বাংলাদেশ শুধু নয়, বিশ্বের ব্যস্ততম শহরগুলোর অন্যতম ঢাকা সিটি। দুই কোটিরও বেশি মানুষের বাস এ রাজধানী শহরে। এখানে যেন দিনরাত বলে কিছু নেই। জীবন ও জীবিকার দৌড়ে এ শহরে অহর্নিশ ছুটে মানুষ। ব্যস্ততাই যেন নগরবাসীর নিত্যসঙ্গী। তবে এ ছুটে চলায় লাগাম টানে চিরাচরিত যানজট। এ সংকট নিরসনে ট্রাফিক সিগন্যাল স্থাপন, পদচারী-সেতু ও ইউলুপ নির্মাণসহ বিভিন্ন সময় নানা পদক্ষেপ নিতে দেখা গিয়েছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনকে (ডিএনসিসি ও ডিএসসিসি)। কিন্তু কাজের কাজ যেন কিছুই হয়নি। কোনো প্রকল্পেরই সুফল মেলেনি নগরবাসীর। উল্টো সড়কে যানজট তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে প্রতিনিয়ত। তাতে জনাকীর্ণ এ নগরীতে নাগরিক দুর্ভোগের সঙ্গে জীবন থেকেও হারাচ্ছে মূল্যবান বহু সময়।
Advertisement
পরিস্থিতি উত্তরণে কূল-কিনারা না পেয়ে বাস রুট রেশনালাইজেশন বা কয়েকটি কোম্পানির মাধ্যমে ঢাকায় বাস পরিচালনায় গুরুত্ব দিচ্ছে ডিএনসিসি ও ডিএসসিসি। এরই ধারাবাহিকতায় আগামী ১ ডিসেম্বর ১২০টি নতুন বাস নিয়ে ‘ঢাকা নগর পরিবহন’ নামে শুরু হচ্ছে বাস রুট রেশনালাইজেশনের প্রথম ধাপ। কেরানীগঞ্জের ঘাটারচর থেকে কাঁচপুর পর্যন্ত চলবে এ পরিবহন। প্রায় ২১ কিলোমিটারের এ রুটে প্রতি কিলোমিটার যাতায়াত ভাড়া পড়বে দুই টাকা ২০ পয়সা। গত ৫ অক্টোবর ডিএসসিসির নগর ভবনের বুড়িগঙ্গা হলে ‘বাস রুট রেশনালাইজেশন’ কমিটির ১৮তম তথা সবশেষ সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়।
রাজধানীতে গণপরিবহনে শৃঙ্খলা আনতে ২০১৮ সালে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) সাবেক মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকনকে আহ্বায়ক করে সাত সদস্যের ‘বাস রুট রেশনালাইজেশন’ কমিটি গঠন করেছিল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। এর মধ্যে গত তিন বছরে কমিটি ১৮টি সভাও করেছে। তবে এসব সভার কার্যকর কোনো প্রতিফলন মাঠ পর্যায়ে দেখা যায়নি। সড়ক দুর্ঘটনা এবং সড়কে প্রাণহানিও কমেনি। এক্ষেত্রে আগামী ১ ডিসেম্বর চালু হতে যাওয়া ‘ঢাকা নগর পরিবহন’ হতে পারে যানজট নিরসনে কমিটির পদক্ষেপ বাস্তবায়নের প্রথম ধাপ। এরইমধ্যে বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটির আহ্বায়কের দায়িত্ব নিয়েছেন ডিএসসিসি বর্তমান মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস।
ঢাকার দুই সিটির প্রকৌশল বিভাগ সূত্র জানায়, ২০১১ সালে নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ (কেইস) শীর্ষক একটি প্রকল্প নিয়েছিল পরিবেশ অধিদপ্তর। তবে প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয় ডিএসসিসিকে। প্রকল্পের আওতায় ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ সব সড়ক বাতি স্থাপন, পদচারী-সেতু নির্মাণ, ট্রাফিক সাইন স্থাপনসহ বিভিন্ন অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়। কিন্তু এ পর্যন্ত সেগুলোর কোনোটিই নগরবাসীর তেমন কাজে আসেনি। বছর দুই আগে এ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়েছে।
Advertisement
গত বছর অর্থাৎ ২০২০ সালে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ও পথচারীদের নিরাপদে রাস্তা পারাপারে ৩৬টি নতুন পদচারী-সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। এর মধ্যে আটটি পদচারী-সেতুতে ১৬টি চলন্ত সিঁড়ি (এস্কেলেটর) স্থাপন হচ্ছে। এতে যত্রতত্র রাস্তা পারাপার এবং সড়ক দুর্ঘটনা কমবে বলে মনে করছে সংস্থাটি।
ডিএনসিসির ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং সার্কেল সূত্র জানায়, ২০২০ সাালের ৩ জানুয়ারি ‘ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় ট্রাফিক অবকাঠামো উন্নয়নসহ সড়ক নিরাপত্তা প্রকল্পের’ প্রশাসনিক অনুমোদন দেয় স্থানীয় সরকার বিভাগ। এ প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয় ৩১৯ কোটি ২৩ লাখ সাত হাজার টাকা। ২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত এ প্রকল্পের সময় নির্ধারণ হয়। প্রকল্পের মধ্যে নগরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ৫০টি নতুন যাত্রী ছাউনি নির্মাণ, বিদ্যমান ৪৭টি পদচারী-সেতু সংস্কার, ট্রাফিক সাইন স্থাপন, সড়ক, সড়ক মিডিয়ান ও ফুটপাত উন্নয়নের কথা বলা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ২০১৯ সালের মার্চে প্রগতি সরণিতে সড়ক দুর্ঘটনায় একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবরার আহমেদ চৌধুরী নিহত হন। ওই ঘটনার পর নগরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পদচারী-সেতু এবং চলন্ত সিঁড়ি নির্মাণে প্রকল্প তৈরির নির্দেশনা দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সে অনুযায়ী প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এটি বাস্তবায়ন হলে যত্রতত্র রাস্তা পারাপার ও দুর্ঘটনা কমবে।
বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটির সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এরইমধ্যে তারা সমীক্ষা প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন। প্রতিবেদনে ২১৯টি রুটের পরিবর্তে ৪২টি রুটে ২২ কোম্পানির মাধ্যমে গণপরিবহন পরিচালনার সুপারিশ করা হয়েছে। নগরীতে চলাচল করা দুই হাজার ৫০০ কোম্পানির প্রায় ৩০ হাজার বাসের পরিবর্তে নয় হাজার ২৭টি গণপরিবহন পরিচালনার প্রস্তাব হয়েছে।
Advertisement
কমিটির গত ৫ অক্টোবরের সভা শেষে ডিএসসিসি মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস সাংবাদিকদের বলেন, নগরের সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে গত এক বছর আমরা অক্লান্ত পরিশ্রম করেছি। বিষয়টি অত্যন্ত জটিল ও দুরূহ। আমরা লক্ষ্য পূরণের কাছাকাছি আছি। ঘাটারচর থেকে কাঁচপুর পর্যন্ত একটি পাইলটিং রুট নির্ধারণ করেছি। এ রুটে নতুন নিয়ম ও পদ্ধতিতে বাস চলবে। সবার প্রচেষ্টায় আমরা এতদূর এসেছি।
নতুন এ রুটে কোনো পুরোনো বাস থাকবে না জানিয়ে মেয়র বলেন, ঘাটারচর-কাঁচপুর রুটে পুরোনো বাস চলবে না। ২০১৯ সালের ১ জানুয়ারির পর কেনা হয়েছে, শুধুমাত্র সেই বাসগুলোই এ রুটে চলবে। অন্য বাসগুলো উঠিয়ে নেওয়া হবে। চাহিদা অনুযায়ী নতুন বাস নামানো হবে। পরিবহন মালিকরা এতে সম্মত।
এ সময় ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, ঢাকায় গণপরিবহনে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হচ্ছে। এর মাধ্যমে নগরে গণপরিবহনে শৃঙ্খলা আসবে। চালকদের মাঝে প্রতিযোগিতাপূর্ণ মনোভাব থাকবে না। নতুন এ রুটে ৪০টির বেশি যাত্রী ছাউনি হবে। বাস -বে’র সংখ্যা হবে ১৬টি। জায়গা সংকটের কারণে বাস-বে’র সংখ্যা বাড়ানো যাচ্ছে না। এছাড়া এ রুটের বাসগুলোর আলাদা রং হবে, এ বিষয়টি ২০ অক্টোবর নির্ধারণ হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের এক কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, যে গতিতে বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটি কাজ করছে, এভাবে চললে আগামী দু-তিন বছরেও ঢাকা শহরে গণপরিবহনে শৃঙ্খলা আনা সম্ভব হবে না। প্রতিটি পদক্ষেপ বাস্তবায়নে কমিটি এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে কাজের গতি বহুগুণ বাড়াতে হবে।
এমএমএ/এমকেআর/এইচএ/এএসএম