দেশজুড়ে

পেশা ছাড়ছেন কক্সবাজারের লবণচাষিরা

সুস্বাদু খাবারসহ নানা প্রয়োজনে অপরিহার্য উপাদান লবণ। দেশের চাহিদা পূরণে লবণ উৎপাদনে কাজ করেন কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের মাত্র ৫৫ হাজার চাষী। কক্সবাজারের ৯ উপজেলার সাতটি ও চট্টগ্রামের বাঁশখালীর কিছু অংশ নিয়ে প্রায় সাড়ে ৫৭ হাজার একর জমিতে লবণ চাষ করে দেশের চাহিদা মেটান তারা।

Advertisement

প্রতিবছরই চাহিদা মতো বা চাহিদার অতিরিক্ত উৎপাদন হওয়ায় লবণ একটি স্বয়ংসম্পন্ন শিল্পপণ্যে রূপ লাভ করেছে। মাঠ পর্যায়ে তিন থেকে পাঁচ টাকা কেজি কিনে প্রক্রিয়াজাতের পর বাজারে প্যাকেটজাত লবণ ৩৫-৪০ টাকায় বিক্রি হলেও ন্যায্যমূল্য মিলে না চাষিদের। তার উপর একটি মুনাফালোভী গোষ্ঠী বিদেশ থেকে লবণ আমদানির চেষ্টা করছে। ফলে স্বগৌরবে মাথা তুলে থাকতে পারছে না স্বয়ংসম্পন্ন দেশীয় লবণ শিল্প। তাই এ শিল্পে সম্পৃক্ত অনেকেই পেশা ছাড়ছেন।

কক্সবাজারের ঈদগাঁও উপজেলার উপকূলীয় গোমাতলীর লবণ চাষি রিদুয়ানুল হক (২৯) বলেন, বৃটিশ আমল থেকে পরিবার লবণ উৎপাদনে সম্পৃক্ত। পূর্বপুরুষের পেশা এখন আমরা ধরে রেখেছি। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ এককভাবে তিন কানি (এক একর ২০ শতক) জমিতে লবণ চাষ করতে পারেন। গ্রীষ্মের ৫-৬ মাসে এক কানি জমিতে লবণ উৎপাদন হয় প্রায় ৯০০ মণ (প্রায় ৩৬ টন)। এ পরিমাণ লবণ উৎপাদনে জমির লাগিয়ত (লিজ) ৪৫ হাজার, লেবার খরচ ৭৫-৮০ হাজার, পলিথিন ১৮ হাজার, পানি উত্তোলন ১২ হাজার, খাবার ১৮ হাজারসহ অন্যান্য মিলে (পুরো মৌসুমে) এক লাখ ৮০ হাজার টাকা (কম-বেশি) খরচ হয়। কিন্তু উৎপাদিত (৯০০ মণ) লবণ বিক্রি করে বর্তমান বাজার দরে (প্রতি বস্তা ৮০ কেজি লবণের দাম ৫৭০-৫৮০ টাকা) পাওয়া যাচ্ছে দুই লাখ ৫৬ হাজার ৫০০ টাকা। প্রায় ৯০ হাজার টাকা চলে যায় পরিবহন ও ঘাট বা গুদি খরচে। সে হিসেবে উৎপাদিত লবণ বিক্রি করে আয় হয় এক লাখ ৬৬ হাজার ৫০০ টাকা। কিন্তু লবণ উৎপাদনে এক লাখ ৮০ হাজার টাকা খরচ পড়লে আয়-ব্যয়ে সাড়ে ১৩ হাজার টাকা ঘাটতি থাকছে। গত কয়েক বছর ধরেই এ ক্ষতি টেনে আসছেন লবণ চাষিরা।

গোমাতলীর রাজঘাট এলাকার লবণ ব্যবসায়ী দেলোয়ার হোসেন (৪৫) বলেন, উপকূলের অধিকাংশ পরিবার লবণ উৎপাদন, পরিবহনসহ নানাভাবে জীবিকা নির্বাহ করেন। লবণ উৎপাদনের সম্পৃক্তরা বাপ-দাদার পেশা হিসেবে এটি আঁকড়ে ধরে রয়েছেন। লবণে ক্ষতি হলেও বর্ষায় মৎস্য চাষে যুক্ত হয়ে কোনো মতে সংসার চালান। ফলে, ঘাটতি মেটানোর আশায় পরের বছর আবার লবণ চাষে নামেন। এভাবে ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে আছে দেশের স্বয়ং সম্পন্ন লবণ শিল্পে সম্পৃক্তরা।

Advertisement

আরেক লবণ ব্যবসায়ী বেলাল উদ্দিন বলেন, আগে উপকূলের ৮০ শতাংশ মানুষ লবণের উপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করলেও ক্রমাগত লোকসানে অনেকে পেশা ছেড়েছেন। এভাবে চলতে থাকলে লবণ শিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে। আর লবণও পরিণত হবে আমদানি নির্ভর পণ্যে।

কক্সবাজারের উপকূলীয় উত্তর গোমাতলীর রমজান আলী (৪০), সিরাজুল ইসলাম (৩৮), মো. কামাল (৩০) ও জামাল উদ্দিন (৩২) এখন চট্টগ্রামের গার্মেন্টেসে কাজ করেন। তাদের পাশাপাশি আরও অর্ধশত পরিবারের লোকজন লবণ চাষ পেশা ছেড়ে গার্মেন্টস ও যানবাহন চালনার পেশায় সম্পৃক্ত বলে জানান তারা। ক্রমতাগত ক্ষতির মুখে পড়ে লবণ চাষ ছেড়ে যারা চট্টগ্রাম, কক্সবাজারসহ নানা জায়গায় গেছেন, আবার ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত হলে লবণ চাষে ফিরবেন বলে জানান তারা।

বাংলাদেশ লবণচাষি সমিতির সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম বলেন, মাঠ থেকে লবণ কেনায় জড়িত ব্যবসায়ীরা একীভূত হয়ে লবণের দাম নির্ধারণ করে। সরকারি নির্দেশনায় উৎপাদিত লবণ বিক্রি করতে না পেরে লোকসানে পতিত হন প্রান্তিক চাষি বা লবণ উৎপাদকরা। এছাড়াও, দেশে উৎপাদিত লবণ চাহিদা মিটিয়ে উদ্বৃত্ত থাকার পরও একটি মহল বিদেশ থেকে লবণ আমদানির চেষ্ঠা করছে। এতে মাঠ পর্যায়ে পড়ে থাকা লবণ নিয়ে বিপাকে রয়েছেন প্রান্তিক চাষিরা।

বাংলাদেশ লবণ মিল মালিক সমিতির সহ-সভাপতি আবদুল কাদের মাস্টার বলেন, ২০২১ সালে দেশে লবণের চাহিদা ছিল ২২ লাখ মেট্রিক টন। কিন্তু উৎপাদন হয়েছে ১৭ লাখ মেট্রিক টন। এ সুযোগে ইন্ডাস্ট্রিয়াল লবণের কথা বলে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলো সোডিয়াম সালফেক্ট এনে তা খাবার লবণ হিসেবে বাজারজাত করছে। প্রান্তিক লবণের চেয়ে এ লবণ সাদা হওয়ায় ভোক্তারা সেটিই লুফে নেয় এবং শারীরিকভাবে ক্ষতির মুখে পড়ে। এ কারণে আমাদের দাবি, খাবার লবণ সংকট থাকলে বৈধ পন্থায় আমদানির অনুমোতি দেয়া হউক। সরকারি ট্যাক্স দিয়ে লবণ আমদানি হলে কেজিপ্রতি দাম পড়বে সাড়ে ছয় টাকা। ৭-৮ টাকায় প্রান্তিক চাষি থেকে লবণ কিনলে সেটা আয়োডাইজ করে ১৩-১৫ টাকায় সরবরাহ করা সম্ভব। এতে দেশের একমাত্র স্বয়ংসম্পন্ন লবণ শিল্প মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে।

Advertisement

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক) কক্সবাজার জেলা ম্যানেজার (ডিএম) জাফর ইকবাল জানান, দেশে ২০২১ সালে লবণের চাহিদা নির্ধারণ হয় ২২ লাখ ১৭ হাজার মেট্রিক টন। ২০২১ মৌসুমে লবণ উৎপাদন হয়েছে ১৬ লাখ ৫১ হাজার মেট্রিক টন। তবে, ২০২০ সালে তিন লাখ ৪৮ লাখ মেট্রিক টন লবণ উদ্বৃত্ত ছিল। সে হিসেবে ২০২১ সালের লবণের মজুদ ১৯ লাখ ৯৯ হাজার মেট্রিক টন। কাগজে কলমে দুই লাখ মেট্রিক টন লবণ ঘাটতি রয়েছে। কিন্তু নিয়মিত ব্যবহারে পর গত ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মাঠ পর্যায়ে সাড়ে চার লাখ, মিল-কারখানায় দেড় লাখ এবং বিভিন্ন খুচরা মজুতদারের কাছে জমা অন্তত এক লাখ মেট্রিক টন মিলে প্রায় সাত লাখ মেট্রিক টন লবণ মজুত আছে। মাসে পৌনে দুই লাখ মেট্রিক টন চাহিদা মতে ডিসেম্বর পর্যন্ত লবণ দরকার হবে সাড়ে পাঁচ লাখ মেট্রিক টন। নভেম্বরে শুরু হবে নতুন লবণ উৎপাদন মৌসুম। তাই দেশে লবণের কার্যত সংকট নেই। আর সোডিয়াম সালফেক্ট বা অন্য যেকোনো লবণ আমদানিতে সরকার আগের তুলনায় তিনগুণ কর বাড়িয়েছে। এখন আগের মতো এসব লবণ আনার প্রচেষ্টা সফল হবে না।

সায়ীদ আলমগীর/এএইচ/জিকেএস