বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের কোনো ঘটনা ঘটলে, আরও পরিষ্কারভাবে বললে হিন্দুদের উপর মুসলমানদের অত্যাচার নেমে এলে শামসুর রাহমানের ‘সুধাংশু যাবে না’ কবিতাটি অনেকে আলোচনায় আনেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় এটিকে পোস্ট করা হয় হিন্দুদেরকে মানসিক সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য, তাদের দুঃখে সংহতি প্রকাশের জন্য। বাংলাদেশে নব্বইর দশকের শুরুতে ভারতের বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর এখানকার হিন্দুদের মানবাধিকার লঙ্ঘন ও তাদের দেশত্যাগের প্রেক্ষাপটে সম্ভবত শামসুর রাহমান এই কবিতাটি লিখেছিলেন। আমি তার পুরোটা তুলে দিচ্ছি। বলে রাখি যে, এর কয়েকটি বিকৃত ভার্সনও ইন্টারনেটে ঘুরছে।
Advertisement
সুধাংশু যাবে না-শামসুর রাহমান
লুণ্ঠিত মন্দির, আর অগ্নিদগ্ধ বাস্তুভিটা থেকেএকটি বিবাগী স্বর সুধাংশুকে ছুঁলো‘আখেরে কি তুলি চলে যাবে?’ বেলা শেষেসুধাংশু ভস্মের মাঝে খুঁজে বেড়ায় দলিল, ভাঙা চুড়ি, সিঁদুরের স্তব্ধ কৌটা,স্মৃতির বিক্ষিপ্ত পুঁতিমালা।
স্বর বলে, ‘লুটেরা তোমাকে জব্দ ক’রেফেলে আশে পাশেতোমার জীবনে নিত্যদিন লেপ্টে থাকেপশুর চেহারাসহ ঘাতকের ছায়া,আতঙ্কের বাদুড় পাখার নিচে কাটাচ্ছ প্রহর,তবু তুমি যেও না সুধাংশু।’
Advertisement
আকাশের নীলিমা এখনোহয়নি ফেরারি, শুদ্ধাচারী গাছপালাআজও সবুজেরপতাকা ওড়ায়, ভরা নদীকোমর বাঁকায় তন্বী বেদিনীর মতো।এ পবিত্র মাটি ছেড়ে কখনো কোথাওপরাজিত সৈনিকের মতোসুধাংশু যাবে না।
২.আমি প্রশ্ন করতে চাই কিছু হলেই সুধাংশুদের যাওয়ার প্রশ্ন আসবে কেন? সুধাংশু কেন যাবে, তাকে যাওয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয় কেন! বাংলাদেশ তার জন্মস্থান, এখানে তার ভিটে মাটি। বাবা, মা, বোন, খেলার সাথীরা, প্রিয় বন্ধুরা বসবাস করে। আমারতো বলা উচিত সুধাংশু তুমি প্রতিরোধ করো। রুখে দাঁড়াও হিংস্রতার বিরুদ্ধে।
ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে তুমি বিপ্লবীপনা করো না, প্ররোচনায় পড়ে নিজেই আবার হিংসার জন্ম দিও না। ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ করো ইসলামী জঙ্গিদের। প্রয়োজনে আমাকে ডাক, আমি তোমার পাশে আছি। ছিলাম। এমন কি কখনো হয়েছে আমাকে ডেকে তুমি পাশে পাওনি? তাহলে সেটি স্মরণ করিয়ে দিয়ে উচ্চ কণ্ঠে আমাকে ধিক্কার দাও। যদি তাই করি আমি তোমার বন্ধু নই। আমি তোমার প্রতিবেশি নই। আমি মানুষও নই।
সুধাংশু, তোমার যাওয়ার প্রশ্ন আসে শুধু উন্নত জীবনের আশায়। সে আশায় আমরা সবাই একই পথের পথিক। পথ খুঁজি, উন্নত কোনো দেশে বসতির আশায়। সেখানে তোমার আর আমার ধর্ম কোনো পরিচয় নয়। প্রশ্ন আমাদের উন্নত ভবিষ্যত, নির্মল বাতাসে শ্বাস নেওয়া, আমাদের সন্তানদের জন্য উন্নত একটি জীবন রেখে যাওয়া, এই দম বন্ধ করা রাজনৈতিক পরিবেশ ত্যাগ করা। আমরা যেখানে যেতে চাই যেখানে ধর্ম নিয়ে মানুষের মাথা ব্যাথা নেই, ধর্ম হবে যার যার ব্যক্তিগত বিষয়। তা না হলে তুমি আমি সেখানে যাবো কোন আশায়? কোন দুঃখে আমরা বন্ধুদের, প্রিয় মুখদের ত্যাগ করে নতুন এক সমাজ তৈরি করতে যাব!
Advertisement
বলার অপেক্ষা রাখে না, সুধাংশু, তোমাকে ইঙ্গিত দেওয়া হচ্ছে ভারতে যাওয়ার। নরেদ্র মোদি আইন করে বসে আছে তোমাকে স্বাগত জানাতে। কারণ ‘৪৭-এর দেশভাগের সময় তোমার ধর্মের কিছু লোক, হয়তো তোমার পূর্ব পুরুষ এই অঞ্চল ছেড়ে সেখানে চলে গিয়েছিলেন। গিয়েছিলেন ধর্ম চিন্তায়ও। এরপর আরও অনেক সুধাংশু সেখানে গিয়েছে যখনই এখানে কোনো অশান্তি তাদের উপর নেমে এসেছে। আরও কিছু লোক গিয়েছে ধর্মীয় নৈকট্যের চিন্তায়। ভারত তার মাতৃভূমি না হোক, ধর্মভূমি। ধর্মের ভাইরা সেখানে বেশি আছে। ধর্মের পবিত্র স্থান গয়া-কাশি-মথুরা পড়ে আছে সেখানে। যেমনটা মুসলামনদের পবিত্র ভূমি মক্কা-মদিনা পড়ে আছে সৌদি আরবে। অনেক মুসলমান চিন্তা করে সেখানে শেষ জীবন কাটাতে, পবিত্রভূমিতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে।
যদি যাওয়ার প্রশ্নটা ধর্মীয় বিশ্বাসের না হয়, তাহলে আমি বলবো তুমি যাও, সুধাংশু। তুলি পালাও যেখানে তোমার মন চায়। এই বাংলাদেশের রাস্তায় ট্যাফিক জ্যাম, বাতাসে বিষ, নিত্যপণ্যের বাজারে আগুন, আয়ের সিংহভাগ চলে যায় বাসস্থানের ভাড়ায়। এই সমাজে দুর্নীতিবাজদের আস্ফালন, মূর্খদের কদর ঘরে ঘরে। সুবিচার পাওয়া মানুষের অর্থে কুলায় না, আইনী সহায়তা এখন গরীবের নাগালের বাইরে। চিকিৎসা নিয়ে দুশ্চিন্তা, সন্তানের শিক্ষার মান এখানে নিম্নগামী, মানুষ মানুষকে বিবেচনা করে তার মনুষ্যত্ব দিয়ে নয়, টাকা দিয়ে।
তবে তুমি ভুলেও ভারত যেও না, সুধাংশু। সেখানে মানুষের বসবাস আরও অসম্ভব। তার অর্থনীতিতে ধস নেমেছে দেশটি হিন্দুত্ববাদীদের হাতে পড়ায়; মুসলমানদের প্রতি ঘৃণা আর হিন্দুত্ববাদের চাষ করতে গিয়ে। তোমার জন্য আরও কঠিন এক জীবন হবে সেখানে। ধর্ম পরিচয় তোমার সমস্যা হবে না সত্য কিন্তু তোমার জাত পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন আসবে। রিফিউজি পরিচয় তোমাকে সেখানে বেশিদিন স্বস্তি দিবে না।
সেখানে মানুষ মানুষকে হত্যা করে শুধু তার ধর্মীয় বিশ্বাসের জন্য। গুজরাটে তুমি দেখনি কীভাবে তারা পুড়িয়ে, কুপিয়ে মেরেছিল নিরীহ মুসলমানদের? এমনকি মুসলমান বলে কংগ্রেস এমপিকেও বাদ দেয়নি তারা পুড়িয়ে মারতে। দলীয় প্রধান সোনিয়া গান্ধীর কাছে আকুতি জানালে তিনি প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করেও থামাতে পারেনি গুজরাটের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেদ্র মোদির অনুসারীদের। সহায়তা করেনি মোদি প্রশাসন।
সুধাংশু, তুমি কি ২০২০ সালের দিল্লির মুসলমানদের হত্যা করতে দেখনি, যেখানে দাঙ্গার নামে ধরে ধরে মুসলমান মারা হয়েছে। তুমি কি কাশ্মিরে মানবাধিকার লঙ্ঘন দেখ না? তুমি কি অহরহ দেখছো না, সামান্য গরুর মাংস খাওয়ার অপরাধে ভারতে মুসলমান হত্যা- নির্যাতন করা হয়? একটি প্রাণির জীবনের চেয়ে মানুষের জীবন সেখানে নগণ্য। যেখানে তার সনামখ্যাত মুসলমান নাগরিকদের কথায় কথায় পাকিস্তান চলে যেতে বলে, বাংলাদেশে চলে আসতে বলে।
ভারত তার মুসলমান নাগরিকদের নাগরিকত্বহীন করার জন্য সংসদে বিল পাস করে আর হিন্দু বলে তোমাকে সেখানে গেলে নাগরিকত্ব দেওয়ার উস্কানি দেওয়া হয়। সেই নাগরিকত্ব দিয়ে তুমি কী করবে সুধাংশু যেখানে মনুষ্যত্ব নেই, ধর্মীয় হানাহানি থেকে বাঁচতে তোমাকে আমন্ত্রণকারীরা নিজেরাই ধর্মীয় হানাহানি করে? তাদের হানাহানির জের তোমার দেশের সংখ্যালঘুদের উপর প্রভাব ফেলে। তোমার উপর অত্যাচার নেমে আসে বিবেকহীন মানুষের দ্বারা। কুমিল্লার মণ্ডপে হনুমানের কোলে কোরআন রেখে তার গদা নিয়ে চলে যাওয়া ইকবালের সঙ্গে ভারতীয় হিন্দু জঙ্গিদের তুমি কি তফাৎ দেখ, সুধাংশু?
একটা কথাতো তোমাকে স্বীকার করতে হবে- তোমার দেশ বাংলাদেশে ধর্মীয় সংঘাত হয়, রাষ্ট্র নানা কারণে সেটা দমনে ব্যর্থ হয় কিন্তু রাষ্ট্র তোমাকে নির্যাতন করতে নিজেই হানাহানি স্পন্সর করে না। খুনিকে জেল থেকে ছেড়ে দেয় না। সংখ্যালঘুদের কেটে টুকরো করতে বলা রাজনৈতিক নেতাদের নির্বাচনি টিকেট দেয় না, ধর্মীয় সন্ত্রাসী নেতাদের মুক্ত হাওয়ায় ঘুরতে দেয় না- সরকারে যে দলই থাকুক না কেন।
এখানেই ভারতের সঙ্গে আমাদের দেশের পার্থক্য। এখানে ধর্মের আবরণে যা ঘটে তা ক্রিমিনাল অ্যাক্টিভিটি, সরকারকে বিপাকে ফেলার জন্য। তোমার আমার মধ্যে দেয়াল তৈরি করার জন্য। এসব করা হয় তোমাকে নিচু দেখানোর জন্য, তোমার দেবতাকে অপমান করার জন্য- শুধু তোমাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ঘটে না। এখানে তুমি মুসলিম মেয়েকে বিয়ে করলে তোমার জীবন দিতে হয় না। সরকারি চাকরি, উচ্চ পদ তোমার জন্য সোনার হরিণ না।
একটি কথা তুমি মনে রেখ, ভারত যতদিন তোমাকে নিয়ে আলগা পিরিতি দেখাবে সেটা এখানকার সম্প্রীতি নষ্টের কারণ হবে। তোমার আর আমার মধ্যে দেয়াল তৈরির চেষ্টা হবে। পারলে ভারতকে সমস্বরে বলে দাও, বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের কথা চিন্তা না করে নিজের সংখ্যালঘুদের অধিকার এবং জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন। কারণ তাতে তোমার অধিকারও নিশ্চিত হয় পক্ষান্তরে। একটি গভীর সাম্প্রদায়িক বিভাজনের প্রচেষ্টা, জাতিগত নির্মূলকরণ এবং সহিংসতার সংস্কৃতি এই উপমহাদেশ ১৯৪৭ সাল থেকে লালন করছে। আর ভারত তাতে চ্যাম্পিয়ন।
পৃথিবীর সবদেশে সব ধরনের সংখ্যালঘুরা কম বেশি বৈষম্যের শিকার। সুধাংশু, এটা মেনে নাও। তুমি আমি জন্মসূত্রে ধর্ম পেয়েছি। এটাতে আমাদের হাত ছিল না। আমি তোমার মায়ের পেটে জন্ম নিতে পারতাম, তুমি আমার মায়ের পেটে। এটাকে নিয়তি হিসেবেও মেনে নাও। ধর্মই আমাদের সবকিছু নয়। মানবতাই আমাদের ধর্ম হওয়া উচিত। এসো, আমরা মানবধর্মের পক্ষে কাজ করি, নিজের দেশটিকে ধর্ম পরিচয়ের বাইরে সবাই মিলে গড়ে তুলি।
ধর্মীয় সম্প্রীতি গড়ার ক্ষেত্রে সংখ্যাগুরুর গুরু দায়িত্ব আছে, সংখ্যালঘু হিসেবে তুমিও দায়িত্বহীন নও। এসো, আমরা দুজনেই আমাদের দায়িত্ব পালন করি। বিষদাঁত ভেঙে দেই সব ধর্মের ধর্মান্ধ, ধর্মীয় জঙ্গিবাদীদের। আর যদি ইচ্ছে হয় দেশত্যাগের, তুমি যেখানে খুশি যাও, আমাকেও সঙ্গে নিও। তবে ভুলেও ভারত যেও না, সুধাংশু। জাহান্নাম থেকে জাহান্মামে গিয়ে কি সুখ আছে, বলো?
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট। ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত। anisalamgir@gmail.com
এইচআর/এএসএম