আওয়ামী লীগের গাজীপুর মহানগর শাখার সাধারণ সম্পাদক ও সিটি করপোরেশনের (জিসিসি) মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের ছড়ানো একটি বক্তব্য এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে ‘সৃষ্ট আন্দোলন’ নিয়ে ক্ষুব্ধ দলের হাইকমান্ড। পাশাপাশি দলীয় ফোরামের বাইরে গিয়ে বিষয়টি নিয়ে আন্দোলন জমানোয় সভাপতি আজমত উল্লাহ খানের দায়িত্বজ্ঞানও পড়েছে প্রশ্নের মুখে। এমন পরিস্থিতি তৈরির জন্য সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক দুই নেতার বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেওয়ার পক্ষে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব।
Advertisement
এ নিয়ে ইতোমধ্যে একাধিক দিন আওয়ামী লীগের অনানুষ্ঠানিক ফোরামে আলোচনা হয়েছে। নেতারা বলছেন, “এটি মূলত সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের দ্বন্দ্বের নোংরা বহিঃপ্রকাশ। সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের দ্বন্দ্ব নিরসনে নেত্রী ‘ভারপ্রাপ্ত নীতি’ নিয়ে এগোচ্ছেন।”
আলোচনার শুরু মূলত গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের ঘরোয়া পরিবেশের একটি বক্তব্যের ভিডিও প্রকাশের পর। গোপনে ধারণ করা ১১ মিনিট ২৩ সেকেন্ডের ওই ভিডিওতে মেয়র জাহাঙ্গীরকে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা নিয়ে কটূক্তিমূলক মন্তব্য করতে শোনা যায়। এছাড়া মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আজমত উল্লাহ খান এবং যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেলের সঙ্গে সম্পর্ক, হেফাজতের প্রয়াত নেতা জুনায়েদ বাবুনগরীর সঙ্গে তার সখ্য ও রাষ্ট্রীয় দুটি সংস্থা নিয়ে নানা আপত্তিকর মন্তব্যও শোনা যায়।
ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়ানোর পর দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে গাজীপুর মহানগর। মেয়র জাহাঙ্গীর আলমকে গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে বহিষ্কারের দাবি জানানো হয়।
Advertisement
গত ২১ সেপ্টেম্বর থেকে কিছুদিন গাজীপুরের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সভা করেন গাজীপুর জেলা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। এর মধ্যে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের কোথাও ঝাড়ুমিছিল, কোথাও বিক্ষোভ মিছিলসহ সড়কে টায়ার জ্বালিয়ে প্রতিবাদ করেন তারা। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের টঙ্গী স্টেশন রোড, মিলগেট, চেরাগআলী, কলেজগেট ও হোসেন মার্কেট এলাকায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা এসব কর্মসূচি পালন করেন।
জাহাঙ্গীর আলমের শাস্তি দাবিতে টঙ্গীতে ঝাড়ুমিছিল করে আওয়ামী লীগের একটি অংশ
ওই বক্তব্য ও পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ প্রসঙ্গে গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আজমত উল্লাহ খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘বক্তব্য যেটা আসছে, এটা তো একেবারেই ক্ষমার অযোগ্য। বঙ্গবন্ধু ও মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কটূক্তি এবং মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের একটা গাণিতিক হিসাব দিয়ে ৩০ লাখকে দুই লাখ প্রমাণ করার চেষ্টা; এ বক্তব্য অবশ্যই প্রত্যেকটি নেতাকর্মীর মনে ক্ষত সৃষ্টি করেছে। সেজন্য তারা এটার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছেন।’
তিনি বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে তিনি বলেছেন, এ বক্তব্য তার নয়। তিনি যদি প্রমাণ করতে পারেন সেটা তার বক্তব্য নয়, তাহলে দেখতে হবে, এটা কে করেছে। তবে আমি তার কণ্ঠ শুনি, জানি। আমি মোটামুটি নিশ্চিত যে, এটা তার বক্তব্য।’
Advertisement
আজমত উল্লাহ খান বলেন, ‘আমাদের বক্তব্য অত্যন্ত ক্লিয়ার, নেতাকর্মীরা কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে তাদের বক্তব্য তুলে ধরেছেন। দলের হাইকমান্ড তার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে। কেন্দ্রীয় নেতারা বিভিন্নভাবে আমাদের বক্তব্য শুনতে চেয়েছেন, আমরাও আমাদের বক্তব্য জানিয়ে দিয়েছি। আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র আছে, সে মোতাবেক নিশ্চয়ই দলের হাইকমান্ড সিদ্ধান্ত নেবে।’
সিটি মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম শুরু থেকেই দাবি করছেন, অডিও-ভিডিও সুপার এডিটিংয়ের মাধ্যমে তার বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়ানো হয়েছে। এমনকি এতে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ারও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তিনি।
জাহাঙ্গীর আলমকে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কারের দাবিতে নেতাকর্মীদের একাংশের বিক্ষোভ
আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, প্রযুক্তির উৎকর্ষতার এই সময়ে জেলা পর্যায়ের একজন নেতার বক্তব্য কাটছাঁট করে এডিট করে দেওয়া হয়েছে কি না দল তা যাচাই-বাছাই করছে।
ভিডিও প্রকাশ-পরবর্তী ঘটনা বিশ্লেষণ করতে নেমে আওয়ামী লীগ ও সরকারের সংস্থাগুলোর চক্ষু চড়কগাছ। তারা জানতে পেরেছেন, বিরোধী শক্তি নয়, বরং মহানগর আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণেই জাহাঙ্গীরের বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়েছেন একই দলের নেতাকর্মীরা। সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে দলের সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের উসকে দিয়ে মাঠে নামিয়েছেন সভাপতি আজমত উল্লাহ খান।
এদিকে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার কঠোর নির্দেশ আছে, যে কোনো জেলা ও উপজেলা ইউনিটের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের পারস্পরিক বোঝাপড়া না থাকলে তাদের বাদ দিয়ে যেন এক নম্বর সহ-সভাপতি ও এক নম্বর যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদককে দায়িত্ব দেওয়া হয়। দলীয় শৃঙ্খলার প্রশ্নে আপসহীন কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ইতোমধ্যে এমন সাংগঠনিক জেলায় দৃষ্টান্তও স্থাপন করেছে। নরসিংদী ও সিরাজগঞ্জ জেলায় এ নীতি বাস্তবায়ন করা হয়েছে। আওয়ামী লীগে দলীয় শৃঙ্খলার প্রশ্নে এবার তৃতীয় সাংগঠনিক জেলা হিসেবে গাজীপুর মহানগর শাখাও আপসহীনতার দৃষ্টান্ত হতে যাচ্ছে কি না, সেদিকে তাকিয়ে সবাই।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম জাগো নিউজকে বলেন, ‘জাহাঙ্গীর আলমকে দলের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে কারণ দর্শানোর জন্য বলা হয়েছে। ১৫ দিনের সময়ও দেওয়া হয়েছে। এখন বল তার কোর্টে দেওয়া হয়েছে। তিনি কি ভুল স্বীকার করেন, নাকি অস্বীকার করেন—সেটাই দেখার বিষয়। তার বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে দল আলোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে।’
এ বিষয়ে জাহাঙ্গীর আলমকে পাওয়া না গেলেও তার একাধিক অনুসারী জাগো নিউজকে বলেন, ‘সামনে গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সম্মেলন ও সিটি নির্বাচন। যে কারণে একটি পক্ষ মেয়রকে ঘায়েল করতে এ পথ বেছে নিয়েছে।’
এসইউজে/ইএ/এইচএ/জেআইএম