কখনো ভাবেননি সাংবাদিকতা কিংবা নাটককে জীবনের সাথে জড়িয়ে নেবেন। ইচ্ছে ছিল চিকিৎসক হওয়ার। কিন্তু স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কলেজে আসতেই বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনে কবিতা লিখতে শুরু করেন। ফিজিক্স-ক্যালকুলাস থেকে বেরিয়ে এসে পড়তে শুরু করেন দেশ-বিদেশের বিখ্যাত লেখকদের গল্প-উপন্যাস ও কবিতা। সিদ্ধান্ত বদল করেন রুদ্র মাহফুজ। ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগে। খুঁজে পান জীবন সম্পর্কিত নিজস্ব অধ্যয়ন, প্রত্যক্ষণ, অভিজ্ঞতা ও শিল্প উদ্ভাবনের বিশাল এক ক্ষেত্র। শুধু তাই নয়, দেশ-বিদেশের নাটক পড়ার মাধ্যমে ব্যক্তি মানুষকে ছাড়িয়ে বিশ্ব ভান্ডারের নতুন শিল্প বোধেরও খোঁজ পান তিনি। সে সময় সাংবাদিকতার সাথেও সম্পৃক্ত হন রুদ্র মাহফুজ। যোগ দেন দৈনিক ইত্তেফাকের ফিচার বিভাগে। খানিকটা চাপা স্বভাবের কিন্তু ভীষণ রকম স্বপ্ন বিলাসী মানুষ রুদ্র মাহফুজ আনুষ্ঠানিকভাবে সাংবাদিকতার শুরু করেন এখানেই। এরপর দীর্ঘদিনের যাত্রায় বর্তমানে তিনি জনপ্রিয় পাক্ষিক ম্যাগাজিন ‘বিনোদন’র নির্বাহি সম্পাদক হিসেবে কর্মরত আছেন। নাট্যকলা বিভাগে সান্নিধ্যে আসার সুযোগ পান সৈয়দ জামিল আহমেদ, ইসরাফিল শাহীন এবং ওয়াহীদা মল্লিকের মতো গুণী মানুষদের। ধীরে ধীরে অভিনয় সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে উঠেন রুদ্র। একাডেমিক কারিকুলামের আওতায় একে একে অভিনয় করেন ইউলিয়াম শেক্সপীয়রের ‘ম্যাকবেথ’,‘টেমিং অব দ্য শ্রু’, সফোক্লিসের ‘ইডিপাস’, এ্যারিস্টোফানিসের ‘ভেক’, মলিয়েরের ‘তার্ত্যুফ’, দিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘সাজাহান’, হ্যারল্ড পিন্টারের, ‘দ্য রুম’, ইউজিন আয়নেস্কোর ‘চেয়ার’, শূদ্রকের ‘মৃচ্ছকটিক’, গেরহার্ট হপ্টম্যানের ‘দ্য উইভার্স’, হেরল্ড স্ক্রেফারের ‘শ্যাডো অন দ্য বীচ’, লুইজি ব্রায়াডের ‘আশ্চর্য সুন্দর এ বেঁচে থাকা’, হেইনার মুলারের ‘হ্যামলেট মেশিন’ এবং বার্টল্ট ব্রেখটের ‘দ্য মেজারস টেকেন’সহ বহু ইম্প্রোভাইভেশন ভিত্তিক নাট্য প্রযোজনায়। নিজের খেলা কাব্য নাটক ‘কিছু ঘাসফুল শুকিয়ে যায়’ নির্দেশনা দিয়েও একাডেমিকভাবে দারুণ প্রসংশিত হন তিনি। নাট্যকলা বিভাগে অধ্যয়নকালেই টিভি নাটক লেখার প্রস্তাব পান রুদ্র মাহফুজ। কিন্তু পড়াশোনা ও সাংবাদিকতার কারণে টিভি নাটক লেখার তেমন একটা ইচ্ছে তার মনে জাগেনি। অবশেষে ২০১২ সালের শেষের দিকে ঈদ-উল ফিতরে বিটিভির জন্য রুদ্র মাহফুজ লেখেন তার প্রথম টিভি নাটক ‘আত্মহনন ও অতঃপর’। এর কিছুদিন বিরতির পর লেখেন ‘আজ শফিকের বিয়ে’, ‘কেন মিছে নক্ষত্ররা’, ‘চিঠি’, ‘ভালোবাসার কাছে ফেরা’, ‘তবুও ভালোবাসি’, ‘তৃষা’, ‘লাষ্ট সামার’, ‘অপরাহ্ন’, ‘ব্ল্যাক কফি’সহ আরো বহু দর্শক নন্দিত নাটক। গত ঈদুল আযহায় প্রচারিত হয়েছে তার লেখা সর্বশেষ টেলিফিল্ম ‘এক্সপ্রেশন অব লাভ’।মাত্র তিন বছরেই রুদ্র মাহফুজ টিভি নাট্যকারদের মধ্যে এক পরিচিত নামে পরিণত হয়েছেন। তার লেখা দু’টি ধারাবাহিক প্রচারের অপেক্ষায় আছে। এগুলো হচ্ছে-সাখাওয়াত মানিক পরিচালিত ‘মেঘে ঢাকা শহর’ ও বি ইউ শুভ পরিচালিত ‘লাইফ ইন এ মেট্রো’। এছাড়া রুদ্র মাহফুজ লিখছেন নতুন আরো একটি ধারাবাহিক। ‘সার্কেল’ শিরোনামের এই ধারাবাহিকটি নির্দেশনা দিবেন জিয়াউদ্দিন আলম। নিজের বর্তমান ব্যস্ততা প্রসঙ্গে রুদ্র মাহফুজ জানান, ‘পেশাগত কারণে খুব বেশি নাটক লেখা হয়ে উঠে না। তাই মাঝে মাঝে নাটক লেখি। আগামী বছর নাটক লেখার পাশাপাশি সিনেমা লিখবো। ইতিমধ্যেই প্রস্তাব পেয়েছি। সবকিছু ঠিক থাকলে আসছে বছরে বাণিজ্যিক ঘরনার চিত্রনাট্য লেখতে যাচ্ছি। পাশাপাশি আগামী বছরের মাঝামাঝি সময়ে আরও একটি নতুন দীর্ঘ ধারাবাহিক লেখার প্রাথমিক কথা চূড়ান্ত হয়েছে।’নাট্যকলা বিভাগে অধ্যয়নকালে বহু দেশ-বিদেশের নাটকে পারফর্ম করেছেন অথচ পরবর্তীতে অভিনয়ে নিয়মিত না হওয়ার কারণ কি, এমন প্রশ্নের উত্তরে রুদ্র মাহফুজ বলেন, ‘অভিনয়ে যে করিনি তা কিন্তু নয়। বেশ ক’টি টিভি নাটকে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছি। পরবর্তীতে নাটক লেখাতে বেশি মনযোগী হয়ে পড়েছি। কারণ নাটকে অভিনয় করতে গেলে শুটিংয়ে বেশি সময় দিতে হয়, যা আমার পেশাগত কারণে সম্ভব নয়। আর অভিনয় আমার কাছে সব সময় যেমন ভীষণ আনন্দের তেমনি ভীষণ কঠিন বলে মনে হয়।’একজন বিনোদন সাংবাদিক হিসেবে সাম্প্রতিক অভিনয়ের আঙিনার নানা বিষয়ে তিনি কথা বললেন। রুদ্র বলেন, ‘আজকাল অনেকেই অভিনয় করেন যারা অভিনয়ের ‘অ’ পর্যন্ত জানেন না। অভিনয়ের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিষয়গুলো না জেনেই অনেকেই নিজেকে অভিনয় শিল্পী বলে দাবি করেন যা অনুচিত। আর এইসব মানুষেরা লবিং করে নাটক-ছবিতে অভিনয় করে এই শিল্পের মানকে তলানিতে নিয়ে গেছেন। এ বিষয়ে নির্মাতা ও সংশ্লিষ্টদের সচেতন হতে হবে। বিশেষ করে টিভি নাটকের ক্ষেত্রে টেলিভিশনগুলোকে আরো যত্নশীল হতে হবে। তাদের এটা মাথায় রাখতে হবে কার নাটক চালানো হচ্ছে, কেমন পরিচালক নির্মাণ করছেন, কী নির্মাণ করছেন, কাদের নিয়ে নির্মাণ করছেন? ’আমাদের চলচ্চিত্র প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘চলচ্চিত্র শিল্পের সব থেকে বড় মাধ্যম। এখানে সম্ভাবনা যেমন বেশি থাকে তেমনি সমস্যাও থাকে প্রচুর। তাই সমস্যায় ভয় পেলে চলবে না। উত্তরণের পথ প্রত্যেককেই ভাবতে হবে। ভালো ছবি নির্মাণ করে তা হলে চালোনোর ব্যবস্থা করতে হবে। বেশ কয়েকটি বছর আমাদের ভালো যাচ্ছে না। বিশেষ করে চলতি বছরটা ঢাকাই ছবির জন্য ভীষণ হতাশার। তবে আমি আশাবাদী, শিগগিরই ঘুরে দাঁড়াবে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি। আগামী বছর বেশ কিছু বিগ বাজেটের ছবি মুক্তি পাবে। সেইসাথে হুমায়ূন আহমেদে উপন্যাস নিয়ে নির্মিত তার স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওনের ‘কৃষ্ণপক্ষ’ ছবিটাও মুক্তি পাবে। রিয়াজ-মাহি, ফেরদৌস, তানিয়া আহমেদের প্রাণবন্ত অভিনয়ের এই ছবিটি দিয়ে নতুন বছরের আমাদের চলচ্চিত্রের যাত্রাটা শুভ বলেই আশা করছি।’রুদ্র মাহফুজ টিভি নাটক লেখলেও এখনও নিয়মিত মঞ্চ নাটকের সাথে নিজেকে বিভিন্ন ভাবে সম্পৃক্ত রেখেছেন। বেশকিছু নাট্যদলের ওয়ার্কশপে ট্রেনার হিসেবে কাজ করেছেন। পরিকল্পনা আছে মঞ্চ নাটক লেখার। স্টাইল আইকন, লাক্স চ্যানেল আই সুপারস্টারের অভিনয় প্রশিক্ষক বাদেও সম্প্রতি ‘দ্য স্পাই’ চলচ্চিত্রের টেলেন্ট হান্ট প্রতিযোগিতায় জাজ ও ট্রেনার হিসেবেও প্রসংশিত হয়েছেন। কথায় কথায় এ সময়ের সংস্কৃতি সাংবাদিকতা নিয়েও মুখ খুলেন তিনি। বললেন, ‘কাজের সততাটা কমে গেছে। সিনিয়রদের কাছ থেকে যেটুকু পরামর্শ, নির্দেশনা, আন্তরিকতা পাবার কথা তা পাচ্ছে না জুনিয়ররা। স্বাভাবিকভাবেই এখানে সম্পর্কগুলো খুব দৃষ্টিকটু হয়ে উঠছে। সংবাদের চাইতে এখন খ্যাতির মোহটাই বেশি কাজ করছে সবার মধ্যে। সৃষ্টিশীলতার কদর নেই। কালচারাল সাংবাদিকদের সংগঠনগুলোও হয়ে পড়ছে অকেজো, অ্যাওয়ার্ড নির্ভর, ব্যক্তিস্বার্থ প্রধান আর গন্তব্যহীন। এজন্য সাংবাদিকদের মূল্যায়ণ কমেছে। এভাবে চলছে সামনে আরো ভয়াবহ দিন আসছে।’সবশেষে রুদ্র মাহফুজ নিজের আজকের ক্ষুদ্র এ অবস্থানে আসার পেছনে শিক্ষাগুরু অধ্যাপক ড. ইসরাফিল শাহীনের অবদানকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন। শাহীন স্যারের সান্নিধ্যে আসতে না পারলে জীবনকেই নতুনভাবে বুঝতে পারতেন না বলে মনে করেন সময়ের ব্যস্ত সাংবাদিক-নাট্যকার রুদ্র মাহফুজ।এলএ
Advertisement