ধর্ম

উম্মতের জন্য নবিজীর ভালোবাসা কেমন ছিল?

দরদি নবি, মায়ার নবি হিসেবে মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তুলনাহীন। উম্মতের প্রতি প্রিয় নবির ভালোবাসা পরিমাপ করে শেষ করা যাবে না। যে কারণে মহান আল্লাহ এভাবে আয়াত নাজিল করেছেন-

Advertisement

لَقَدۡ جَآءَکُمۡ رَسُوۡلٌ مِّنۡ اَنۡفُسِکُمۡ عَزِیۡزٌ عَلَیۡهِ مَا عَنِتُّمۡ حَرِیۡصٌ عَلَیۡکُمۡ بِالۡمُؤۡمِنِیۡنَ رَءُوۡفٌ رَّحِیۡمٌ

নিশ্চয়ই তোমাদের নিজেদের মধ্য থেকে তোমাদের কাছে একজন রাসুল এসেছেন; (তোমাদের জন্য তাঁর মায়া এতইবেশি যে) তোমাদেরকে যা কিছু কষ্ট দেয় তা তার কাছে খুবই কষ্টদায়ক। তিনি তোমাদের কল্যাণকামী, মুমিনদের প্রতি স্নেহশীল, পরম দয়ালু।’ (সুরা তাওবা : আয়াত ১২৮)

এ আয়াত থেকে প্রমাণিত, প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মানুষের জন্য কতবেশি দরদি ছিলেন। কেউ কোনো বিষয়ে কষ্ট পেলেই তিনি কষ্ট অনুভব করতেন। আয়াতের ব্যাখ্যায় এসেছে-

Advertisement

‘আল্লাহ তাআলা মুমিনদের উপর তার ইহসান তথা দয়া-মায়া ও ভালোবাসার কিছু বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি বলেন, আমি তোমাদের মধ্যে তোমাদেরই সমগোত্রীয় এবং তোমাদেরই সমভাষার লোককে (রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে)  প্রেরণ করেছেন।’ (ইবনে কাসির)

কোরআনের এ আয়াতটি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে হজরত জাফর ইবন আবি তালিব রাদিয়াল্লাহু আনহু বাদশাহ নাজ্জাসীর দরবারে বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন-

‘আল্লাহ তাআলা আমাদের মধ্যে আমাদেরই একজনকে রাসুলরূপে পাঠিয়েছেন যাকে আমরা চিনি, তার বংশ ও গুণাগুণ সম্পর্কেও আমরা অবহিত। তার ভেতর ও বাহির সম্পর্কে, সত্যবাদিতা, আমানতদারী সম্পর্কেও আমরা জানি।’ (মুসনাদে আহমাদ)

তিনি আরও বলেছেন, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সব সৃষ্টির উপর (শ্রেষ্ঠ ও মর্যাদাবান) বিশেষত মুমিনদের উপর বড় দয়াবান ও স্নেহশীল।’

Advertisement

উম্মতের প্রতি নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ভালোবাসা ছিল অগাধ। সব সময় তাঁর আওয়াজই ছিল- ‘উম্মাতি, উম্মাতি। সব সময় তিনি উম্মতের গুনাহ মাফে ক্ষমা প্রার্থনা করতেন। উম্মতের ভালোবাসার নমুনা ওঠে এসেছে হাদিসের একাধিক বর্ণনায়। তাহলো-

১. প্রত্যেক নামাজে উম্মতের জন্য দোয়া করতেন বিশ্বনবি

 হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেন, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অন্তর প্রসন্ন দেখলে আমি বলতাম- হে আল্লাহর রাসুল! আপনি আমার জন্য দোয়া করুন।’ তিনি বলতেন- ‘হে আল্লাহ! আপনি আয়েশার আগের ও পরের, গোপন ও প্রকাশ্যের সব গুনাহ ক্ষমা করুন।’

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দোয়া শুনে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা হেসে নিজের কোলে মাথা নিচু করে ফেলতেন। তাঁর হাসিমাখা মুখ দেখে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলতেন-

‘আমার দোয়াতে কি তুমি আনন্দিত হয়েছ?’

হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলতেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! এটা কেমন কথা, আপনার দোয়ায় আমি আনন্দিত হব না?’

তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলতেন, ‘আল্লাহর শপথ, এভাবেই আমি প্রত্যেক নামাজের পর আমার উম্মতের জন্য আমি দোয়া করি।’ (ইবনে হিব্বান)

২. মানুষকে বাঁচানোর চিন্তা

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মতের ক্ষতি হবে এমন সব বিষয়ের ব্যাপারে খুব বেশি চিন্তা করতেন। উম্মতকে ক্ষতি থেকে বাঁচাতে তিনি সব সময় আমল-উপদেশসহ সমস্যা সমাধানের চিন্তা-ভাবনায় নিয়োজিত থাকতেন। আপনজন কিংবা সম্মানিত কোনো ব্যক্তি ঈমান না আনলে তাঁর চিন্তা-পেরেশানি আরও বেড়ে যেত। মহান আল্লাহ এ ব্যাপারে আয়াত নাজিল করেছেন এভাবে-

‘ওই সব লোক ঈমান আনছে না, এ কারণে কি তাদের চিন্তায় ও পেরেশানিতে আপনি নিজেকে শেষ করে দেবেন।’ (সুরা শুআরা : আয়াত ৩)

৩. উম্মতের প্রতি বিশ্বনবির ভালোবাসা

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি  ওয়া সাল্লাম উম্মতের প্রতি বিশেষ দয়াশীল ছিলেন। এমনকি তাঁর জীবদ্দশায় যেসব উম্মতের জন্ম হয়নি অর্থাৎ অনাগত উম্মত; তাদের প্রতিও ছিল বিশ্বনবির অগাধ ভালেবাাসা। কেননা তারা না দেখেই বিশ্বনবির রেসালাতের স্বীকৃতি দেবে। হাদিসে এসেছে-

হজরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আমার ভাইদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে ইচ্ছা করছে। সাহাবিরা বললেন, আমরা কি আপনার ভাই নই? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তোমরা তো আমার সাহাবি তথা সঙ্গি। আমার ভাই হলো, যারা আমার ওপর ঈমান আনবে, কিন্তু আমাকে দেখবে না।’ (মুসনাদে আহমাদ)

৪. উম্মতের জন্য বিশ্বনবির চাওয়া

হজরত আবদুল্লাহ বিন আমর বিন আস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইবরাহিম আলাইহিস সালামের কথা তেলাওয়াত করলেন-

رَبِّ اِنَّهُنَّ اَضۡلَلۡنَ کَثِیۡرًا مِّنَ النَّاسِ ۚ فَمَنۡ تَبِعَنِیۡ فَاِنَّهٗ مِنِّیۡ ۚ وَ مَنۡ عَصَانِیۡ فَاِنَّکَ غَفُوۡرٌ رَّحِیۡمٌ

হে আমার রব! তারা (এসব প্রতিমা) বহু মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে। সুতরাং যে আমার অনুসরণ করবে সে আমার দলভুক্ত, কিন্তু কেউ আমার অবাধ্য হলে (তাদের ব্যাপারেও) তুমি তো চরম ক্ষমাশীল পরম দয়ালু।’ (সুরা ইবরাহিম : আয়াত ৩৬)

اِنۡ تُعَذِّبۡهُمۡ فَاِنَّهُمۡ عِبَادُکَ ۚ وَ اِنۡ تَغۡفِرۡ لَهُمۡ فَاِنَّکَ اَنۡتَ الۡعَزِیۡزُ الۡحَکِیۡمُ

‘তুমি যদি তাদেরকে শাস্তি দাও, তবে তারা তোমারই বান্দা। আর যদি তাদেরকে ক্ষমা কর, তবে তুমি তো পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়।’ (সুরা মায়েদা : আয়াত ১১৮)

এরপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুই হাত তুলে বলেন-

 ‘হে আল্লাহ, আমার উম্মত! আমার উম্মত!’

আল্লাহ তাআলা বললেন, ‘হে জিবরিল! মুহাম্মদের কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করুন- আপনি কাঁদছেন কেন?’ মহান আল্লাহ সব কিছুই অবগত আছেন। জিবরাইল আলাইহিস সালাম এসে জিজ্ঞাসা করলো।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে নিজের কথা বললেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে জিবরিল! তুমি মুহাম্মদের কাছে গিয়ে বলো, আমি শিগগির আপনার উম্মতের ব্যাপারে আপনাকে সন্তুষ্ট করব এবং আমি আপনাকে কষ্ট দেব না।’ (মুসলিম)

৫. উম্মতের জন্য বিশ্বনবির কোরবানি

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মতের জন্য আল্লাহর সন্তুষ্টি পেতে আলাদা পশু কোরবানি করতেন। এ ছিল উম্মতের জন্য রাসুলুল্লাহর ভালোবাসা। হাদিসে এসেছে-

হজরত আবু রাফে রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোরবানির সময় দুইটি মোটা-তাজা শিংবিশিষ্ট দুম্বা ক্রয় করতেন। নামাজ আদায় করে খুতবা দিতেন। এরপর তিনি নামাজের স্থানে দাঁড়িয়ে থাকতেই একটি দুম্বা নিয়ে আসা হতো। তা তিনি নিজ হাতে কোরবানি করতেন আর বলতেন-

‘হে আল্লাহ! এটা আমার পুরো উম্মতের পক্ষ থেকে, যারা আপনার তাওহিদের সাক্ষ্য দিয়েছে এবং আমার রেসালাত পৌঁছে দেওয়ার সাক্ষ্য দিয়েছে।’ (মুসনাদে আহমাদ)

৬.অন্যান্য আমলে উম্মতের প্রতি ভালোবাসা

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মতের প্রতি ভালোবাসা থেকেই বারবার গিয়ে ৫০ ওয়াক্ত নামাজকে ৫ ওয়াক্তে নির্ধারণে সুপারিশ ও বাস্তবায়ন করেছেন।

আল্লাহর কাছে পছন্দনীয় আমল মেওয়াক করাকে বাধ্যতামূলক করেননি। বরং সুন্নাত আমলে রেখেছেন; কারণ বাধ্যতামুলক করলে এসব আমল পালন না করলেই গুনাহগার হতে হতো।

ইসলামের জন্য যুদ্ধে অংশগ্রহণের অধিক ফজিলত থাকা সত্ত্বেও উম্মতের প্রতি ইহসান করতেই তিনি সব যুগ্ধে অংশগ্রহণ করেননি। যদি তিনি সব যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতেন হয়তো তা উম্মতের জন্য ফরজ হয়ে যেতো। তিনি সব সময় উম্মতের কষ্ট কমানোর জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করেছেন।

এ কারণেই কোরআনের একাধিক আয়াতে উম্মতের প্রতি প্রিয় নবির ভালোবাসার কথা ওঠে এসেছে-

১. لَقَدۡ جَآءَکُمۡ رَسُوۡلٌ مِّنۡ اَنۡفُسِکُمۡ عَزِیۡزٌ عَلَیۡهِ مَا عَنِتُّمۡ حَرِیۡصٌ عَلَیۡکُمۡ بِالۡمُؤۡمِنِیۡنَ رَءُوۡفٌ رَّحِیۡمٌ

নিশ্চয়ই তোমাদের নিজদের মধ্য থেকে তোমাদের কাছে একজন রাসুল এসেছেন; (তোমাদের জন্য তাঁর মায়া এতইবেশি যে) তোমাদেরকে যা কিছু কষ্ট দেয় তা তার কাছে খুবই কষ্টদায়ক। তিনি তোমাদের কল্যাণকামী, মুমিনদের প্রতি স্নেহশীল, পরম দয়ালু।’ (সুরা তাওবা : আয়াত ১২৮)

২. اَلنَّبِیُّ اَوۡلٰی بِالۡمُؤۡمِنِیۡنَ مِنۡ اَنۡفُسِهِمۡ وَ اَزۡوَاجُهٗۤ اُمَّهٰتُهُمۡ ؕ وَ اُولُوا الۡاَرۡحَامِ بَعۡضُهُمۡ اَوۡلٰی بِبَعۡضٍ فِیۡ کِتٰبِ اللّٰهِ مِنَ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ وَ الۡمُهٰجِرِیۡنَ اِلَّاۤ اَنۡ تَفۡعَلُوۡۤا اِلٰۤی اَوۡلِیٰٓئِکُمۡ مَّعۡرُوۡفًا ؕ کَانَ ذٰلِکَ فِی الۡکِتٰبِ مَسۡطُوۡرًا

নবি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিশ্বাসীদের কাছে তাদের প্রাণ অপেক্ষাও অধিক প্রিয় এবং তার স্ত্রীগণ তাদের মা-স্বরূপ। আল্লাহর বিধান অনুসারে বিশ্বাসী ও মুহাজিরগণ অপেক্ষা যারা আত্মীয় তারাই পরস্পরের খুবই কাছাকাছি।] তবে তোমরা যদি তোমাদের বন্ধু-বান্ধবদের প্রতি দাক্ষিণ্য প্রদর্শন করতে চাও (তাহলে তা করতে পার)। এ কথা গ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে।’ (সুরা আহজাব : আয়াত ৬)

সুতরাং মুমিন মুসলমানের উচিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শ ও হুকুম-আহকাম বাস্তবায়নের মাধ্যমে এ ভালোবাসার প্রতিদান দেওয়া। কোরআন-সুন্নাহর উপর আমল করা। রাসুলের ভালোবাসা অর্জন করা।

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শ অনুসরণ ও অনুকরণ করে সঠিক আশেকে রাসুল হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।

এমএমএস/জেআইএম