সালতামামি

গুণীজন হারানোর বছর

কালের অমোঘ নিয়মে ক`দিন পরই ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে হারিয়ে যাবে ২০১৫ সাল। নানা দিক থেকেই ২০১৫ সালটি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে পাওয়া-না পাওয়ার নানা হিসেব। এর মধ্যে অনেক হিসেবই হয়তো মিলবে না। বিশেষ করে ২০১৫তে যাদের হারিয়েছি তারা আর ফিরে আসবেন না। এটাও এক অমোঘ নিয়তি। যারা চলে গেলেন তাদের স্থান পূরণ হবে না। তবে তারা বেঁচে থাকবেন তাদের কর্মে, তাদের আদর্শে আমাদের অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হিসেবে। এ বছর আমরা হারিয়েছি সাহিত্যিক, সাংবাদিক, ভাস্কর, ব্যবসায়ী, চলচ্চিত্রকার, গীতিকার, রাজনীতিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার বেশ কিছু গুণী মানুষকে। সব মিলিয়ে ২০১৫ সালকে বলা যায় গুণীজন হারানোর বছর।চাষী নজরুল ইসলামবছরের শুরুর দিকেই ১০ জানুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন একুশে পদক পাওয়া প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা চাষী নজরুল ইসলাম। রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। চাষী নজরুল ইসলাম ১৯৪১ সালের ২৩ অক্টোবর শ্রীনগর থানার সমষপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম মোসলেহ উদ্দিন খান। মা শায়েস্তা খানম। চার ভাই ও তিন বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়।১৯৫৫ সালে টাটানগরে নির্মিত একটি প্রামাণ্যচিত্রে প্রথম অভিনয় করেন প্রখ্যাত এই নির্মাতা। ১৯৬০ সালে ফতেহ লোহানীর সঙ্গে ‘আসিয়া’ ছবিতে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ শুরু করেন। এরপর কাজ করেন ওবায়েদ উল হকসহ আরও অনেকের সঙ্গে। অভিনয়ও করেন কিছু ছবিতে। ১৯৭২ সালে পরিচালনা করেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রথম পূর্ণাঙ্গ ছবি ‘ওরা ১১ জন’। চাষী নজরুল ইসলাম ৩৫টির মতো ছবি নির্মাণ করেন। এর মধ্যে ছয়টি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক। তার পরিচালিত উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রগুলো হলো- ‘সংগ্রাম’, ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’, ‘মেঘের পরে মেঘ’, ‘ধ্রুবতারা’, ‘শহীদ ক্যাপ্টেন সালাউদ্দীন’, ‘দেবদাস’, ‘শুভদা’, ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা’, ‘হাছন রাজা’, ‘শাস্তি’, ‘সুভা’ ইত্যাদি। গোবিন্দ হালদার১৭ জানুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন গোবিন্দ হালদার। আমাদের মুক্তির সংগ্রামে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত তার লেখা গান মুক্তিযোদ্ধাসহ দেশের সর্বস্তরের মানুষকে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি’ কিংবা ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে রক্ত লাল’ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় লেখা এমন অনেক কালজয়ী গানের স্রষ্টা তিনি। দীর্ঘ রোগভোগের পর কলকাতার একটি হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। তার বয়স হয়েছিল ৮৬ বছর।  ফটোসাংবাদিক মীর মহিউদ্দিন২৫ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন জ্যেষ্ঠ ফটোসাংবাদিক মীর মহিউদ্দিন সোহান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। প্রায় তিন দশক ধরে দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় কর্মরত ছিলেন মীর মহিউদ্দিন সোহান। সবার কাছে তিনি পরিচিত ছিলেন ‘সোহান ভাই’ নামে। নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে তোলা আলোকচিত্রের জন্য সমাদৃত হন মীর মহিউদ্দিন সোহান। মীর মহিউদ্দিন সোহান জাতীয় প্রেসক্লাব ও বাংলাদেশ ফটোজার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের জ্যেষ্ঠ সদস্য ছিলেন। সাংবাদিক সাইফুল ইসলাম তালুকদার ১৫ মার্চ মৃত্যুবরণ করেন বিশিষ্ট সাংবাদিক আমাদের সময়ের বিশেষ প্রতিনিধি সাইফুল ইসলাম তালুকদার। তিনি বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) যুগ্ম মহাসচিবেরও দায়িত্বে ছিলেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৫৬ বছর।  সাইফুল ইসলাম তালুকদার বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) জাতীয় নির্বাহী কমিটির ২০১৩-১৫-এর যুগ্ম মহাসচিব পদে দায়িত্ব পালন করছিলেন। এর আগে তিনি ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) ভাইস প্রেসিডেন্টসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। সর্বশেষ তিনি দৈনিক আমাদের সময়ে বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত ছিলেন।অভিনেতা সিরাজুল ইসলাম ২৪ মার্চ  মৃত্যুবরণ করেন নাটক, চলচ্চিত্র ও মঞ্চের ‘দাপুটে’ অভিনেতা সিরাজুল ইসলাম। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার বিজয়ী এই অভিনেতা ১৯৮৪ সালে প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান ‘চন্দ্রনাথ’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য। তার পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র জননী। নাটক, চলচ্চিত্র ছাড়াও তিনি নির্মাণ করেছেন বেশ কিছু প্রামাণ্যচিত্র। দীর্ঘদিন পর গত বছর অভিনয় করেন অসমাপ্ত কবিতার গল্প ও দ্য প্রেস নামের দুটি টেলিছবিতে।সিরাজুল ইসলামের জন্ম ১৯৩৭ সালের ১০ অক্টোবর পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলায়। তার কর্মজীবন শুরু হয় বেতারে। পরে ১৯৫৬ সালে যোগ দেন তখনকার গণসংযোগ বিভাগে। মঞ্চে কাজ শুরু করেন সেই কৈশোরে। মহীউদ্দিন পরিচালিত ‘রাজা এলো শহরে’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে শুরু হয় তার অভিনয়জীবন। এরপর নাচঘর, অনেক দিনের  চেনা, শীত বিকেল, বন্ধন, ভাইয়া, রূপবান, উজালা, ১৩ নং ফেকু ওস্তাগার লেন, নয়নতারা, আলীবাবা, চাওয়া পাওয়া, গাজী কালু চম্পাবতী, নিশি হলো ভোর, সপ্তডিঙ্গা, মোমের আলো, ময়নামতি, যে আগুনে পড়ি, দর্পচূর্ণ, বিনিময়, ডুমুরের ফুলসহ তিন শতাধিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি।স্থপতি নভেরা আহমেদ৬ মে মৃত্যুবরণ করেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ভাস্কর নভেরা আহমেদ। প্যারিসের একটি হাসপাতালে তিনি মারা যান। তার বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর। ভাস্কর হামিদুর রহমানের সঙ্গে জাতীয় শহীদ মিনারের প্রাথমিক নকশা প্রণয়নে অংশগ্রহণকরেন তিনি। নভেরা আহমেদের জন্ম ১৯৩০ সালে। ১৯৭৩ সালের পর তিনি দেশ ত্যাগ করে প্যারিসে বসবাস শুরু করেন। বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৭ সালে তাকে একুশে পদকে ভূষিত করে। দীর্ঘ অন্তরাল জীবনের পর ২০১৪ সালে প্যারিসে তার রেট্রোসপেকটিভ প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়।প্রবীণ সাংবাদিক হাসানউজ্জামান খান ১৮ মে মৃত্যুবরণ করেন জাতীয় প্রেসক্লাবের আজীবন ও প্রতিষ্ঠাতা সদস্য প্রবীণ সাংবাদিক হাসানউজ্জামান খান। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯০ বছর।প্রেসক্লাবে জানাজা শেষে তাকে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।

Advertisement

জ্যোতির্বিজ্ঞানী এ আর খান ২৬ মে মৃত্যুবরণ করেন বিশিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানী ড. আনোয়ারুর রহমান খান (এ আর খান)। যুক্তরাজ্যের সেন্ট মেরিস হাসপাতালে তিনি ইন্তেকাল করেন। ঢাকার বিক্রমপুরে ১৯৩২ সালে জন্মগ্রহণ করেন এ আর খান। ১৯৫৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর শেষে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মজীবন শুরু করেন তিনি। ১৯৬০ সালে কলম্বো পরিকল্পনার ফেলো হিসেবে যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল ফিজিক্যাল ল্যাবরেটরি ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের কেভেন্ডিস ল্যাবরেটরিতে গবেষক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৬২ সালে লন্ডনের ইমপেরিয়াল কলেজে যোগ দেন ও সেখান থেকে পিএইচডি করে দেশে ফেরেন। এরপর প্রথমে পদার্থবিজ্ঞান ও পরে ফলিত পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে (অধুনা তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল বিভাগ) অধ্যাপনা করেন। ১৯৭৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার বাসভবনের গ্যারেজে প্রতিষ্ঠা করেন অনুসন্ধিৎসু চক্র বিজ্ঞান সংগঠন। বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটিরও প্রতিষ্ঠাতা তিনি। ১৯৯৫ ও ২০১১ সালে বাংলাদেশের হিরণ পয়েন্ট ও পঞ্চগড় থেকে পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ পর্যবেক্ষণ দলের নেতৃত্ব দেন। গ্রামীণ বিজ্ঞান শিক্ষকদের মানোন্নয়নে  সত্যেন বসু বিজ্ঞান শিক্ষার ক্যাম্পের সূচনা করেন। সাংবাদিক সিরাজুর রহমান ২ জুন মৃত্যুবরণ করেন বিবিসির সাংবাদিক সিরাজুর রহমান। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮১ বছর। তিনি দীর্ঘদিন ধরে ফুসফুসের রোগে ভুগছিলেন। সিরাজুর রহমান ১৯৬০ সালে বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসে যোগদান করেন। ১৯৯৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিবিসি বাংলা বিভাগ থেকে অবসর নেন। ১৯৩৪ সালে নোয়াখালীতে জন্মগ্রহণ করেন সিরাজুর রহমান। কলকাতায় পড়াশোনা শেষে দৈনিক আজাদ, দৈনিক নবযুগ ও সাপ্তাহিক মিল্লাতে কাজের মধ্য দিয়ে তার দীর্ঘ সাংবাদিক জীবনের সূচনা হয়। ১৯৬০ সালে যোগদান করেন বিবিসিতে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বিবিসির বাংলা রেডিও অনুষ্ঠানে অবদানের জন্য সিরাজুর রহমান বাংলাদেশের জনগণের কাছে এক কিংবদন্তিতে পরিণত হন। ১৯৯৪ সালে বিবিসি থেকে অবসর নেওয়ার পর তিনি বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় নিয়মিত কলাম লিখতেন।সাবেক স্পিকার শেখ রাজ্জাক আলী ৮ জুন মৃত্যুবরণ করেন সাবেক স্পিকার শেখ রাজ্জাক আলী। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৭ বছর। বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত জীবনের অধিকারী শেখ রাজ্জাক আলীর জন্ম ১৯২৮ সালের ২৮ আগস্ট খুলনার পাইকগাছা উপজেলার হিতামপুর গ্রামের মুসলিম এক ব্যবসায়িক পরিবারে।  পেশাগত জীবনে তিনি ছিলেন একজন আইনজীবী। তার শিক্ষাজীবন ছিল বেশ বৈচিত্র্যময়। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫২ সালে অর্থনীতিতে ও ১৯৫৪ সালে বাংলা সাহিত্যে মাস্টার্স ডিগ্রি  অর্জন করেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই তিনি এলএলবি সম্পন্ন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাবস্থায় তিনি সক্রিয়ভাবে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে যোগ দেন। ১৯৫৮ সালে তিনি খুলনা জেলা জজকোর্টে ওকালতি শুরু করেন। ১৯৬৩ সালে তিনি ঢাকা হাইকোর্ট বারের সদস্য হন ও ১৯৬৪ সালে খুলনা আইনজীবী সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি খুলনা ল’ কলেজের প্রতিষ্ঠাকালীন সহ-অধ্যক্ষের দায়িত্বও পালন করেন। এরপর তিনি দীর্ঘ ২৫ বছর ওই কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি সশস্ত্র অংশগ্রহণ করতে না পারলেও শেখ রাজ্জাক আলী সীমান্ত অতিক্রম করে টেট্রা ক্যাম্পে চলে যান এবং রেডক্রসে যোগ দিয়ে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা দেন।  তার রাজনৈতিক জীবনের হাতেখড়ি আজীবন লড়াকু সৈনিক মওলানা ভাসানীর হাতে। তিনি ন্যাপে যুক্ত হয়ে রাজনীতি শুরু করেন। এরপর তিনি যোগ দেন জাসদে।১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালেও তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৯১ সালে তিনি আইন প্রতিমন্ত্রী নিযুক্ত হন। সে বছরই ৫ এপ্রিল তিনি ডেপুটি স্পিকার ও ১২ই অক্টোবর স্পিকার নির্বাচিত হন। ১৯৯২ সালে তিনি শ্রীলংকার কলম্বোয় প্রথম সার্ক স্পিকারস সম্মেলনে যোগদান করেন ও সার্ক স্পিকারস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালের বিতর্কিত জাতীয় নির্বাচনের পর শেখ রাজ্জাক আলীর সভাপতিত্বেই জাতীয় সংসদে স্বল্পসময়ের অধিবেশনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অনুমোদন দেওয়া হয়। শেখ রাজ্জাক আলী ২০০২ সালে যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের হাইকমিশনার নিযুক্ত হন। তিনি ২০০৬ সালের শেষ দিকে বিএনপি ছেড়ে কর্নেল অলি আহমদের সঙ্গে এলডিপি নামে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন। কিন্তু কিছুদিন পর তিনি রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। এরপর থেকে তিনি পরিবারের সঙ্গে নিভৃতে সময় কাটাতে থাকেন।সাংবাদিক হাবিবুর রহমান মিলন ১৪ জুন মৃত্যুবরণ করেন প্রগতিশীল সাংবাদিকতার অনন্য ব্যক্তিত্ব হাবিবুর রহমান মিলন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮০ বছর। তিনি প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ (পিআইবি)-এর চেয়ারম্যান, দৈনিক ইত্তেফাকের উপদেষ্টা সম্পাদক ও একুশে পদকপ্রাপ্ত প্রখ্যাত সাংবাদিক হাবিবুর রহমান মিলনের অস্তিত্বে মিশে ছিল সাংবাদিকতা। তিনি ছিলেন ন্যায়, নীতি ও আদর্শের এক প্রতিষ্ঠানতুল্য ব্যক্তিত্ব। জাতীয় প্রেসক্লাব ছিল তার সেকেন্ড হোম। সবসময় প্রেসক্লাবে ছুটে আসতেন। মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা আমজাদ খান চৌধুরী৯ জুলাই মৃত্যুবরণ করেন দেশের বৃহৎ শিল্পগ্রুপ প্রাণ-আরএফএলের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী মে. জে. (অব.) আমজাদ খান চৌধুরী। যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলিনায় ডিউক মেডিক্যাল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে ডায়াবেটিস ও হৃদরোগে ভুগছিলেন। আমজাদ খান চৌধুরীর জন্ম ১৯৩৯ সালের ১০ নভেম্বর নাটোর জেলার। ১৯৫৬ সালে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। পরবর্তীকালে অস্ট্রেলিয়ান স্টাফ কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেন। কর্মজীবনে তিনি সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮১ সালে মেজর জেনারেল হিসেবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করেন। বাংলাদেশে কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাত শিল্পের পথিকৃৎ এ ব্যক্তিত্ব। তিনি এমসিসিআই, ডিইসি, আইডিসিওএল, বাংলাদেশ ডেইরি অ্যাসোসিয়েশনসহ বিভিন্ন সংগঠনের সভাপতি, পরিচালকসহ নানা পদে দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়া তিনি রিহ্যাব, বাপা, ইউসেপ প্রভৃতি সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। কণ্ঠশিল্পী ফরিদা ইয়াসমীন ৯ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন এক সময়ের জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী ফরিদা ইয়াসমীন। তিনি দেশের বিশিষ্ট দুই কণ্ঠশিল্পী নীলুফার ইয়াসমীন ও সাবিনা ইয়াসমীনের বোন। ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত সিনেমা আর রেডিওর গানে ফরিদা ইয়াসমীন ছিলেন অসম্ভব জনপ্রিয়। সে সময় তিনি আধুনিক বাংলা, উর্দু গান ও গজলে বিশেষ পারদর্শিনী ছিলেন।  ১৯৫৯ সালে ওস্তাদ মতি মিয়ার কাছে গান শিখতেন তিনি। সে বছরই ওস্তাদ ফরিদা ইয়াসমীনকে ‘এ দেশ তোমার আমার’ ছবিতে গান গাওয়ার সুযোগ করে দেন।  তার গাওয়া ‘রাজা এলো শহরে’ ছবির ‘জানি না ফুরায় যদি এই মধু রাতি’ গানটি  তাকে অসম্ভব খ্যাতি এনে দেয়।সংগীত ভুবনে ফরিদা ইয়াসমীন যখন খ্যাতির তুঙ্গে তখন ‘মাসুদ রানা’খ্যাত লেখক কাজী আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। এরপর ঘরসংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় গানবাজনার প্রতি তেমন একটা গুরুত্ব দেননি। তবে রেডিওতে মাঝে মধ্যে গান গাইতেন।প্রণবপত্মী শুভ্রা মুখোপাধ্যায়১৯ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন প্রণবপত্মী শুভ্রা মুখোপাধ্যায়। তিনি ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের স্ত্রী। শুভ্রার জন্ম ও বেড়ে ওঠা বাংলাদেশের নড়াইলে। ১৯৪০ সালের ১৭  সেপ্টেম্বর তৎকালীন যশোর জেলায় (বর্তমানে নড়াইল) ভদ্রবিলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত ভদ্রবিলায়ই বেড়ে ওঠেন তিনি। ১৯৫৭ সালের ১৩ জুলাই প্রণবের সঙ্গে বিয়ে হয় শুভ্রার। ওই সময় তারা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন। তাদের দুই ছেলে অভিজিৎ মুখোপাধ্যায় ও সুরজিৎ মুখোপাধ্যায় এবং এক মেয়ে শর্মিষ্ঠা মুখোপাধ্যায়।কাজী জাফর আহমেদ২৮ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন জাতীয় পার্টির একাংশের চেয়ারম্যান কাজী জাফর আহমেদ। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর। ষাটের দশকের ছাত্রনেতা এবং পরে চিনপন্থী বাম নেতা হিসেবে রাজনৈতিক অঙ্গনে পরিচিতি পাওয়া কাজী জাফরের ডাক নাম ছিল বুলু। জিয়াউর রহমানের আমলে শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরে সামরিক শাসক এইচএম এরশাদের হাত ধরে তার সরকারের প্রধানমন্ত্রী হন। দীর্ঘ তিন দশক জাতীয় পার্টির সঙ্গে থাকার পর ২০১৩ সালের ২৮ নভেম্বর কাজী জাফরকে দল থেকে বহিষ্কার করেন এরশাদ। এরপর দলের একাংশকে নিয়ে জাতীয় পার্টি নামেই নতুন দল গঠন করে গত বছর ২৫ জানুয়ারি বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটে যোগ দেন তিনি।রাজনীতিক জীবনে বহু মত ও দল বদলের কারণে আলোচিত ছিলেন কাজী জাফর। তার জন্ম ১৯৩৯ সালে চৌদ্দগ্রামে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তিনি ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন এবং ১৯৬২-১৯৬৩ সালে অবিভক্ত পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৬ সালে তিনি ‘চিনপন্থী’ কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত হন এবং পরে টঙ্গীর শিল্পাঞ্চলে শ্রমিক রাজনীতিতে জড়িয়ে শ্রমিকনেতা হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন।এক পর্যায়ে তিনি জাতীয় পার্টিতে যোগ দেন। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়ার পর ১৯৮৯ সালে কাজী জাফরকে প্রধানমন্ত্রী বানান সাবেক প্রসিডেন্ট এরশাদ। ১৯৮৬ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত তিনবার কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম আসন থেকে জাতীয় পার্টির সাংসদ নির্বাচিত হন কাজী জাফর। ২০১৩ সালে বহিষ্কৃত হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি এরশাদের জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ছিলেন।সমাজকল্যাণমন্ত্রী সৈয়দ মহসিন আলী১৫ সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করেন সমাজকল্যাণমন্ত্রী সৈয়দ মহসিন আলী। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬৭ বছর। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত মহসিন আলী গুরুতর অসুস্থ হলে গত ৩ সেপ্টেম্বর তাকে রাজধানীর বারডেম হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে অবস্থার অবনতি হওয়ায় ৫ সেপ্টেম্বর তাকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে সিঙ্গাপুর নেওয়া হয়। সেখানে তিনি মারা যান। সংসদ সদস্য হওয়ার আগে মৌলভীবাজার পৌরসভায় পরপর তিনবার নির্বাচিত চেয়ারম্যান ছিলেন সৈয়দ মহসিন আলী। ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে তিনি বিএনপি নেতা ও সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমানকে বিপুল ভোটে হারিয়ে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তবে তখন মন্ত্রিত্ব পাননি। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে আবার বিজয়ী হন। ১৯৪৮ সালের ১২ ডিসেম্বর সৈয়দ মহসিন আলী জন্মগ্রহণ করেন। সৈয়দ মহসিন আলীর শিক্ষা জীবন শুরু হয় কলকাতায়। তিনি কলকাতার সেন্ট জেবিয়ার্স স্কুলে জুনিয়র ক্যামব্রিজ ও সিনিয়র ক্যামব্রিজ পাস করেন। পরবর্তীকালে বাংলাদেশে এসে বাংলা মাধ্যমে কিছুদিন পড়াশোনা করেন। তবে আবারও তিনি কলকাতা থেকে ম্যানেজমেন্টে ডিপ্লোমা করেন। তিনি ১৯৭১ সালে  মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে বীরত্বের পরিচয় দেন। সম্মুখসমরে যুদ্ধ চলাকালে গুলিবিদ্ধও হন। মুক্তিযুদ্ধে তিনি সিলেট বিভাগে সিএনসি স্পেশাল ব্যাচের কমান্ডার ছিলেন। প্রবীণ সাংবাদিক আবদুল মতিন ২৫ সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করেন প্রবীণ সাংবাদিক আবদুল মতিন। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে লেখাপড়া শেষ করে ১৯৬১ সালে দৈনিক সংবাদে আবদুল মতিনের সাংবাদিকতা জীবনের শুরু। এরপর পাঁচ দশকের বেশি সময় ইংরেজি দৈনিক অবজারভার, সাপ্তাহিক হলিডে এবং দৈনিক নিউ নেশনে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। সর্বশেষ ২০০৪-০৫ সালে বাংলা দৈনিক জনকণ্ঠের সহকারী সম্পাদক ছিলেন আবদুল মতিন। সাংবাদিকদের দাবি আদায়ের বিভিন্ন আন্দোলনেও তিনি সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৯৮৬-৮৭ মেয়াদে মতিন অবিভক্ত ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সহসভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।গীতিকবি নয়ীম গহর ৮ অক্টোবর মৃত্যুবরণ করেন প্রখ্যাত গীতিকার ছিলেন নয়ীম গহর। তার অসংখ্য কালজয়ী গান রয়েছে। তিনি চলে গেলেও আমাদের শিল্পী মহলে বিখ্যাত হয়ে থাকবেন। দেশ স্বাধীনে তার যে অবদান তা জাতি আজীবন মনে রাখবে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী, সহযোদ্ধা ছিলেন তিনি। তার গান আমাদের বাংলা গানকে সমৃদ্ধ করেছে। মানুষের হৃদয়কে স্পর্শ করেছে। বিচারপতি হাবিবুর রহমান খান২১ অক্টোবর মৃত্যুবরণ করেন বিচারপতি হাবিবুর রহমান। হাবিবুর রহমান খান এক ছেলে ও এক মেয়ে রেখে গেছেন। সাবেক এই বিচারপতি বিচার বিভাগে অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন।পরে তিনি ওয়েজ বোর্ড, ট্রুথ কমিশন ও প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন। আসমা কিবরিয়া ১০ নভেম্বর মৃত্যুবরণ করেন গ্রেনেড হামলায় নিহত  সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়ার স্ত্রী চিত্রশিল্পী আসমা কিবরিয়া। রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৮ বছর। গ্রেনেড হামলায় স্বামীর নৃশংস মৃত্যুর প্রতিবাদে তিনি ‘শান্তির সপক্ষে নীলিমা’ শীর্ষক আন্দোলন গড়ে তোলেন। পটচিত্রশিল্পী রঘুনাথ চক্রবর্তী ২৩ নভেম্বর মৃত্যুবরণ করেন পটচিত্রশিল্পী রঘুনাথ চক্রবর্তী। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৪৬ বছর। ১৯৬৯ সালের ১ নভেম্বর রঘুনাথ চক্রবর্তী জন্মগ্রহণ করেন। গাইবান্ধার এ শিল্পীর ছবি আঁকার ব্যাপারে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না। কিন্তু পটচিত্রশিল্পে তিনি দেশের প্রথমসারির শিল্পী।মায়ের আলপনা আঁকা থেকে শিল্পী অনুপ্রাণিত হন। তার ভালো লাগত গ্রামের পালা, পার্বণ ও যাত্রা। এসবই পরে হয়ে ওঠে তার পটচিত্রের বিষয়। জাপানে শিল্পীর পটচিত্রের প্রদর্শনী হয়েছিল। সাংবাদিক আবদুল্লাহ আল ফারুক ১৪ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন জাতীয় প্রেসক্লাব এবং ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির স্থায়ী সদস্য সাংবাদিক আবদুল্লাহ আল ফারুক। কাকরাইল রাজমণি সিনেমা হল সংলগ্ন রাস্তায় ট্রাকের ধাক্কায় তিনি গুরুতর আহত হন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় স্কয়ার হাসপাতালে তিনি মারা যান।সাংবাদিক আবদুল্লাহ আল ফারুক সর্বশেষ দৈনিক আজকের পত্রিকায় প্রধান প্রতিবেদক ছিলেন। এর আগে তিনি দৈনিক কালের কণ্ঠে উপ-সম্পাদক ও প্রধান প্রতিবেদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া তিনি  দৈনিক সমকাল, যুগান্তর, সংবাদসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে কাজ করেছেন। আবদুল্লাহ আল ফারুক পাবনা জেলার সাঁথিয়া উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন।  মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৫১ বছর। শব্দসৈনিক রাশিদুল হোসেন বছরের শেষের দিকে ২২ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিক রাশিদুল হোসেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে  (বিএসএমএমইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন রাশিদুল হোসেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭২ বছর।মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তথ্য প্রচার ও বীর বাঙালিকে উৎসাহ যোগাতে প্রতিষ্ঠা করা হয় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। সেখানে সহযোগী প্রকৌশলী ছিলেন রাশিদুল হোসেন। একাত্তরে জীবন বাজি রেখে কাজ করে গেছেন।এইচআর/এমএস