শিবু দাশ সুমিত ৩৮তম বিসিএসের প্রশাসন ক্যাডারে উত্তীর্ণ হন। চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় তার পৈতৃক বাড়ি। বেড়ে ওঠা রাঙ্গামাটির বিলাইছড়িতে। প্রাথমিকের পাঠ চুকিয়ে বাকি সময়ের জন্য চট্টগ্রামের চকবাজার ছিল দ্বিতীয় নিবাস। তার বাবা একজন ব্যবসায়ী এবং মা জীবনের পুরোটা সময় পরিবারের জন্য বিসর্জন দিয়েছেন। ২০০৫ সালে চট্টগ্রাম পুলিশ ইনস্টিটিউশন থেকে এসএসসি এবং ২০০৭ সালে হাজেরা তজু বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টর অব ভেটেরিনারি মেডিসিনে স্নাতক ও অ্যানিমেল অ্যান্ড পোল্ট্রি নিউট্রিশনে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন।
Advertisement
বর্তমানে তিনি নড়াইল জেলা প্রসাশনের কার্যালয়ে সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কর্মরত। সম্প্রতি তার বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া, ভবিষ্যৎ স্বপ্ন ও সফলতার গল্প শুনিয়েছেন জাগো নিউজকে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আনিসুল ইসলাম নাঈম—
জাগো নিউজ: আপনার শৈশবের স্মৃতি জানতে চাই— শিবু দাশ সুমিত: ছোটবেলা কেটেছে রাঙ্গামাটির অসম্ভব সুন্দর পাহাড়ি ছায়াঘেরা ছোট্ট গ্রামে। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত কেটেছে সেখানেই। সে সময় খুব দুষ্টু প্রকৃতির ছিলাম। ছোট-বড় সবাইকে প্রচণ্ড জ্বালিয়েছি। আমার স্কুলটি পাহাড়ের উপরে থাকায় প্রতিদিন ছুটির পরে পাহাড় থেকে নিচে নেমে আসার দৌড় প্রতিযোগিতার সেই স্মৃতি আজও মনে পড়ে। স্কুলের পাশেই বিরাট আম গাছ ছিল। শ্রেণিকক্ষে পড়ালেখা করার চাইতে সেই গাছের নিচে বসে থাকতে বেশি ভালো লাগতো। আমি খুব ভাগ্যবান, আমার বন্ধু-বান্ধব সবাই খুব মিশুক আর সহযোগী মনোভাবাপন্ন ছিল। তাই হয়তো আমি আজকের এই আমি হয়ে উঠতে পেরেছি। নতুন কিছু শেখা আর জানার ক্ষেত্রে তাদের সবাই ছিল বেশ উদার। ট্রাভেল ব্যাগে কাপড় বা অন্যান্য টুকিটাকি জিনিস নিয়ে ছুটতাম পাহাড়, সমুদ্র কিংবা অজানা কোনো গন্তব্যে।
জাগো নিউজ: পড়াশোনায় কোনো প্রতিবন্ধকতা ছিল কি?শিবু দাশ সুমিত: ছোটবেলা থেকেই যা চাইতাম সব কিছুই হাতের কাছে পেতাম। সেই অর্থে বলা যায়, আমি সারাজীবন পরিবারের কাছ থেকে শতভাগ সমর্থন পেয়ে এসেছি। সেটি অর্থনৈতিক বা মানসিক যা-ই হোক না কেন। এমনকি চাকরি করার পরও এখনো মায়ের কাছ থেকে সুযোগ পেলে পকেট খরচ নিই।
Advertisement
জাগো নিউজ: বিসিএসের স্বপ্ন দেখেছিলেন কখন থেকে?শিবু দাশ সুমিত: স্বপ্ন দেখতে তো আসলে কোনো বাঁধা নেই। ‘মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়’—কথাটি খুবই বিশ্বাস করি। ক্ষণে ক্ষণে যদিও আমাদের স্বপ্ন পরিবর্তন হয়। একদম ছোটবেলায় ভাবতাম, বড় হয়ে ড্রাইভার হবো। তাহলে ইচ্ছেমতো গাড়িতে চড়তে পারবো। এরপর একটু বড় বেলায় ভাবলাম, পাইলট হবো। একটি পর্যায়ে বিসিএসের ট্র্যাকে পা মাড়ানো। ইচ্ছে ছিল মানুষের জন্য তথা দেশের জন্য কাজ করার। সে পথ অনুসরণ করেই অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ক্যাডারে আসা।
জাগো নিউজ: বিসিএস যাত্রার গল্প শুনতে চাই, কিভাবে প্রস্তুতি নিয়েছিলেন?শিবু দাশ সুমিত: আপনার প্রস্তুতি কেমন এর উপরই বেসিক্যালি ডিপেন্ড করে আপনি কি পজিটিভ না নেগেটিভ রেজাল্ট পাবেন। প্রথম বিসিএসেই আমি এর জবাব পেয়ে গিয়েছিলাম। তবে ৩৮তম বিসিএসে প্রস্তুতির শুরুতেই জব সল্যুশনের প্রিভিয়াস প্রশ্ন অ্যানালাইসিস করেছিলাম। ফলে কোন বিষয়গুলো বেশি গুরুত্বপূর্ণ, কোনটা বাদ দেওয়া প্রয়োজন, কোনগুলো থেকে বারবার প্রশ্ন আসছিল—এসব নিয়ে একটা ভালো ধারণা পেয়েছিলাম। যে বিষয়গুলোয় ঘাটতি ছিল; সেগুলো রিকভার করতে ট্রাই করতাম। মূল বইয়ের সঙ্গে সাপ্লিমেন্টারি বই সংগ্রহ করি। প্রথমদিকে সিলেবাসের বিশালতা দেখে একটু বিমর্ষ হই। কিছু কিছু বিষয়বস্তুর সাথে পরিচিত হতে সময় লেগেছিল এবং জড়তা কাজ করছিল। এরপর দাগিয়ে দাগিয়ে মূল বই, সহায়ক বই ও সংবাদপত্র-সাময়িকী পড়া শুরু করি। বাংলা, ইংরেজি সাহিত্য, মুক্তিযুদ্ধ, সংবিধান, মানচিত্র, ম্যাথ ও বিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য নোট করে রাখতাম এবং সময় সময় সেগুলোয় চোখ রাখতাম। তবে ইংলিশ, বিজ্ঞান এবং ম্যাথে নিয়মিত সময় দিয়েছি।
জাগো নিউজ: ৩৮তম বিসিএসে সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে সুপারিশপ্রাপ্ত হওয়ার খবর জানার পর কেমন অনুভূতি ছিল?শিবু দাশ সুমিত: আমার মনে হয়েছে, জীবনের সেরা অনুভূতিগুলোর মধ্যে সেই মুহূর্তটি ছিল বেশ অনন্য। অনেক আবেগ, চাওয়া-পাওয়া আর উৎকণ্ঠার অবসান হয়েছিল সেই দিনটিতে। সময়টা ছিল মঙ্গলবার, ৩০ জুন, সন্ধ্যার কাছাকাছি কোনো এক মুহূর্ত। রেজাল্ট শিটে যখন নিজের রোল দেখছিলাম; তখন প্রচণ্ড উত্তেজনা আর অনিশ্চয়তা কাজ করছিল। রোল খুঁজে পাওয়ার পর বেশ কিছু সময় স্থির হয়ে বারবার নিজের রোল ঠিক আছে কি না তাই দেখছিলাম। পরে ছোট ভাইকে বললাম ওয়েবসাইট থেকে আবার রেজাল্ট শিটের পিডিএফ নামাতে। রোল খুঁজে পাওয়ার পর সে বলল, বিসিএস প্রশাসনে রোল আছে। আমি সেই মুহূর্তের আমাকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। তাকে পুনরায় দেখতে বললাম। সে নিশ্চিত করল প্রশাসন ক্যাডারেই সুপারিশপ্রাপ্ত। সবকিছু মিলিয়ে সেদিনের সেই সন্ধ্যা ছিল এক প্রবল উচ্ছ্বাস আর আনন্দের সাক্ষী। জাগো নিউজ: পর্দার আড়াল থেকে কেউ অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে? কাকে বেশি মনে পড়ে? শিবু দাশ সুমিত: মা সব সময় সাহস জুগিয়ে গেছেন। আমার প্রস্তুতির প্রতিটি মুহূর্তেই তিনি পাশে থেকেছেন নীরবেই। জুগিয়েছেন নিরন্তর সাহস-অনুপ্রেরণা। কোনো কিছুর পেছনে লেগে থাকার অদম্য ইচ্ছাটুকু তার কাছ থেকেই পাওয়া বলা যায়। সচরাচর দেখা যায়, যখন আপনি কোনো কিছুর জন্য চেষ্টা করছেন; তখন আপনার পরিবারের চেয়ে অন্য আত্মীয়-স্বজনের চিন্তাটা বেশি বেড়ে যায়। মূলত তাদের চিন্তাটি পজিটিভ অর্থে হয় না তেমন একটা। তখন ফ্যামিলির সাপোর্টটা অনেক জরুরি। সে সময়গুলোয় আমি যে সাপোর্ট পেয়েছি, সেটা শুধু মায়ের জন্য সম্ভব হয়েছে। লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে তিনি শুধু আমাকে সমৃদ্ধই করে গেছেন।
জাগো নিউজ: বর্তমানে বিসিএস নিয়ে ব্যাপক উদ্দীপনা দেখা যায়। এমনকি কেউ কেউ বিসিএসকে জীবনের একমাত্র লক্ষ্য মনে করেন। এমনটা কি হওয়া উচিত?শিবু দাশ সুমিত: এটি বলার অপেক্ষা রাখে না, বিসিএস একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত নয়। এতে যদি সফলতা না আসে তবে মাঝেমধ্যে ডিপ্রেশন কাজ করতে পারে এবং এটিই বেকার অবস্থায় ভয়ানক সমস্যার সৃষ্টি করে। পরিসংখ্যান বলছে, গত ৪১তম বিসিএসে প্রায় চার লক্ষাধিক শিক্ষার্থী আবেদন করেছেন। কিন্তু পিএসসি মাত্র ২১ হাজারের একটু বেশি শিক্ষার্থীকে লিখিত পরীক্ষার জন্য বাছাই করেছে। শুধু বিসিএস ওরিয়েন্টেড হওয়ায় শিক্ষার্থীদের মাঝে হতাশার চিত্র হরহামেশাই ভয়ংকরভাবে বাড়ছে। এক অসুস্থ প্রতিযোগিতার দৌড় চলছে প্রতিনিয়ত। দিন শেষে বিসিএস প্রথম শ্রেণির একটি চাকরি মাত্র। জীবন সহজ, একে সহজ ভাবেই মেনে নিন। শুধু বিসিএসের চিন্তায় থেকে জীবনের অনেক সময় অযথাই হারিয়ে ফেলছি আমরা। বাড়ছে জীবনের সাথে সময়ের দূরত্ব। তাই বিসিএসের পাশাপাশি অন্য জবের চেষ্টাও করা উচিত।
Advertisement
জাগো নিউজ: নতুন যারা বিসিএসে আসতে চান, তাদের জন্য কী পরামর্শ থাকবে?শিবু দাশ সুমিত: নতুনদের জন্য পরামর্শ হতে পারে, কোন বিষয়টি রিডিং পড়ে মনে রাখবেন, কোন বিষয়টি নোট করবেন আর কোনটি বাদ দেবেন; সেটা নিজে নিজে অধ্যয়ন করে বের করুন। নিয়মিত অনুশীলন সফলতার চাবিকাঠি। পড়ার মাঝে যেন গ্যাপ না আসে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। প্রস্তুতির এ সময়ে অনেক হতাশা কাজ করতে পারে। মনে রাখতে হবে, আপনার জন্য যা মঙ্গল, সৃষ্টিকর্তা সেটাই আপনাকে দেবেন। কিন্তু প্রস্তুতিতে কোনো অবহেলা করা যাবে না। আপনার সামর্থের ওপর ভিত্তি করে দৈনিক নির্ধারিত প্ল্যান করুন এবং যত কষ্টই হোক না কেন প্রতিদিনের পড়া প্রতিদিন শেষ করুন। পরিমিত চেষ্টা করুন আর ভরসা রাখুন আপনার প্রতিপালকের উপর। পাশাপাশি নিয়মিত পড়াশোনা, পরিবারকে সময় দেওয়া, তথ্যনির্ভর ইতিবাচক কাজে ফেসবুক ব্যবহার করা, নিয়মিত শরীরচর্চা এবং ধর্মচর্চায় মন দিন। দিনশেষে শেষ হাসিটা আপনিই হাসবেন।
জাগো নিউজ: আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?শিবু দাশ সুমিত: দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে অবদান রেখে বাংলাদেশকে ২০৪১ সালে উন্নত, সমৃদ্ধশালী ও জ্ঞানভিত্তিক দেশে পরিণত করতে সম্পৃক্ত থাকা। পাশাপাশি আমার একটি পাঠাগার থাকবে, যেখানে ঠাঁই পাবে অসংখ্য বই, ম্যাগাজিন, আর্টিকেলসহ নানা উপকরণ। সেখান থেকে মানুষ অনায়াসে জ্ঞান আহরণ করে নিজেকে সমৃদ্ধ করতে পারবে।
জাগো নিউজ: করোনা দুর্যোগে আপনার ভূমিকা কী?শিবু দাশ সুমিত: করোনার মধ্যেই আমাদের মাঠ প্রশাসনে জয়েন করতে হয়। এ সময়টাতে সরাসরি জনগণের সান্নিধ্যে থেকে মাঠে কাজ করাটা বাস্তবিক অর্থেই বেশ চ্যালেঞ্জিং বলা যায়। সদাশয় সরকার আরোপিত বিভিন্ন বিধিনিষেধ আরোপ করতে গিয়ে মাঝেমাঝেই অনেক বেগ পেতে হয়। এছাড়া এ সময়ে জেলা প্রশাসন থেকে প্রতিদিনই ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম পরিচালিত হয়, খোলাবাজারে ন্যায্য মূল্যে বিভিন্ন জিনিস বিক্রি কার্যক্রম তদারকি, মোবাইল কোর্ট পরিচালনাসহ বিভিন্ন কাজ সরাসরি তদারক করতে হয়। জেলা প্রশাসক স্যারের সঙ্গে উন্নয়ন বিষয়ক বিভিন্ন প্রকল্প পরিদর্শন, আশ্রয়নের ঘর নির্মাণ পরিদর্শনসহ বহুবিধ জনসম্পৃক্ত কাজে ব্যস্ত সময় পার করতে হয়েছে। বলতে পারেন, কাজের অনেক ভ্যারিয়েশন আছে। তাই চ্যালেঞ্জটাও আসলে বহুমুখী।
এসইউ/জিকেএস