রংপুর, কুমিল্লা, নোয়াখালী, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জায়গায় দুর্গাপূজামণ্ডপে কুকর্ম এবং সাম্প্রদায়িক গণ্ডগোলগুলো কে বা কারা পাকিয়েছে? প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত কি বলা যায়? গণমাধ্যম এবার যথেষ্ট সাবধানী-সংযত। ধারণানির্ভর বা হালকা তথ্য একদম নেই। কিন্তু, রাজনৈতিক দল ও নেতাদের মধ্যে চরম দায়িত্বহীনতা। রাজনীতির নামে যে যা পারছেন বলে দিচ্ছেন। গণমাধ্যমে তা প্রকাশ হচ্ছে কোন আনকোডে। ক্ষমতাসীন দল থেকে সুনির্দিষ্টভাবে বলা হচ্ছে, ঘটনার হোতা বিএনপি। আর বিএনপি নেতারা বলছেন, নানান ব্যর্থতা আড়াল করতে সরকারই ঘটনা ঘটিয়েছে। এ ধরনের বাৎচিতে তদন্তের আগেই তারা বিচার করে ফেলছেন। কেবল শাস্তিটা বাকি।
Advertisement
অসংখ্য ঘটনায় প্রমাণিত আওয়ামী লীগ-বিএনপি-জাতীয় পার্টি-জামায়াত বরাবরই সাম্প্রদায়িক বেনিফিসিয়ারি। ধর্মের ব্যাবহার-অপব্যবহারে কেউ কারো চেয়ে কম যায় না। উপরন্তু রংপুর-কুমিল্লার মতো ঘটনা তাদেরকে ময়দান গরম করার সুযোগ এনে দেয়। সেই সুযোগটার ষোলো আনাই লুফে নেয় তারা। মুখে বলে বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। এমন বুলিতে সমস্যা জিইয়ে রেখে বিষাক্তময় সাম্প্রদায়িকতার বিপক্ষে ধর্মনিরপেক্ষ এবং শুভবুদ্ধির মানুষের সংঘবদ্ধতা সেই অর্থে উদয় হচ্ছে না। বাংলাদেশে বিশাল একটি জনগোষ্ঠীর মন-মনন সাম্প্রদায়িক। এদিকে , নইলে সেদিকে। উল্লেখযোগ্য একটা অংশের মধ্যে অন্য ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ ছিল-আছে, এটা বাস্তবতা। কোনো সমস্যা স্বীকার না করে সমাধান আজতক দুনিয়াতে আসেনি। মনকাড়া শব্দে সমস্যাকে অস্বীকার করা প্রকারান্তরে একটি চাতুরি।
দেশে জেনারেল এরশাদের করা রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম বহাল আছে। ১৯৮৮ সালের ৫ জুন চতুর্থ জাতীয় সংসদে রাষ্ট্র ধর্ম বিল পাস হয়। তখনকার বিরোধী মতের রাজনৈতিক দলগুলোর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া মনে আছে? আজকের মতো তখন টাটকাভাবে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ পেতো না। টেলিভিশন-রেডিও আজকের মতো ছিল না। অনলাইন মিডিয়াও ছিল না। সামাজিক গণমাধ্যমের কথা ভাবাই যায়নি। গণমাধ্যম বলতে তখন পত্রিকাই ছিল প্রধান। অর্থাৎ একদিনের অপেক্ষা। বিলটি পাসের পরদিন ৮৮-এর ৬ জুন তারিখে প্রকাশিত পত্রিকাগুলোর শরণাপন্ন হয়ে তখনকার আন্দোলনকারী ৩ বড় দলের প্রতিক্রিয়ায় চোখ বুলানো যাক। ১) এই সংশোধনী জনগণ মানবে না- শেখ হাসিনা । ২) ধর্মের নামে জাতিকে বিভক্ত করার চেষ্টা- বেগম খালেদা জিয়া । ৩) ইসলামি আন্দোলন প্রতিহত করাই রাষ্ট্র ধর্ম বিলের উদ্দেশ্য- জামায়াত।
ধর্ম নিয়ে এই কিছিমের কী রাজনীতিটাই না চলে আসছে! ব্রিটিশ আমলের আগে ৭০০ বছর মুসলমানদের শাসন ছিল এখানে। তখন মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল না, কিন্তু মুসলিম শাসন ছিল। ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, মিয়ানমারসহ সব অঞ্চলে মুসলিম শাসন ছিল। তখন রাষ্ট্রীয়ভাবে মুসলমানের যে শক্তি ছিল, ইচ্ছা করলেই তাঁরা অনেক কিছু করতে পারতেন। কিন্তু তাঁরা সেটি করেননি। হিন্দু সম্প্রদায়ের কারও ওপর তখন জোর-জুলুম বা আক্রমণ করা হয়নি। যদিও ধর্ম নিয়ে কট্টর অবস্থান সব অনুসারীর মধ্যেই আছে। হিন্দু-মুসলমানদের এ বিষয়ে একতরফা দোষারোপ করা যায় না। রোগটির নানা উপসর্গ।
Advertisement
একটু উঁকি দিলেই, জীবন আচরণ ও অন্য ধর্মের প্রতি রাগ-অনুরাগ প্রত্যক্ষ করা যায়। বাংলাদেশ ও এর চারপাশের ব্রিটিশশাসিত দেশগুলোতে ব্রিটিশরা যে বিষফোঁড়া গেঁথে গেছে, সেটার পুঁজ এখনও প্রবাহিত। উত্তাপটা বাড়ছেই। ইতিহাসবিদরা ভারতবর্ষের ইতিহাস ভাগ করেছেন তিনভাগে। ১. হিন্দু যুগ, ২. মুসলমান যুগ, ৩. ব্রিটিশ যুগ। শাসকদের ধর্ম অনুযায়ী প্রথম দুটি যুগের নামকরণ। তাহলে ব্রিটিশ যুগের নাম খ্রিস্টান যুগ হবে না কেন?-এ প্রশ্নের জবাব মেলে না। গোলমাল কিন্তু আরো আছে। ব্রাহ্মণ আর উচ্চ শ্রেণির হিন্দুদের দাবি, তাদের পূর্বপুরুষরা আর্য। এসেছে পারস্য থেকে। আশরাফ গোত্রের মুসলমানরা দাবি করে তাদের পূর্বপুরুষরা এসেছেন আরব-ইরান-তুরান থেকে। দুই ধর্মের ধনবানদের দাবি ঠিক হলে তারা সব বহিরাগত। দেশের সাধারণ মানুষ তাহলে কারা? কোত্থেকে আগমন তাদের?
মানুষ সাম্প্রদায়িক হলো কবে? এর নিরপেক্ষ জবাব ও ব্যাখ্যা পাওয়া কঠিন। তবে, ঘটনা বিশ্লেষণে দেখা যায়- আধিপত্য ও সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে অস্ত্র হিসেবে ধর্মের ব্যবহার শুরু থেকেই ব্যক্তি, গোষ্ঠী, রাষ্ট্র সাম্প্রদায়িক হতে শুরু করে। এখন ক্ষমতায় আরোহন এবং টিকে থাকাও ধর্মের ওপর নির্ভরশীল। অসাম্প্রদায়িকতার পতাকা উড়ে বিস্ফোরিত হয় অসাম্প্রদায়িকতার ফাঁকা বুলি। ভোটের মতলবে, সামাজিক স্বার্থে অসাম্প্রদায়িকতার বসন নেই। কিন্তু ব্যক্তিজীবনে, আচরণে, চর্চায় সাম্প্রদায়িক প্রকাশ অনেকেরই। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঘটনা নয়। মূল বিষয় সবল আর দুর্বল বা সংখ্যালঘু। সাম্প্রদায়িক শক্তি যেকোনও জনপদেই লঘুদের ওপর চড়াও হয়। এটাই আধিপত্যবাদের ধর্ম। লঘুরা নির্যাতনের শিকার হলে, বিপন্ন বোধ করলে, নিরাপত্তাহীনতায় কুঁকড়ে থাকলে, অসাম্প্রদায়িকতার চাদর নিয়ে প্রায় সব রাজনৈতিক দলই এগিয়ে যায়।, ভোটবাজারে কেনাবেচার ছক সাজায়। কাহিনী রচনা করে।
মানুষের মস্তক কোথাও না কোথাও অবনত হবেই। কেউ সেজদা করে সৃষ্টিকর্তাকে, কেউবা সৃষ্টিকে। কেউ বা প্রকৃতিকে। স্বাভাবিক কাণ্ডজ্ঞানে পরিষ্কার- কোনো মুসলিম মূর্তির সাথে কুরআন রাখতে পারে না। কোনো হিন্দুও মূর্তির সাথে কুরআন রাখতে পারে না। কোনো মুসলিম মন্দিরে হামলা করতে পারে না। কোনো হিন্দুও মসজিদে হামলা করতে পারে না। এরপরও হচ্ছে। কুমিল্লা, রামু, সাঁথিয়া, নাসিরনগর, অভয়নগর কাণ্ড কারা করে? দলবাজি করতে করতে দলদাসেরা একসময় দলযন্ত্র হয়ে যায়। শেষে আর মানুষ থাকে না। এছাড়া বিদ্বেষ তো শুধু ধর্মে নয়। সবখানেই। অহর্নিশ তো বিদ্বেষেরই চর্চা। অসভ্য রাজনীতি দিয়ে বিদ্বেষহীন সমাজ গড়া যায় না। দুর্বলকে সবলের হাত থেকে রক্ষা করা রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব। দুনিয়ার সকল সংখ্যালঘুর প্রতিই সংখ্যাগুরুরও একই দায়িত্ব।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।
Advertisement
এইচআর/এমএস