম্প্রতি ব্রাশ ফায়ারে প্রাণ হারিয়েছেন সাত জন। এই সংঘাত দীর্ঘ হবে বলেই নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন। শুধু তাই নয়। এটা এখন বাংলাদেশ এবং এ অঞ্চলের নিরাপত্তার প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। যা চার বছর আগেই জাতিসংঘের ভাষণে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী আশঙ্কা করেছিলেন।

যখন দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনায় ২০ হাজার ৬১৯ জনকে অভিযুক্ত করে ১০২টি মামলা দায়ের করে ৫৮৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে, ঠিক তখনই রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সাত জন নিহত ও বহুজন আহত হওয়ার ঘটনাটি ঘটলো। ভাববার সময় হয়েছে, কোন পথে রোহিঙ্গা ইস্যু? রোহিঙ্গা সংকট কি শুধু শরণার্থীবিষয়ক সমস্যা হিসেবে আছে? নাকি সন্ত্রাসের হটস্পটে পরিণত হয়ে বিপজ্জক দিকে মোড় নিচ্ছে? সাধারণ শরণার্থী সমস্যা থেকে ইস্যুটি যে দিনে দিনে জাতীয় নিরাপত্তার ইস্যুতে পরিণত হচ্ছে, তা এখন স্পষ্ট হয়ে গেছে।

সন্ত্রাস হানাহানি ছাড়াও মাদক, অস্ত্র চোরাচালান, মানব পাচার ইত্যাদি নানাবিক অপরাধ সংগঠিত হচ্ছে প্রায় এগারো লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ঘিরে। স্থানীয় মানুষের সঙ্গেও প্রায়শই সংঘর্ষে জড়াচ্ছে রোহিঙ্গারা। যার ফলে বিভিন্ন মাত্রার উত্তেজনা যেমন তৈরি হচ্ছে, তেমনিভাবে বাড়ছে নিরাপত্তার ঝুঁকি। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র সফরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে দেরি হচ্ছে বলে তাদের মধ্যে হতাশা বাড়ছে। অনেকের মধ্যে উগ্রবাদে জড়ানোর ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে বাংলাদেশের উদ্যোগে আয়োজিত ‘ফোরসিবলি ডিসপ্লেসড মিয়ানমার ন্যাশনালস (রোহিঙ্গা) ক্রাইসিস: ইম্পেরাটিভস ফর এ সাস্টেইনেবল সলিউশন’ শীর্ষক ভার্চুয়াল বৈঠকে এসব কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যুক্তরাজ্য, আয়ারল্যান্ড, তুরস্ক ও সৌদি আরব এই আয়োজনে সহযোগিতা করেছে।

Advertisement

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘‘আমি বার বার বলে আসছি, তারা (রোহিঙ্গারা) মিয়ানমারের নাগরিক, সুতরাং নিরাপদে এবং আত্মমর্যাদার সঙ্গে নিজের দেশ মিয়ানমারেই তাদের ফিরে যেতে হবে। আমাদের সবাইকে, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সেজন্য সম্ভব সব কিছু করতে হবে।’’

তিনি বলেন, রোহিঙ্গা সংকট একটি আন্তঃসীমান্ত এবং আঞ্চলিক সমস্যা, সুতরাং এ মানবিক সংকটের সমাধান করা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়েরই দায়িত্ব। ‘‘গুরুতর এ সংকট বিলম্বিত হলে আমাদের সবার নিরাপত্তাই হুমকির মুখে পড়বে। প্রত্যাবাসনের উদ্যোগে কোনো উন্নতি না হওয়ায় রোহিঙ্গাদের মধ্যে হতাশা বাড়ছে। তাদের অনেকে নানা অপরাধমূলক কাজে জড়াচ্ছে। তাদের অনেকের উগ্রবাদে জড়ানোর ঝুঁকিও তৈরি হচ্ছে। আমাদের পুরো অঞ্চলের জন্য এটা একটা হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।’’

পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, যারা মিয়ানমারে যেতে চায় না তারাই রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অঘটন ঘটিয়ে থাকতে পারে। ‘রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নত করতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সভাপতিত্বে একটি সভা হয়েছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্প ও রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাইরে যাতে আইনশৃঙ্খলা আরও উন্নত করা যায় সেটি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এরপরও রোহিঙ্গা ক্যাম্পের দুর্ঘটনা, এটা তো খুবই আতঙ্কের বিষয়।’ তিনি বলেছেন, ‘বিভিন্ন লোকে বলছে যে, ওখানে ড্রাগের ব্যবসা হয়। আর কেউ কেউ তথ্য দিয়েছে, কিছু উইপেন, কিছু বন্দুকও আনা হয়। আমরা এসব নিয়ে আলোচনা করেছি। আমার প্রস্তাব হলো, এই ড্রাগ ও অস্ত্র পুরোপুরি বন্ধ করার জন্য প্রয়োজনে গুলি ছুঁড়তে হবে।’

সাম্প্রতিক উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে হামলায় ৭ জন নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় আহত হন কমপক্ষে ১১ থেকে ১৫ জন। প্রথমে দুই গ্রুপের সংঘর্ষ বলা হলেও পরে জানা গেছে ৮ থেকে ১০ জনের সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ এসে মসজিদে নামাজরত মুসল্লিদের গুলিবর্ষণ করে পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় অস্ত্রসহ মুজিবুর রহমান নামে একজনকে আটক করেছেন ৮ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের সদস্যরা।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এসব সন্ত্রাসী ঘটনা খুবই স্পর্শকাতর, সংঘবদ্ধ ও পরিকল্পিত। বাড়িঘর ফেলে আশ্রয় নেওয়া নারী, পুরুষ, শিশু শরণার্থীদের কাজ নয় এসব সন্ত্রাস। বরং রেহিঙ্গাদের মধ্যে সন্ত্রাসী আকারে কোনো কোনো সশস্ত্র গ্রুপের উপস্থিতির ইঙ্গিত দেয় এসব ঘটনা, যারা আগেও একাধিক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেছে।

ফলে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ঘিরে মানবাধিকার রক্ষা ও মানবিক সহায়তা প্রদানের পাশাপাশি নিরাপত্তার ক্রমবর্ধমান ঝুঁকি চিহ্নিত ও নিরসন করা জরুরি। কেননা, বিশ্বের বিভিন্নস্থানে শরণার্থী সমস্যা থেকে ভয়ানক নিরাপত্তার সমস্যা সৃষ্টি হওয়ার নজির রয়েছে। করাচিতে বিহারি শরণার্থী, লেবাননে ফিলিস্তিনি শরণার্থী, পাকিস্তানে আফগান শরণার্থীদের ঘিরে নাজুক পরিস্থিতি ও উত্তেজনাকর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এসব থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে।

বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিয়েও আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পর্যায়ে স্রোতের মত বিলিয়ন-মিলিয়ন ডলার খরচ করা হচ্ছে। কক্সবাজার শহর ও শরণার্থী অধ্যুষিত এলাকায় একাধিক বার সরেজমিনে গিয়ে ব্যাঙের ছাতার মতো এনজিও প্রতিষ্ঠানের দেখা পাওয়া গেছে। সেসব এলাকায় গিজগিজ করছে বিভিন্ন এনজিওতে কর্মরত তরুণ-তরুণীরা। বিভিন্ন সময়ে তাদের নিয়ে আপত্তিকর খবরও প্রকাশ পায়। এইসব উন্নয়ন তৎপরতা বিরাট আর্থিক লেনদেন ও কর্মসংস্থানের সিন্ডিকেটে পরিণত হলেও রোহিঙ্গা ইস্যুর নিরাপত্তাজনিত সমস্যা দূরীকরণে সুপরিকল্পিত পদক্ষেপের মাধ্যমে আদৌ কোনো ভূমিকা পালন করতে পারছে না। বরং সেখানে সন্ত্রাস, হত্যাকাণ্ড, মাদক, অস্ত্র, মানব পাচারের একটি অদৃশ্য জগৎ তৈরি হচ্ছে।

বর্তমান সংকটজনক পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যাটি মানবিক দিকের পাশাপাশি বিপজ্জনক নিরাপত্তার ইস্যুতে পরিণত হচ্ছে বলেই প্রতীয়মান হয়, যা একের পর এক ভয়াবহ ঘটনার জন্ম দিচ্ছে। এমনতাবস্থায় জাতীয় নিরাপত্তার নীতি ও কৌশলের আলোকে রোহিঙ্গা ইস্যু এবং শরণার্থীদের কেন্দ্র করে পরিচালিত দেশি-বিদেশি তৎপরতাকে গভীর পর্যবেক্ষণ, নিয়ন্ত্রণ ও স্কুটিনির আওতায় আনা অপরিহার্য। রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার ও মানবিক সহায়তা নিশ্চিত করা অবশ্যই বাংলাদেশসহ বিশ্ববাসীর কর্তব্য। তবে সেটা মোটেও সামগ্রিক নিরাপত্তার ঝুঁকি ও বিপদ বাড়িয়ে নয়। শেখ হাসিনার আশঙ্কাই সঠিক “গুরুতর এ সংকট বিলম্বিত হলে আমাদের সবার নিরাপত্তাই হুমকির মুখে পড়বে।”লেখক : সাংবাদিক।

এইচআর/জিকেএস