সালতামামি

প্রণোদনা সত্ত্বেও শূন্যের খাতায় বিনিয়োগকারীরা

বছরের শুরুতে হরতাল অবরোধসহ রাজনৈতিক সহিংসতা প্রভাব ফেলে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে। ফলে সব সেক্টরের পাশাপাশি শেয়ারবাজারও ছিল অস্থিতিশীল। এছাড়াও অসাধু চক্র সক্রিয় থাকায় বাজারে কৃত্রিমভাবে সংকট সৃষ্টি করারও অভিযোগ রয়েছে। তাই অজানা কারণে বছর শেষেও কাটছে না সংকট।অন্যদিকে, একের পর এক অজুহাতে সরকারকে জিম্মি করে সুযোগ-সুবিধা নিচ্ছে বাজার সংশ্লিষ্টরা। এদিকে বাজারের উন্নয়নের পরিবর্তে দুর্বল কোম্পানির আইপিও (প্রাথমিক শেয়ার) অনুমোদন দিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা। যার কারণে বছরজুড়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং স্টক এক্সচেঞ্জের নানা উদ্যোগ ও প্রণোদনা সত্ত্বেও আস্থাহীনতায় বছর পার করেছে বিনিয়োগকারীরা। তবে দেশের কর্তা ব্যক্তিদের পুঁজিবাজার সম্পর্কে ইতিবাচক ধরণা ও আর্থিক খাতের রেগুলেটর নীতি ও সহায়ক পদক্ষেপে আগামীতে সুফল আসবে বলে দাবি করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।  ১ জানুয়ারি ২০১৫, সূচকের শুভসূচনায় শেয়ারবাজার নতুন বছরের লেনদেন শুরু করলেও বছরের বাকি সময়ে আর তা ধরে রাখতে পারেনি। বছরজুড়ে দরপতনে সর্বশেষ ২০ ডিসেম্বরের হিসেবে ৪০০ পয়েন্টের বেশি সূচক হারায় ডিএসই। এসময় বাজার মূলধন হারিয়েছে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। অপর বাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) সার্বিক সূচক ৬৫৮ পয়েন্ট কমে দাঁড়ায় ৮ হাজার ৩৮৪ পয়েন্টে।     ২০১৫ সাল ছিল শেয়ারবাজারের নানা প্রণোদনার বছর। সরকার, নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং স্টক এক্সচেঞ্জসহ বিভিন্ন মহল থেকে একের পর এক প্রণোদনার জোয়ার ছিল শেয়ারবাজারে। চলতি বছরে সরকারের সব চেয়ে বড় প্রণোদনা আসে ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেটে। বাজেটের উল্লেখযোগ্য সুবিধাগুলো হলো- করমুক্ত লভ্যাংশের আয়ের সীমা বৃদ্ধি, করপোরেট করহার হ্রাস, আইপিওতে ২০ শতাংশ শেয়ার ছাড়ার ক্ষেত্রে কর রেয়াত সুবিধা, মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারেজ হাউসগুলোকে উৎস কর আদায় থেকে অব্যাহতি এবং ব্যাংক, বীমা কোম্পানি ব্যতিরেকে তালিকাভুক্ত কোম্পানি ১৫ শতাংশের কম লভ্যাংশের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ৫ শতাংশ করারোপ।দেশের দুই স্টক এক্সচেঞ্জই বাজেটকে স্বাগত জানায়। এ প্রসঙ্গে দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. স্বপন কুমার বালা বলেন, গত কয়েক বছরের চেয়ে ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেট সবচেয়ে বেশি পুঁজিবাজারবান্ধব। তবে এর সুযোগ নিয়ে কোনো চক্র আগের মত কারসাজি না করতে পারে এ জন্য সতর্ক আছি। কিন্তু বাজেটে পুঁজিবাজারের জন্য ইতিবাচক অনেক ঘোষণা থাকলেও বাজারে তেমন প্রভাব পড়তে দেখা যায়নি। একের পর এক দরপতন হয়েছে। নিঃস্ব হয়েছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। বছরজুড়ে শেয়ারবাজার উন্নয়নে সরকারের উচ্চ মহলও ছিল তৎপর। বাজার সম্পর্কে ইতিবাচক বক্তব্য ছিলো সব সময়। দেশের শেয়ারবাজার উন্নয়নে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রণ সংস্থার মধ্যে এক সমঝোতা চুক্তি সই হয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। এসময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে পুঁজিবাজার উন্নয়নে সরকারের সবরকম সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে বলে ঘোষণা দেন। প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও প্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ও ছিলেন তৎপর। দেশের শেয়ারবাজারে বিদেশি আইটি কোম্পানি তালিকাভুক্তি হচ্ছে জানিয়ে সে সময় তিনি বলেন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতের আধুনিকায়ন জরুরি। তার জন্য প্রয়োজনে দেশের বর্তমান টেলিযোগাযোগ নীতিমালা সংশোধন করা হবে।শেয়ারবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ সংক্রান্ত জটিলতা দ্রুত নিষ্পত্তি করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে তাগিদ দেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। এদিকে, সাব-সিডিয়ারি মার্চেন্ট ব্যাংকে একক গ্রাহক ঋণসীমা (সিঙ্গেল বরোয়ার এক্সপোজার লিমিট) সমন্বয়ের সময়সীমা বাড়ানোর দাবি ছিলো বছরজুড়ে।সঙ্কট উত্তরণে যথাযত পদক্ষেপ গ্রহণের আশ্বাসও দেন অর্থমন্ত্রী। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১২ নভেম্বর অর্থমন্ত্রী ঘোষণা দেন পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বাড়তি বিনিয়োগ সমন্বয়ের সময়সীমা দুই বছর বাড়ানো হবে। তবে কাগজ কলমে এর কোনো নির্দেশনা এখনো জারি হয়নি।   এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র বলছে, বিএসইসি সময় বাড়ানোর আবেদন করলেও আইন সংশোধন ছাড়া সময় বাড়ানোর এখতিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে নেই। তবে দাবি আসলে, বাংলাদেশ ব্যাংক বিষয়টি নিয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করা হবে।জানা গেছে, ২০১৬ সালের জুন পর্যন্ত একক গ্রাহক ঋণ সমন্বয়ের সময় বেধে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সংশোধিত ব্যাংক কোম্পানি আইন মোতাবেক এই সময়ে দেয়া হয়েছে।এদিকে বছরের শেষ সময়ে শেয়ার বাজারের স্বস্তির সংবাদ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে এক্সপোজারের সময় বাড়ানো নয়। পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ সীমার সংক্রান্ত নতুন নির্দেশনা। আগামী জানুয়ারি থেকে সাব-সিডিয়ারি কোম্পানিতে মূলধনের বিপরীতে ব্যাংকের ইক্যুয়িটি বিনিয়োগ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ হিসেবে গণ্য হবে না বলে জানায় বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ নির্দেশনার ফলে ব্যাংকগুলোর শেয়ারবাজারে সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ সক্ষমতা বাড়বে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়। ফলে পুঁজিবাজারে ব্যাংকের অতিরিক্তি বিনিয়োগ সমন্বয়ের চাপ কিছুটা কমবে। এছাড়াও যারা আগে সমন্বয় করতে পেরেছেন তাদের জন্য নতুন বিনিয়োগ সৃষ্টি হবে। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরাও আগের চেয়ে সক্রিয় হবে বলে জানান বাজার সংশ্লিষ্টরা।পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নেয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- মার্জিন রুলস এর স্থগিতাদেশের মেয়াদ আরো এক বছর বাড়িয়ে ২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর করে বিএসইসি। ফলে ঋণাত্মক ইক্যুইটির হিসাবেও মার্জিন ঋণ গ্রাহকরা লেনদেন করতে পারবেন।ব্যাংকে যাওয়া-আসার ভোগান্তি থেকে রেহাই দিতে প্রাথমিক গণপ্রস্তাবে (আইপিও) আবেদন প্রক্রিয়া বাতিল করে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি। ফলে এখন ব্রোকারেজ হাউজের আইপিও আবেদন করতে পারে বিনিয়োগকারীরা। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত নতুন কোম্পানির কারসাজি বা অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি রোধে লেনদেনের শুরুর প্রথম ৩০ কার্যদিবস মার্জিন ঋণ প্রদানে বিরত থাকতে নির্দেশনা দেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা। একই সঙ্গে সার্কিট ব্রেকার ছাড়া লেনদেনের সময় সীমা পাঁচ দিনের পরিবর্তে দুইদিন করা হয়।বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক সাইফুর রহমান বলেন, বাজারকে গতিশীল করতে ১০ বছর মেয়াদি মাস্টারপ্ল্যান হাতে নেয়া হয়েছে। ডিএসই ও সিএসইকে ডিমিউচুয়ালাইজেশনের সুযোগ দেয়া হয়েছে। এনফোর্সমেন্ট বিভাগকে শক্তিশালী করা হয়েছে। আধুনিক সার্ভিলেন্স পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সিকিউরিটিজ কমিশনের সঙ্গে পরামর্শের আলোকে কাজ করা হচ্ছে। বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মাধ্যমে অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনা হয়েছে।বাজার উন্নয়নে বছর জুড়ে নানা পদক্ষেপ নেয় দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, বড় লেনদেন উৎসাহিত করতে ব্লক ট্রেড, ফ্লোর ক্রসিং এবং ডেলিভারি ভার্সেস পেমেন্ট (ডিভিপি) ট্রেডের ক্ষেত্রে ফি দশমিক ৫০ পয়সা কমায় ডিএসই। এবছরই অনলাইন পেমেন্ট সিস্টেম চালু করে। আইপিওর জন্য দাখিলকৃত পাবলিক অফার ডকুমেন্টের ওপর মতামত দেওয়ার ক্ষমতা পায় স্টক এক্সচেঞ্জ। এবছরই মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন বা অ্যাপ চালু করে ডিএসই। ডিএসই ইনফো নামে এ অ্যাপের মাধ্যমে ডিএসইর লেনদেনের সময় কোম্পানির শেয়ারদর ও লেনদেন সম্পর্কিত তথ্য রিয়েল টাইমে জানতে পারে বিনিয়োগকারীরা। ডিএসইর উন্নতর ওয়েবসাইটের নতুন সংস্করণ চালু করা হয় এ বছর।কিন্তু নানামুখী উদ্যোগ ও সংস্কারের পরও চলতি বছরে কারিগরি ত্রুতির কারণে ডিএসইতে পাঁচ কার্যদিবস লেনদেন বিলম্ব হয়। সর্বশেষ গত ২৮ নভেম্বর সার্ভার সমস্যায় সব কোম্পানি একসঙ্গে লেনদেন শুরু করতে পারেনি। এর আগে ১২ আগস্ট একই কারণে ১ ঘণ্টা ৪০ মিনিট লেনদেন বন্ধ ছিল। মে মাসে টানা দুই দিন কারিগরি ত্রুটির কারণে লেনদেনে বিঘ্ন ঘটে। ২৪ মে ৩ ঘণ্টা ৫০ মিনিট ও ২৫ মে পৌনে ২ ঘণ্টা লেনদেন বন্ধ থাকে।ডিএসইর পরিচালক শাকিল রিজভী বলেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থার পাশাপাশি সরকারও পুঁজিবাজার স্থিতিশীলতায় কাজ করছে। সম্প্রতি ভারত ও বাংলাদেশের পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রণ সংস্থার মধ্যে এক সমঝোতা চুক্তি সই হয়েছে। যা ভবিষৎ শেয়ারবাজারের জন্য ইতিবাচক। এছাড়াও ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের এক্সপোজার লিমিটের সময় বাড়ানো উদ্যোগে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে কিছুটা আস্থা ফিরে এসেছে। এছাড়াও গেল সপ্তাহে ঋণাত্মক ইক্যুইটি লেনদেনের সুযোগ এক বছর বাড়ানোসহ বেশকয়েকটি সিন্ধান্ত নিয়েছে যা বাজারের জন্য ইতিবাচক।এদিকে বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই) তাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেইজ ওপেন করে। সেখানে বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করা ও নানা প্রডাক্ট ও ঝুঁকিপূর্ণ বাজার সম্পর্কে সচেতনতার তথ্য পোস্ট করে সক্রিয় ছিল সিএসই। একই সঙ্গে সিএসইর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওয়ালি উল মারুফ মতিনের পদত্যাগের বিষয়টি ছিল আলোচিত-সমালোচিত। পরিচালনা পর্ষদের চাপ ও তার উপর ব্যর্থতার দায় দিয়েই তিনি পদত্যাগ করে সমালোচনায় আসেন। বিষয়টি এখনো নিয়ন্ত্রণ সংস্থার তদন্তাধীন রয়েছে। সব মিলিয়ে আলোচনা সমালোচনায় বছর পার করলেও ২০১৫ সালে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ তেমন সংরক্ষণ হয়নি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।  এসআই/এসকেডি/এসএইচএস/আরআইপি

Advertisement